ডিঙি হইতে নামিয়া ডিঙির মুখ ধরিয়া বাহির-সমুদ্রের দিকে ফিরাইলাম। একমাত্র ভরসা সমুদ্রের মধ্যে ডাঙা হইতে দূরে যাওয়া। কিন্তু সমুদ্রের মধ্যে লইয়া যাওয়া কি সোজা কথা? ভাটার টান অবশ্য খানিকটা সাহায্য করিতেছিল বটে। খানিক পরে মনে হইল সমুদ্রের নীচের কোনো সোঁতার মুখে পড়িয়া ডিঙি ক্রমাগত বাহিরের দিকেই চলিয়াছে। এ আবার আর এক বিপদ! কী করি উপায়? দু-বার নোনাজলের ঢেউ আছড়াইয়া পড়িয়াছিল ডিঙির উপর। সেঁউতি দিয়া জল সেচিতেছিলাম। ডুবো সোঁতার অস্তিত্ব এতক্ষণ বুঝিতে পারি নাই। মস্ত কী এক শুশুকের মতো সামুদ্রিক জানোয়ার আমার সামনে জলে উলট-পালট খাইয়া গেল, আমি নিরুপায় অবস্থায় বসিয়া রহিলাম। প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত আছি। সমুদ্রের কূল আর দেখা যায় না। সুন্দরবনের কালো রেখা কোথায় মিশিয়া গিয়াছে। সম্মুখে অনন্ত নীল জলরাশি। কোথায় চলিয়াছি? এবার সত্যই কি এ জীবন হইতে বিদায় লইবার দিন আসিয়া গিয়াছে?
দক্ষিণ-পূর্ব দিকে চলিতেছি, সূর্যের অবস্থান দেখিয়া মনে হইল। তটরেখা অদৃশ্য হইয়াছে বহুক্ষণ। দক্ষিণ-মেরুর দিকে চলিয়াছি নাকি? ক্ষুধা অপেক্ষা তৃষ্ণা বেশি কষ্ট দিতেছিল। শরীর অবসন্ন হইয়া আসিতেছে, ক্ষুধায় তত নয়–যতটা তৃষ্ণায়। সারাদিন কাটিয়া গেল। আবার সূর্যাস্ত দেখিলাম। আবার আকাশে নক্ষত্ৰ উঠিল। মাথার উপর অগণিত নক্ষত্রখচিত আকাশ, নীচে অনন্ত সমুদ্র–মরণের আগে কী রূপই অনন্ত আমার চোখের সামনে খুলিয়া দিলেন! মরিব বটে কিন্তু কাহাকে বলিয়া যাইব যে কী দেখিয়া মরিলাম।
অনেক রাত্রে কোথায় যেন বাঁ-দিকে বুম বুম করিয়া কামানের আওয়াজের মতো কানে আসিল। অন্ধকারের মধ্যে চাহিয়া দেখিলাম। কিছু বুঝিতে পারিলাম না। শেষরাত্রে খুব শীত করিতে লাগিল।
বোধ হয় ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলাম। উঠিয়া দেখি ডিঙি সমুদ্রে স্থির হইয়া আছে। সূর্য অনেক দূর উঠিয়া গিয়াছে। চারিদিকের নীল জলরাশি চিকচিক করিতেছে খর-রোদে। বেলা বাড়িবার সঙ্গে সঙ্গে পিপাসা বাড়িল। বিকালের দিকে মনে হইল আমার বহু দূরে ডান দিক দিয়া একখানা জাহাজ যাইতেছে। পরনের কাপড় খুলিয়া উড়াইয়া দিলাম, নাড়িতে লাগিলাম। তাহারা বুঝিতে পারিল না। অন্য দিকে চলিয়া অদৃশ্য হইয়া গেল।
কী কুক্ষণে কাল বাড়ি হইতে বাহির হইয়াছি! মনুর জন্য বড়ো কষ্ট হইতেছিল। বার বার উহার কথা মনে হইতেছে–উহার কথা আর দুই মার কথা। বনবিবিতলার মার কথাও যে কতবার মনে হইল।
