বামদিকের বাঁশবনের তলা দিয়া সঁড়িপথ মিষ্ট জলের খাঁড়ির দিকে চলিয়া গিয়াছে। জেলেদের পায়ে চলার চিহ্ন এ পথের সর্বত্র। আমি সে-পথে একা অনেক দূরে চলিয়া গেলাম। ঠিক যেন সুন্দরবনের একটি অংশ, তেমনি ঘন বন, তবে কেয়া গাছ ছাড়া সুন্দরবনের পরিচিত কোনো গাছ নাই। এক জায়গায় দেখি অনেক জংলি গোঁড়া লেবুর গাছ, যেন কে লেবুর বাগান করিয়া রাখিয়াছে। সুন্দরবনেও এ লেবুর জঙ্গল অনেক জায়গায় আছে।
জল লইয়া জেলেরা চলিয়া গেল। আমি এক জায়গায় লেবুবাগানের মধ্যে একটি আশ্চর্য দ্রব্য হঠাৎ আবিষ্কার করিলাম। সেটি একটি ছোটো কামান। এই কামানের গায়ে বাংলা অক্ষরে লেখা আছে কী সব কথা, পড়িতে পারিলাম না।
একজনকে ডাকিয়া বলিলাম– শোনো—
সে ফিরিয়া আসিয়া বলিল–কী?
এটা কী?
দেখতেই পাচ্ছ কামান!
কী করে এল এখানে?
জানি নে।
জানতে ইচ্ছে করে না?
কী দরকার—
মিটিয়া গেল। ইহাদের কোনো কৌতূহল নাই কোনো বিষয়ে। আমার ইচ্ছা হইল কামানটা সঙ্গে করিয়া লইয়া যাই। কিন্তু অত ভারী জিনিস একা আমার সাধ্য নাই বহিবার। লোকটার সহিত অনিচ্ছার সহিত চলিয়া যাইতেছিলাম, এমন সময় সে এমন একটা কথা বলিল যাহাতে আমি থমকিয়া দাঁড়াইয়া গেলাম। সে বলিল–শুধু কি একটা কামান দেখছ বাবু, ওই জঙ্গলের মধ্যে গড় আছে, ভেঙে পড়ে আছে মস্ত গড়!
সে কী?
গড় মানে কেল্লা। এটাকে বলে চাঁদডুবির গড়। কত আশ্চর্য জিনিস এখানে ছিল, এখনও আছে। কত লোক কত টাকা পেয়েছে এখানে। গড়ের ইটের মধ্যে আমার গাঁয়ের এক বুড়ো লোক সোনার পাত আর আকবরি আমলের সোনার টাকা পেয়ে খুব বড়ো মানুষ হয়েছিল। তবে বাবু ওতে বিপদ আছে–
কী বিপদ?
বাবু, ওতে বংশ থাকে না।
বয়ে গেল!
তুমি ছেলেমানুষ তাই এমন বলছ। বড়ো হলে আর বলবে না। তা ছাড়া—
তা ছাড়া কী?
অপদেবতার ভয়—
মানি না।
নেই বললেই সাপের বিষ চলে যায়? সন্ধ্যের পর তেষ্টায় গলা শুকিয়ে মরে গেলেও কেউ চাঁদডুবির খাঁড়িতে জল নিতে আসবে না।
বল কী?
তাই, তুমি যাকে হয় জিজ্ঞেস করে দেখো—
আমি যদি সন্ধ্যের পর এখানে থাকি?
প্রাণ একবার খোয়াতে বসেছিলে, আবার খোয়াবে। চলো, তোমাকে একটা গল্প বলব।
আমার কিন্তু ভূতের গল্প শুনিবার বিশেষ আগ্রহ ছিল না। রাজবাড়ির ধ্বংসস্তূপ দেখিয়াছিলাম সুন্দরবনে, এখানে শুনিয়াছি কেল্লা আছে। কাহাদের এসব জিনিস? কাহারা এখানে কেল্লা বা রাজবাড়ি বানাইয়াছিল অতীত দিনে? কাহারা এখানে তাহাদের অতীত গৌরবদিনের চিহ্ন ফেলিয়া রাখিয়া অজানা পথে চলিয়া গেল? কে তাহারা? কী দিয়া ভাত খাইত তাহারা? কী ভাষায় কথা বলিত? কী করিয়া দিন কাটাইত? কী ভাবিত মনে মনে?
