বলিয়াছিলাম–পাগল হয় কেন?
তা জানি নে। মাথা খারাপ হয়ে যেতে দেখেছি বাবু।
তারপর? কোথাকার লোক ওরা?
বৰ্মাদেশের লোক বলে মনে হল। ঠিক বলতে পারব না। তারা কুমড়ো বোঝাই করে কোনো নদীপথে কিংবা দুটো দ্বীপের মাঝখানের সমুদ্রে নৌকো বাইতে বাইতে চোরা সোঁতায় পড়ে গিয়ে বার-সমুদ্রে চলে এসেছিল। তারপর যা হবার তাই হয়েছে। ওরা ডাঙার লোক ছিল নিশ্চয়, নইলে কুমড়ো আনবে কোথা থেকে? সামপানে কুমড়ো বোঝাই দিয়ে কেউ সমুদ্রে পাড়ি জমায় কি?
এইসব কথা আমার মনে পড়িল, আমি ঘর-পোড়া গোরু। এই সেদিন ডুবো সোঁতা হইতে মরিয়া যাইতে যাইতে বাঁচিয়াছি না নিজে? বদরুদ্দিন আমায় কী শিখাইবে?
যেমন একথা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অমনি এক লাফ দিলাম ডিঙি হইতে। ভুলিয়া গেলাম যে সমুদ্র হাঙর-সংকুল ও অত্যন্ত বিপজ্জনক।
সাঁতরাইতে ভালোই জানিতাম, ডাঙাও খুব বেশি দূরে ছিল না। একটু হয়তো সাঁতরাইতে পারিব, ইহার বেশি হইলে আমার পক্ষে ডাঙায় উঠা সম্ভব হইবে না।
বেশ সাঁতরাইতেছি, হঠাৎ আমার নিকট হইতে হাত-ষোলো-সতেরো দূরে একটা চওড়া মাছের ডানা জলের উপর একবার ভাসিয়া পরক্ষণেই ডুবিয়া যাইতে দেখিয়া আমার হাত-পা অবশ হইয়া গেল। এ তো কোনো মাছের ডানা বলিয়া মনে হয় না। এ নিশ্চয় সামুদ্রিক হাঙরের ডানা! কামটের ডানা এত বড়ো হইবে না।
আবার সেই বড়ো ডানাটা ভাসিয়া উঠিল আমার নিকট হইতে আট-নয় হাত মাত্র দূরে। আমার মনে হইল যে করিয়াই হউক আমাকে এই ভীষণ জানোয়ারের হাত এড়াইতেই হইবে। একবার যদি ইহার হাতে পড়ি, তাহা হইলে আর রক্ষা নাই। এই সময় ডানাটা আবার ডুবিয়া গেল। এইবার বোধ হয় ইহা ভাসিয়া উঠিবে আমাকে মুখে শক্ত করিয়া কামড়াইয়া ধরিয়া। চট করিয়া বাঁ-দিকে ঘুরিয়া গেলাম এবং খুব চিৎকার করিতে লাগিলাম। এমন সময় ডানাটি ভাসিয়া উঠিল, ইতিপূর্বে এক সেকেণ্ড আগে আমি যেখানে ছিলাম সেখানে। এই সময় সেই ভীষণ-দর্শন সামুদ্রিক হাঙরের মুখটিও ভাসিয়া উঠিল, কিন্তু আমি যেদিকে আছি তাহা হইতে সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে। হাঙরের লক্ষ্য ভ্রষ্ট হইয়াছে বুঝিলাম। কিন্তু এইবেলা যাহা করিতে পারি, বিলম্বে আর রক্ষা নাই। সঙ্গেসঙ্গে দুই হাত্তা সাঁতার দিয়া ডাঙার দিকে আসিতে চেষ্টা করিলাম। হঠাৎ আমার হাঁটুতে কে যেন শক্ত মুগুরের এক ঘা লাগাইল, জলের মধ্যে যেন পা-খানা কাটিয়া পড়িয়া গেল মনে হইল। দাঁতে দাঁত চাপিয়া তখনো সাঁতার দিতেছি–যাক একখানা পা, ডাঙায় উঠিতে না পারিলে সমস্ত দেহখানাই যে চলিয়া যাইবে।
এই সময় একটা বড়ো ঢেউ আসিয়া আমাকে ডাঙার দিকে হাতদশেক আগাইয়া দিয়া গেল। পরক্ষণেই দেখি আমি আবার অন্য দিকে অনেক দূর চলিয়া গিয়াছি, কিন্তু ডাঙাটা আর কোনোদিকেই দেখা যায় না। অনেক কষ্টে ডাঙার দিকে যদি-বা দু-হাত আসি, আবার চার হাত জলের মধ্যে চলিয়া যাই ডুবো সোঁতার টানে। এই জন্যই আমার ডিঙি বাহির-সমুদ্রে অতটা গিয়া পড়িয়াছিল, এইবার ভালো করিয়া বুঝিলাম।
আমার চিৎকার শুনিয়া দু-তিনজন আমাদের দলের জেলে ছুটিয়া আসিয়া আমাকে জল হইতে টানিয়া তুলিল। তখন আমি এমন অবসন্ন যে উহাদের কথার জবাব পর্যন্ত দিতে পারিলাম না। তাহারা বার বার বলিতে লাগিল, খুব বাঁচিয়া গিয়াছি। সেই সমুদ্রে পড়িয়া সাঁতার দেওয়া যে কী জিনিস তাহা যে জানে না, তাহাকে বলিয়া লাভ কী?