আবার রাত্রি আসিল। আবার নক্ষত্র উঠিল। সেই রাত্রে শেষে আমি ঘুমাইয়া পড়িলাম কী অজ্ঞান হইলাম, জানি না। পৃথিবী ও সমুদ্র সেরাত্রে সব মুছিয়া গেল।
জ্ঞান হইলে দেখি একটা কাঠের ঘরে শুইয়া আছি–কাঠের ঘর কী কাঠের বাক্স। আমার পাশে একজন চাটগাঁয়ের মুসলমান বসিয়া। সে বলিল সেখানকার বুলিতে, আমি সারিয়াছি কিনা। আমি বলিলাম–আমি কোথায়? একজন বৃদ্ধ ব্যক্তি আসিয়া আমার শিয়রে বসিল। তাহার দিকে চাহিয়া মনে হইল ইহাকে দেখিতে আমার বাবার মতো। আমার নাম জিজ্ঞাসা করিল, চাটগাঁয়ের ভাষায় আমি কেন এভাবে সমুদ্রে ভাসিতেছিলাম? সব খুলিয়া বলিলাম। চাহিয়া দেখিলাম চারিদিকে। একটি ক্ষুদ্র গ্রামের মধ্যে আমি একটা কাঠের ঘরে শুইয়া আছি মনে হইল। উহাদের জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম তাহারা চাটগাঁয়ের মুসলমান জেলে। এই গ্রাম কোনো স্থায়ী বাসিন্দার গ্রাম নয়। মাছ আর সামুদ্রিক ঝিনুক তুলিতে এখানে বৎসরে তিন মাস ইহারা আসিয়া বাস করে। ইহাদের সামপান (নৌকা) কূলের অদূরে সমুদ্রে আমার নৌকা দেখিতে পায়। তারপর এখানে আনে। আমি চার-পাঁচ দিনের মধ্যে সুস্থ হইয়া উঠিলাম। সামুদ্রিক মাছের ঝোল আর ভাত, এ ছাড়া আর কোনো খাদ্য সেখানে ছিল না। আমাকে তাহারা সঙ্গে লইয়া আর একটা দ্বীপে গেল, দ্বীপের নাম কুমড়াকাটা। সেখানে পাশাপাশি অনেকগুলি দ্বীপ আছে, সবগুলিই জনহীন, মৎস্যশিকারিরা মাঝে মাঝে বসতি স্থাপন করে আবার চলিয়া যায়। একটা দ্বীপের নাম চাঁদডুবি, একটার নাম সাহাজাদখালি। সব দ্বীপেই ভীষণ জঙ্গল। মিষ্ট জলের খাঁড়ি কেবল চাঁদডুবি ছাড়া অন্য কোনো দ্বীপে নাই বলিয়া আমরা সেখানে নৌকা লাগাইয়া মিষ্ট জলের সন্ধানে গেলাম। ডাঙায় উঠিয়া বাঁ-দিকে ছোটো একটা বালিয়াড়ি, তাহার পিছনে ঘন জঙ্গল। জঙ্গলের গাছ আমি চিনিলাম না, শুধু কয়েক ঝাড় মূলী বাঁশ ছাড়া। এক-জাতীয় বড়ো গাছে রাঙা ফুল ফুটিয়াছিল। জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম ওই গাছের নাম ছাপলাস গাছ। জঙ্গলের মধ্যে ছাপলাস আর মূলী বাঁশই বেশি। এই দ্বীপের সমুদ্রতীরে বালুকারাশির উপর কত ঝিনুক ও শাঁখের ছড়াছড়ি, তাহার একটু দূরে ঘন সবুজ বনভূমি, লতার ঝোপে কত কী অজানা বনপুষ্প। চাঁদডুবি দ্বীপটি স্বর্গের মতো সুন্দর।
একা কতক্ষণ দ্বীপের বালির চড়ায় বসিয়া থাকি। সারাদিন এমনি বসিয়া বসিয়া নীল সমুদ্রের গান যদি শুনিতে পাই তবে কোথাও যাইতে চাই না। এমন সুন্দর নামটি কে রাখিয়াছিল এ দ্বীপের?
বনবেণুকুঞ্জের মধ্যে পাখি ডাকে। কেহ শুনিবার নাই সে-পাখির কলকূজন। যাহারা এখানে আসে, তাহারা মাছ ধরিতে ব্যস্ত। পাখির ডাক শুনিবার কান তাহাদের নাই।