নিবারণ বলিল–ভাই, আমাকে বাঁচাও।
আমরা বলিলাম–কেন, তুমিও তো গাছের ওপর—
আমার হাতে কী আছে, আমি নামব কেমন করে? ও যদি লাফ দিয়ে গাছে ওঠে।
কিছু ভয় নেই। চুপ করে থাকো। আহত বাঘ বড়ো ভয়ানক জানোয়ার।
সেই অবস্থায় রাত্রি নামিয়া আসিল। ভয়ে আমরা কেহ গাছ হইতে নামিতে সাহস করিলাম না। আহত বাঘটা হয়তো ওঁত পাতিয়া আছে টাইগার ফার্নের জঙ্গলে, কে জানে? নামিলেই লাফ দিয়া ঘাড়ের উপর পড়িবে। আকাশে নক্ষত্র উঠিল। সমুদ্রের তীর হইতে হাওয়া বহিতে লাগিল। সমুদ্রে ঢেউয়ে আলো জ্বলে, রাশি রাশি জোনাকি জ্বলে প্রত্যেক ঢেউয়ের উলটোনো পালটানোর খাঁজে খাঁজে। বাঃ রে!
মনু চেঁচাইয়া বলিল–নিবারণ! ঘুমিয়ে পড়ো না। পড়ে যাবে একেবারে, বাঘের মুখে—
নিবারণ বলিল–খিদে পেয়েছে, পেট জ্বলছে খিদেতে।
চুপ করে থাকো।
আমি বলিলাম–নক্ষত্র দেখো। মনু ও আমি দু-জনেই হাসিয়া উঠি।
৩. শিশির-ভেজা
সকাল হইলে আমরা গাছ হইতে নামিয়া, শিশির-ভেজা তৃণক্ষেত্রের মধ্য দিয়া সমুদ্রতীরে আসিলাম, সেখানে বসিয়া বসিয়া সমুদ্রের শোভা দেখিলাম। পরে ডিঙিতে চড়িয়া বাড়ি ফিরি। আসিবার সময় নিবারণকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, সেই জিজ্ঞাসাটা আমার জীবনে একটা মস্ত বড়ো কাজ করিল। এখনও তাহা ভাবি। নিবারণকে বলিলাম–নিবারণ, আমাদের বাড়ি থেকে মগের ট্যাঁক কতদূর?
নিবারণ বলিল–কোশ খানেক।
আমি উহাকে কিছু বলি নাই, কিন্তু মনে ভাবি, এক ক্রোশ তো দূর, তবে মাঝে মাঝে একাই আসিব। সমুদ্রের এমন দৃশ্য–কোথায় পাইব এমন রূপ!
মনুর বাবা আজকাল আমার উপর খুব সন্তুষ্ট। কোথাও যাইতে-আসিতে আমার আর কোনো বাধা নাই। সেদিন ইহারা আমার মেজাজ বুঝিয়া লইয়াছেন। আমার সঙ্গে অনেক পরামর্শ করিয়াছেন, পুলিশের ভয় ক্রমেই বাড়িতেছে, সেদিন আর নাই। মনুকে লেখাপড়া শিখাইয়া আরাকানে সেগুন কাঠের ব্যাবসা করিয়া দিলে কেমন হয়। আমরা দুই ভাই সেই ব্যাবসা চালাইতে পারিব না? আমি বলিয়াছি–আমাকে ছাড়িয়া দিন, দেশের ছেলে দেশে ফিরিয়া যাই। মনুর বাবা না-ও বলেন না, হাঁ-ও বলেন না।
কিন্তু ও বিষয়ে পাকাপাকি স্থির করিল নিয়তি। তাহাই বলিতেছি। আমার সেদিনের উদারতার পুরস্কারস্বরূপ নিয়তি আমাকে হাত ধরিয়া চালাইল।
শরৎকাল তখন শেষ হইয়া আসিতেছিল। এই সময় মগের ট্যাঁকে তৃণভূমি জাগিয়া উঠে। নতুন তৃণভূমিতে হরিণের দল আসে। তাহা ছাড়া আছে সেই নীলসমুদ্রের মুক্তরূপ! একবার দুইবারে দেখায় সাধ কি মিটে!