আমি বলিলাম–জানি হে জানি। আমাকেও ছাড়েনি, হাঙরে তাড়া করেছিল। উহারা সমস্বরে বলিয়া উঠিল–কক্ষনো হয় না। রাগের সহিত বলিলাম–কী হয় না? তাহারা বলিল–কক্ষনো বাঁচতে পারে না হাঙরের মুখ থেকে– আলবৎ বেঁচেছি। আমার পাশে চার হাত তফাতে ওর ডানা লেগেছিল, ওর মুখও দেখেছি।
ডানা? হাঙরের নয়।
নিশ্চয় হাঙরের।
বদরুদ্দিন সব শুনিয়া বলিল–বাবু, ওরা ঠিক বলেছে। হাঙর ওভাবে একবার জাগবে একবার ভাসবে না–হাঁ করে তাড়া করে এসে কামড়ে ধরবে, ও হাঙর নয়।
কী তবে ওটা?
ওটা মহাশির মাছ, হাঙরের মতো দেখতে, মুখও অনেকটা হাঙরের মতো।
আমি প্রথমটা বিশ্বাস করি নাই। বদরুদ্দিন বলিল– ও মাছ তোমাকে দেখাবো, আমাদের আড়তে চলো—
কোথায়?
তার নাম কাছিমখালি। একটা ছোটো দ্বীপ।
আর কে আছে সেখানে?
কেউ না। শুধু আমরাই থাকি।
কী হয় সেখানে?
গেলেই দেখবে।
চাঁদডুবির মতো সুন্দর জায়গা?
মন্দ নয়।
একদিন কাছিমখালি দ্বীপে আমরা গিয়া নোঙর করিলাম। এখানে খড় দিয়া ইহারা ছোটো ছোটো ঘর তৈয়ারি করিয়াছে। অকূল সমুদ্রের ধারে বাঁশের লম্বা আলনা ও বন্য লতা টাঙানো আলনা। মাছের রাশি এখানে রৌদ্রে শুকাইবার জন্যই এই আলনার ব্যাপার। শুঁটকি মাছের দুর্গন্ধে সমুদ্রতীরের বাতাস ভারাক্রান্ত।
খাদ্যও এখানে শুধু মাছ ও ভাত। না ডাল, না কোনো তরকারি। বেশিদিন কাঁচা তরকারি না খাইলে নাকি একপ্রকার রোগ হয়, সেজন্য বদরুদ্দিন সেদিন আমাকে লইয়া নিকটবর্তী আর একটি দ্বীপে গেল। সেখানে বনের ছায়ায় ছায়ায় একরকম শাক গজায়, দু-জনে তাহাই তুলিয়া নৌকার খোলে জমা করিলাম। শাকগুলির পাতা অবিকল থানকুনি পাতার মতো– কিন্তু আমরুল শাকের মতো টক।
এখানে এক ব্যাপার ঘটিল।
আমি শাক তুলিতে তুলিতে চারিদিকে চাহিয়া দেখিতেছি, বদরুদ্দিন ডিঙিতে তামাক সাজিতে গিয়াছে, এমন সময় দেখি একজন বৃদ্ধ আমার দিকে আসিতেছেন। দু-মিনিটের মধ্যে বৃদ্ধটি আমার সামনে আসিয়া দাঁড়াইয়া আমার দিকে অতি স্নেহপূর্ণ করুণ দৃষ্টিতে চাহিতে লাগিলেন। ঠিক যেন আমার দাদামহাশয়। একবার অতি অল্প সময়ের জন্য মনে হইল আমার সেই দাদামহাশয় আমার সন্ধানে বাহির হইয়া এখানে আসিয়া বুঝি পৌঁছিয়াছেন। আমার মন কেমন করিয়া উঠিল আমার দাদামহাশয়ের জন্য।