এইসব কথা আমাকে এখনই কেহ বুঝাইয়া বলিতে পারে?
এই সব আমি জানিতে চাই। কোনো অপদেবতার কাহিনি নয়–যাহা সত্য ঘটিয়াছিল, তাহাই জানিতে চাই, কোনো মনগড়া ঘটনা নয়। ডিঙিতে ফিরিয়া গিয়া বুড়ো মাঝি বদরুদ্দিনকে সব কথা বলিলাম। সে কি কিছু দেখিয়াছে। এখানে আরও কোনো দ্বীপে কি এমন আছে?
বদরুদ্দিন বলিল– সুন্দরবনে এমন কোনো কোনো জায়গায় আছে। এদিকের মধ্যে চাঁদডুবিতে আছে, আর সোনার দ্বীপে আছে। ওসব সেকেলে রাজাদের কান্ড সোনার মোহর পাওয়ার কথাও সত্যি। আমি নিজে একবার একখানা সেকেলে তলোয়ার পেয়েছিলাম, তলোয়ারখানার বাঁটে কত কী কাজ করা! আমার জামাই সেখানা নিয়ে গিয়ে মহকুমার হাকিমকে দেখায়। তিনি বলেন–এখানা সেকালের দামি জিনিস–জাদুঘরে দিয়ে দাও। আমার জামাই তা দেয়নি, ফিরিয়ে নিয়ে আসে। এখনও আমার বাড়িতে আছে সেখানা।
সেখান হইতে আমরা আর একটি দ্বীপের কূলে চলিয়া গেলাম। জায়গাটির নাম ইদ্রিশখালির চর। এখানে বড়ো হাঙরের ভয়। জেলেরা কেহ জলে নামিতে সাহস করে না। দিগন্তরেখায় সূর্য উঠিতে দেখিয়াছি এখানে কত দিন। সমুদ্রের বুকে সূর্যোদয় কখনো দেখি নাই–শুনিলাম এখান হইতে এ দৃশ্য যেমন দেখা যায়, এমন আর এদিকে আর কোনো দ্বীপ হইতে দেখা যায় না।
এই সূর্যোদয় দেখিতে গিয়া একদিন বিপদে পড়িয়া গেলাম।
একটা ছোটো ডিঙি করিয়া কূল হইতে কিছুদূরে গিয়াছিলাম শেষরাত্রির দিকে। বৃদ্ধ বদরুদ্দিন আমাকে বলিয়াছিল–সমুদ্রের মধ্যে খানিকটা গিয়ে সূর্যোদয় দেখো বাবু।
কী যে সে অদ্ভুত দৃশ্য। জলের উপর একস্থানে একটা সরু আগুনের রেখা দেখা দিল প্রথমে। মনে হইল জলে আগুন লাগিয়াছে। পরক্ষণেই সূর্য হঠাৎ লাফাইয়া উঠিল যেন জলরাশির মধ্য হইতে একটা আগুনের গোলার মতো। তখনও সেটাকে সূর্য বলিয়া বোধ হইতেছিল না, একটা রঙিন ফানুস যেন জলের উপর কে উড়াইয়া দিয়াছে। বদরুদ্দিন ঠিকই বলিয়াছিল, ডাঙা হইতে এ শোভা দেখা যায় না।
এই পর্যন্ত ভাবিয়াছি, হঠাৎ দেখিলাম ডিঙিখানি কূল হইতে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে চলিয়াছে; ফিরাইবার চেষ্টা করিলাম, কিন্তু পারিলাম না। আবার কি চোরা সোঁতায় পড়িলাম? এই জিনিসটি বড়ো ভয়ের ব্যাপার এসব গভীর সমুদ্রে! মনু আমাকে অনেকবার বলিয়াছিল। বদরুদ্দিনও সেদিন বলিয়াছে। একবার নাকি উহারা এই চাঁদডুবি আর ইদ্রিশখালির মধ্যে কুমড়োবোঝাই একটা সামপান পায়। সামপানে তিনটি মৃতদেহ ছিল। দেখিয়া মনে হয়, তাহারা জল না খাইয়া মারা গিয়াছে। এ অবস্থায় লোকে সমুদ্রের জল পান করে, বেশি পরিমাণে সমুদ্রের জল পান করিলে পাগল হইয়া যায়।