কিন্তু না, এই বৃদ্ধের রং আমার দাদামহাশয়ের চেয়ে সামান্য একটু কালো। সাদা দাড়িটিও বেশি লম্বা। পরনের কাপড় অতি ছিন্নভিন্ন ও মলিন। আমার দিকে খানিকটা চাহিয়া চাহিয়া বলেন–বাঙালি?
উত্তর দিলাম–আজ্ঞে হাঁ।
কোথায় বাড়ি?
অনেক দূর।
এখানে কী করে এলে?
মাছ ধরতে এসেছি কাছিমখালি। এখানে শাক তুলতে এসেছি।
হিন্দু না মুসলমান?
হিন্দু।
তোমার সঙ্গী কই?
তামাক সাজতে গিয়েছে ডিঙিতে। আপনি কে?
আমিও বাঙালি হিন্দু! আমি এখানে থাকি।
এখানে?
কেন, এ জায়গা কি খারাপ?
না, তা বলিনি। খুব চমৎকার জায়গা। কিন্তু এখানে আপনি কী করেন?
ব্যাবসা করি।
আমি অবাক হইয়া বৃদ্ধের স্নেহকোমল মুখের দিকে চাহিয়া থাকি। লোকটি পাগল নাকি? মুখ ও চোখের ভাবে কিন্তু পাগল বলিয়া তো মনে হয় না। তবে এমন আবোল-তাবোল বলিতেছেন কেন? আমার চোখের বিস্ময়ের দৃষ্টি বৃদ্ধ বুঝিতে পারিলেন! বলিলেন–বিশ্বাস হয় না?
এখানে কীসের ব্যাবসা?
এসো আমার সঙ্গে। কাউকে কিছু বোলো না। তোমার সঙ্গী কোথায়?
সে এখন আসবে না। তামাক খেয়ে নাইবে সমুদ্রে, বলে গিয়েছে।
সে হিন্দু না মুসলমান?
মুসলমান।
আমাকে খেতে দেবে সে?
খাবেন? নিশ্চয়ই। আমি নিজে আনছি।
সেজন্যে নয়, আমি সকলের হাতেই খাই। কী আছে?
চিঁড়ে খাবেন?
উঃ, কতদিন চোখে দেখিনি! কিন্তু শোনো, এখন থাক। আগে চলো আমার সঙ্গে। তোমাকে দেখাই আগে, কেউ এসে পড়বার আগে। বড় গোপন জিনিস কিনা!
আমার খানিকটা ভয় না হইল এমন নয়। অদ্ভুত-দর্শন বৃদ্ধের সঙ্গে এই সম্পূর্ণ অপরিচিত স্থানে কি আমার যাওয়া উচিত? কিন্তু ভয় বা কীসের? আমি নবীন যুবক। আমার সঙ্গে শরীরের শক্তিতে এই বৃদ্ধ কতক্ষণ যুঝিবেন?
গেলাম উহার সঙ্গে।
কিছুদূর গিয়া একটা বনের পিছনে পাতা-লতার একটি কুটির দেখিয়া আমি অবাক হইয়া গেলাম। বৃদ্ধ আমাকে কুটিরের সামনে লইয়া গেলেন। আমি বলিলাম–চারিদিকে এত কচ্ছপের খোলা কেন?
বৃদ্ধ হাসিয়া বলিলেন–ওই আমার ব্যাবসা।
কী ব্যাবসা?
কচ্ছপের খোলার।
এখানে কচ্ছপ ধরেন কী করে?
এখানকার নাম কাছিমখালির চর। এখানকার সব দ্বীপের চরে সমুদ্র থেকে বড়ো কচ্ছপ উঠে রোদ পোয়ায়, ডিমে তা দেয়। তোক তো নেই কোনো দিকে!
কী করে ধরেন?
উলটে দিলেই হল। আর নড়তে পারে না।
তারপর?
তারপর ওদের কাটি। মাংস খাই, ডিম খাই, আর কাছিমের খোলা বিক্রি করি। লোকে নৌকো করে এসে জমানো খোলা কিনে নিয়ে যায়। ওরাই চাল দিয়ে যায়। অনেক দিন আসেনি, চাল ফুরিয়ে গিয়েছে, শুধু কাছিমের মাংস খেয়ে ভালো লাগে না–তাও আজ তিন দিন একটা কাছিমও ডাঙায় ওঠেনি।
আমার সঙ্গে দেখা না হলে কী খেতেন?
