তা হলে তুমি বুঝতে পারবে। সবই তো জান। এ জিনিস অনেকেই দেখতে পায় না। এমন দ্বীপ না হলে এ-রকমটি তো দেখা যায় না। দাঁড়াও, তোমাকে একটা জিনিস দেখাই।
বৃদ্ধ উঠিয়া গিয়া ঘরের কোণ হইতে একটা ছেঁড়া নেকড়ার পুঁটুলি আনিয়া আমার সামনে খুলিয়া বলিলেন–এই দেখো। আমি বিস্ময়ে অবাক হইয়া বৃদ্ধের মুখের দিকে চাহিলাম– এ কী! এ যে অতি সুন্দর অনেকগুলো মুক্তা। তাহাদের মধ্যে কতকগুলি আবার অত্যন্ত বড়ো বড়ো। সবসুদ্ধ গুনিয়া দেখিলাম–ছাব্বিশটা মুক্তা। পাঁচটি খুব বড়ো ও খুবই সুন্দর। আমি জীবনে কখনো এক জায়গায় এত মুক্তা দেখি নাই।
বৃদ্ধ বিজয়ীর গর্বভরে বলিলেন–সব কিন্তু ঝিনুক থেকে সংগ্রহ করেছি। শাঁস খাব বলে ঝিনুক কাটতে গিয়ে এই সব পেয়েছি।
কত দিনে?
দু-বছরে তিন বছরে।
আপনি কাছিমের খোলা বিক্রি করেন, মুক্ত বেচেন না?
না। কাউকে দেখাই না। অনেক টাকার মাল। টাকা হলে মনে অহংকার আসবে, বিলাসের ইচ্ছা আসবে–এমন সুন্দর জায়গা থেকে হবে চিরনির্বাসন।
আপনার মুক্তো কত টাকার?
বলো?
আমি ছেলেমানুষ, কী জানি বলুন!
বললে বিশ্বাস করবে?
আপনি বললে ঠিক বিশ্বাস হবে।
যদি বলি দু-লাখ টাকার ওপর?
আমি চমকিয়া উঠিলাম, দু-লাখ! আমি হাজার দুই তিনেক-এর কথা ভাবিয়াছিলাম। ধারণা আমার মাথার মধ্যেই নাই। এ কী আশ্চর্য ধরনের বৃদ্ধ তাহা জানি না। এই খেজুর-চাটাইয়ে শোন, ভাঙা কলসিতে জলপান করেন, খান কাছিমের মাংস ও ঝিনুকের শাঁস–এদিকে উঁহার ভাঙা কুঁড়েঘরে দু-লাখ টাকার মুক্তা অবহেলায় এক কোণে মাকড়সার জালে ঢাকা পড়িয়া রহিয়াছে। আমাকে নির্বাক দেখিয়া বৃদ্ধ বলিলেন–কী? বিশ্বাস হল না?
তা না, বিশ্বাস হয়েছে। আপনি অদ্ভুত লোক।
কিছু অদ্ভুত না। আমার দরকার থাকলে আজ বড়োমানুষ হতাম। শহরে বাড়ি করতাম। জুড়িগাড়ি করতাম। আমার দরকার নেই।
সংসারে আপনার কেউ নেই?
সবাই আছে।
তাদের টাকা দিয়ে দিন। তাদের দরকার আছে। কত গরিব লোক আছে, তাদের দিয়ে দিন।
তুমি এসেছ খুব ভালো। এখানে থাকো। সে মুসলমান মাঝিকে আমি বুঝিয়ে বলব। দু জনে এখানে থাকি, রাজি?