একটি ডিঙি বাহিয়া চলিলাম–দুপুরের পর। আমি একা কখনো এ পথে আসি নাই। একটা খাঁড়ির মধ্যে ডিঙি ঢুকাইয়া ভাবিলাম সামনের খাল দিয়া বাহির হইব। অমন অনেক খাঁড়ি এদিক-ওদিকে গোলপাতার ও গরান জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে। মন অন্যমনস্ক ছিল, হঠাৎ মনে হইল এ কোথায় আসিলাম? আমার বাঁ-পাশে অগণিত হেঁতালঝোঁপ ও টাইগার ফার্নের জঙ্গল। হেঁতাল গাছ দেখিতে সরু খেজুর গাছের মতো, অমনি কাঁটাওয়ালা ঝাঁকড়ামাথা গাছ। তবে অত লম্বা বা মোটা হয় না। হেঁতাল ও টাইগার ফার্ন যেখানে থাকে, বাঘের ভয় সেখানে বেশি, তাহা জানিতাম। ডিঙি ভিড়াইবার ভরসা হয় না এমন জনহীন পাড়ে। কোথা হইতে বাঘ আসিয়া ঘাড়ে পড়িবে ঠিক কী?
অনেক দূর বাহিয়া আসিয়া দেখি মস্ত বড়ো একটি নদীর মোহানার সামনে পড়িয়াছি। এটা কোন জায়গা ঠিক বুঝিতে পারিলাম না। যদি পশোর ও শিবসার মিলনস্থল হয়, তবে তো অনেকদূর আসিয়া পড়িলাম। মগের ট্যাঁকে যাইতে হইলে বাঁ-দিকের ডাঙার কূলে যাই না কেন? তবে নিশ্চয় বাহির-সমুদ্রের মুখে পড়িব। খানিকটা গিয়া দেখি, আর একটা বড়ো নদী আসিয়া মোহানাতে পড়িতেছে। এ আবার কোন নদী?
মাথা ঠিক রাখিতে পারিলাম না তারপর হইতে। পদে পদে বিচারে ভুল হইতে লাগিল। কোথা হইতে কোথায় যাইতেছি–কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না কেন? একটা লোকও কি কোথাও নাই? হঠাৎ দেখিলাম সন্ধ্যা হইয়া আসিতেছে, ক্ষুধা পাইতেছে বিলক্ষণ। ফলের গাছের সন্ধানে চারিদিকে চাহিলাম। গোলগাছের ফল খাইতে ঠিক কচি তালের মতো, কিন্তু এ সময় একটাও চোখে পড়িল না। ভয় হইল, একা রাত্রে ডাঙায় নৌকা বাঁধিয়া থাকা নিরাপদ নয়, বাঘ ডিঙি হইতে আমাকে হালুম করিয়া একগাল মুড়ি-মুড়কির মতো মুখে করিয়া উধাও হইলেই মিটিয়া গেল!
অগত্যা নৌকা বাহিতে লাগিলাম। থামাইতে ভরসা হইল না। নদীরও কি শেষ নাই? রাত আন্দাজ চারিটার সময় অন্ধকারের মধ্যে দেখি আলো-জ্বলা-ঢেউ। আমার বৈঠার আলোড়নেও জলে জোনাকি জ্বলিতেছে। এইবার সমুদ্রে আসিয়া পড়িয়াছি। আমার সামনে অকূল বাহির সমুদ্র। আর আগাইবার রাস্তা নাই। ডিঙি লইয়া সমুদ্রের মধ্যে গেলেই মৃত্যু। দিক-দিশা তো এমনি হারাইয়া ফেলিয়াছি–ভালো করিয়াই হারাইব।
শেষরাত্রে চাঁদ উঠিলে দেখিলাম আমার পিছনের জঙ্গল খুব ঘন। এখানে ডিঙি বাঁধিতে ভরসা হয় না। কিন্তু উপায়ই বা কী? কী চমৎকার রূপ হইয়াছে সেই গভীর রাত্রে সেই ক্ষীণ চন্দ্রালোকিত অনন্ত সাগরের। দুই চক্ষু ভরিয়া দেখিয়াও ফুরায় না। অদ্ভুত স্থানটি বটে। পিছনের জঙ্গলে বাঘের গর্জন দু-একবার কানে গেল। ভোরের দিকে ভাটার সঙ্গে আর এক সমূহ বিপদ; ঢেউ উত্তাল হইয়া উঠিয়া কূলে যেভাবে আছড়াইয়া পড়িতে লাগিল, তাহাতে ডিঙি বাঁচানো এক মহাসমস্যা। এখনি তো ঢেউয়ের আছাড়ে চূর্ণবিচূর্ণ হইয়া যাইবে–ডিঙি সামলাইতে গিয়া ডুবিয়া মরিব শেষে?