কেন? ঝিনুক?
ঝিনুক!
খুব ভালো খেতে ওর শাঁসটা। তোমাকে খাওয়াব, এসো ঘরের মধ্যে এসো।
কুটিরের মধ্যে ঢুকিলাম। একটি ছিন্ন খেজুরপাতার চাটাই একপাশে পাতা, তাহার উপরে একটি ছেঁড়া বালিশ। একটি ঝকঝকে মাজা কাঁসার জামবাটি ছাড়া অন্য কোনো মূল্যবান জিনিস নাই ঘরের মধ্যে? একটি তিরধনুক ঘরের এক কোণে হেলানো। খাবার জলের জন্য একটি মাটির কলসি, তাও কানা-ভাঙা। অতি গরিব লোকের ঘরে ইহার চেয়ে অনেক বেশি জিনিস থাকে। আমি খুব অবাক হইয়া চারিদিকে দেখিতেছি দেখিয়া বৃদ্ধ বলিলেন–ভাবছ কী করে থাকি, না? তা নয় বাবা, বেশ থাকি।
সত্যি?
ঠিক তাই। খুব ভালো থাকি। কোনো মানুষ আমার নিন্দে করবে না, আমিও কারো নিন্দে করব না। মানুষ যেন কখনো মানুষের নিন্দে না করে। ওটা আমি সব চেয়ে অপছন্দ করি।
কি?
কেউ কারো নিন্দে করা। এখানে বেশ আছি।
কী করে দিন কাটান আপনি এখানে?
বৃদ্ধ হাসিয়া উঠিলেন। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া দূরে সমুদ্রের নীল জলরাশির দিকে চাহিয়া চাহিয়া কী যেন ভাবিলেন। আমার সে সময় মনে হইল, ইনি অতি অদ্ভুত ব্যক্তি। হঁহার মতো মানুষ আমি এই প্রথম দেখিতেছি। হঁহার আগে যেসব মানুষ দেখিয়াছি তাহারা যে ধরনের, ইনি অন্য ধাতের মানুষ উহাদের থেকে। ইহার মতো চোখের দৃষ্টি তো কাহারও দেখি নাই এ পর্যন্ত।
আমিও কিছু না বলিয়া চুপ করিয়া রহিলাম।
তিনি আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন–দিন এখানে বড়ো সুন্দর কাটে, বুঝলে? এত সুন্দর কাটে যে আমি এ জায়গা ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে চাইনে!
কী করেন সারাদিন?
সারাদিন বসে থাকি।
বসে?
ওই সমুদ্রের দিকে চেয়ে বসে!
তারপর হাসিয়া উঠিয়া বলিলেন–আরে না না, তা ঠিক নয়। আমাকে তো খেতে হবে। কাছিমকে চিত করিয়ে দিয়ে তার মাংস কাটি–একটা বড়ো কাজ না? ঝিনুক কুড়োই বালুর চর থেকে। বড়ো একটা কাজ। শাঁস ছাড়াই–বড়ো একটা কাজ–কী বল?
আমিও হাসিতে লাগিলাম। না, বৃদ্ধ যেন শিশুর মতো সরল। আমার বড়ো ভালো লাগে। আমার দাদামহাশয়ের মতোই বটে। মনে হইল যেন ইনি আমার বহুদিনের পরিচিত।
উনি বললেন–তুমি ভাবছ, কেমন করে থাকেন? এ দ্বীপের রূপ দিনের মধ্যে এতবার বদলায়! যত দেখবে তত আরও দেখতে ইচ্ছে হবে। দেখে দেখে বুদ্ধি ফুরোয়। ভালো কথা, আজ সন্ধ্যের সময় সূর্য অস্ত যাওয়াটা একবার এ দ্বীপের একটা জায়গা থেকে দেখো তো! একটা গাছ আছে, তার ওপর আমি চড়ে থাকি। তোমাকেও চড়াব। দেখলে মোহিত হয়ে যাবে।
আমি দেখেছি।
কী দেখেছ?
উদয় ও অস্ত দুই-ই। আমি বার-দরিয়ায় হারিয়ে গিয়েই তো এখানে এসেছি। সে সময় নৌকায় বসে তিন দিন তিন রাত আমি দেখেছি।