রাজি।
ঝিনুকের শাঁস খেয়ে থাকতে হবে।
আমি আপনার মুক্তো চাই না, আপনাকে আমার ভালো লেগেছে, আপনার কাছে থাকব।
বৃদ্ধ বদরুদ্দিনকে আমি সব বলিলাম। অবশ্য মুক্তার কথা বাদে। সে আমাকে অনেক নিষেধ করিল। ওই বৃদ্ধ উন্মাদ, উহাকে সবাই জানে, আজ অনেকদিন ধরিয়া এই দ্বীপে আছেন একা কচ্ছপের খোলার ব্যাবসা করেন, তাহাও শোনা গিয়াছে। উহার সঙ্গে থাকিয়া কী লাভ? অবশেষে আমার দৃঢ়তা দেখিয়া চলিয়া গেল। বলিল, সে আবার আসিবে। যদি কোনো অসুবিধা হয়, সে আসিয়া লইয়া যাইবে।
সেই হইতে আমার এক নতুন জীবন আরম্ভ হইল।
দুই মাস কাটিয়া বর্ষা নামিল। এখানে বর্ষাটা বড়ো বেশি। দিনরাতের মধ্যে বিরাম নাই। বৃদ্ধকে ঘরের বাহির হইতে দিই না। জেলেদের সঙ্গে থাকিয়া মাছ ধরিবার পদ্ধতি শিখিয়াছিলাম। নানা রকমের সামুদ্রিক মাছ ধরি। ঝিনুকের শাঁস আমি বড়ো একটা খাই না। বৃদ্ধও আমার কাজে খুব সন্তুষ্ট। ভালো মাছ ধরিয়া বৃদ্ধকে রান্না করিয়া খাওয়াই। ঝিনুক কুড়াইয়া আনি। একদিন বৃদ্ধ আমাকে আরও দু-টি লুকোনো মুক্তা দেখাইলেন। মস্ত বড়ো দুইটি মুক্তা। বলিলেন–দাম জান? বলো তো? চোদ্দো হাজারের কম নয়! তুমি বিশ্বাস করো?
এসব সময় মনে হয় বৃদ্ধ বোধ হয় কিছু মাথা-খারাপ হইবেন। আমার অবিশ্বাসে কী আসে যায়? কেনই-বা উনি এত টাকা এখানে নির্জন বালুচরে পুঁতিয়া রাখিয়াছেন? জগতের কত না উপকার হইতে পারিত এ টাকার দ্বারা?
বলিলাম–দাদু আমাকে একদিন মুক্তোর ঝিনুক দেখান না?
বেশ, চিনিয়ে দেব। সবসময় কি পাওয়া যায়। কালেভদ্রে।
তবে এতগুলো কী করে পেলেন?
একদিন তোমাকে বলব।
আমি ছাড়িবার পাত্র নই। তাঁহাকে চাপিয়া ধরিলাম, না এখনি বলিতে হইবে। এতগুলি মুক্ত কীরূপে পাইলেন?
বৃদ্ধ বলিলেন–মুক্তোর ঝিনুক এখানেই পাওয়া যায়। সেইজন্যেই আমি তো বলছি, চিনিয়ে দেব।
এখুনি দিন।
এসো আমার সঙ্গে।
তারপর দ্বীপের উত্তর-পূর্ব-কোণে একটা সম্পূর্ণ নিভৃত স্থানে আমাকে লইয়া গিয়া একটা গাছের তলায় বসাইলেন। সে-স্থানে একরাশি ঝিনুক ছিল। আমায় বলিলেন–এর নীচের সমুদ্রে একটা পাহাড় আছে জলের তলায়। সেই পাহাড়ের গায়ে লেপটিয়ে থাকে যেসব ঝিনুক–সবগুলিই প্রায় মুক্তগর্ভা ঝিনুক।
সব?
এক-শোটার মধ্যে সাত-আটটা।
এই হল আপনার সব?
ওরই নাম সব। ওই বেশি। ডুব দিয়ে পাহাড়ের গা থেকে ওগুলো তুলতে হয়। হাঙরের ভয় এখানকার জলে। একটু সাবধান হতে হয়। চলো তোমায় দেখিয়ে দিই।
একটা গাছের নীচের পথ দিয়া আমরা সোজা নামিয়া আসি সমুদ্রের বালুতটে। জলে নামিয়া হঠাৎ বামদিকে এককোমর জলে দাঁড়াইয়া বৃদ্ধ বলিলেন–এসো। সোজা চলো দশ পা। তারপর ডুব দিলেই পাহাড়। আমি বৃদ্ধের কথামতো সেখানটাতে ডুব দিয়া দেখিলাম ছোটো পাথরের একটা চড়া সেখানটাতে আছে বটে। ডুব দিয়া পাথরের গা হইতে আমি আট-দশটা ঝিনুক তুলিয়া আনিলাম। উত্তেজনার মাথায় সেগুলি তখনই ভাঙিয়া ফেলিলাম ডাঙায় বসিয়া। কিছুই নাই। আমার হতাশা দেখিয়া বৃদ্ধ বলিলেন–সারাদিন তুলে যদি একটা মুক্তোও পাওয়া যায় তা হলে যথেষ্ট হয়েছে বিবেচনা করবে। এ কাজে বড়ো পরিশ্রম।