আমাদের ছোটো গ্রামটি থেকে কিছু দূরে একটা জায়গা আছে, তার নাম মগের ট্যাঁক। এখানে আমরা হরিণ মারিতে আসিয়াছি–নিবারণ, মনু ও আমি। আমি কখনো এখানে আসি নাই, হরিণ মারিব বলিয়াও আসি নাই, আমি আসিয়াছি এজন্য যে এখানে সমুদ্রের শোভা দেখিতে পাইব। মগের ট্যাঁক একেবারে সমুদ্রের ধারে। ঘোলা জলের সমুদ্র নয়, নীল ঊর্মিমুখর বিশাল সমুদ্র মগের ট্যাঁকের ঘন সবুজ দীর্ঘ তৃণভূমির একেবারে নীচে। অনেক সময় জোয়ারের জল তৃণভূমি ছুঁইয়া থাকে।
একটা বড়ো কেওড়া গাছে উঠিয়া আমরা সকলে বসিয়া আছি। সামনে হাত-পঞ্চাশ দূরে অকূল সমুদ্র! গাছের উপর হইতে কী অদ্ভুত সে-দৃশ্য! বড়ো বড়ো ঢেউয়ের দল আছাড় খাইয়া পড়িতেছে মগের ট্যাঁকের নীচের বেলাভূমিতে। সাদা সাদা ফেনার ফুল ঢেউয়ের মাথায়।
মনু বলিল– কেমন মাছ ধরবার জায়গা!
তার চেয়েও ভালো এর চমৎকার দৃশ্য!
সে তো সব জায়গায় আছে। এমন মাছের জায়গা কিন্তু কোথাও নেই। আরাকান থেকে মগ জেলেরা এসে এখানে আগে আগে মাছ ধরত। তাই এর নাম মগের ট্যাঁক। গোলপাতার ঘর বানিয়ে এখানে দু-তিন মাস বাস করত। মাছও যা ধরত–
ভুল করছ মনু-চমৎকার দৃশ্য সব জায়গায় নেই। এদিকে চেয়ে দেখো–এমন আকাশ, এমন নীল রং–
আমি তো কিছু দেখতে পাই না—
খুব দেখতে পাও। দেখার চেষ্টা করলে দেখতে পাবে–দেখতে শেখো।
এমন সময় আর একটি নতুন দৃশ্য আমাদের চোখে পড়িল। একপাল হরিণ অদূরের জঙ্গল হইতে বাহির হইয়া তৃণক্ষেত্রের মধ্যে সঁড়িপথ দিয়া এদিকেই আসিতেছে। সরু পথ সুতরাং হরিণগুলো একটির পিছনে আর একটি–দীর্ঘ সারি একটি। পথও আঁকাবাঁকা, হরিণের দীর্ঘ সারির গতিও আঁকাবাঁকা। সবসুদ্ধ মিলিয়া একটি ছবি। মনু আমার দিকে চাহিল। তাহার হাতে বন্দুক। আমি ইশারায় বারণ করিলাম। এমন সুন্দর মনোরম হরিণের সারি কি বন্দুকের গুলির নিষ্ঠুর আঘাতে ভাঙিয়া দেওয়া যায়? সেটা মানুষের কাজ কি?
মনু না বুঝিয়া আমায় চুপি চুপি বলিল–তুমি গুলি করবে?
না।
তবে আমি মারি?
না, চুপ করে থাকো। শুধু দেখে যাও।
মনু আগের মতো আর নাই; নতুবা আমার কথা শুনিত না। সে মগ ডাকাতের ছেলে, বোঝে লুঠপাট, রক্তপাত। আমার সঙ্গে মিশিয়া সে বুঝিতেছে, নিষ্ঠুর রক্তপাতই জীবনের শেষ কথা নয়। দয়া বলিয়া জিনিস আছে, সৌন্দর্য বলিয়া জিনিস আছে। সবটা বুঝিতে পারে না, তবুও বুঝিতে চেষ্টা করে। হরিণের দল সমুদ্রের ধারে গিয়া দাঁড়াইল–মগের ট্যাঁকে নির্জন তটে, তট যেখানে সমুদ্রে ঢুকিয়াছে। সম্মুখে নীল সমুদ্র, তাহার তটে নির্জন তৃণভূমিতে বিচরণরত একদল হরিণ–ইহার মতো সুন্দর ছবি জীবনে দেখি নাই। বন্দুকের বেখাপ্পা আওয়াজ করিয়া সে-ছবি নষ্ট করিতে দিব না।
নিবারণ শিস দিল। শিসের শব্দে হরিণগুলি চমকিয়া এদিক-ওদিক চাহিতে লাগিল।
নিবারণ বলিল–মারো, মারো, এইবার মারো–
মনু বলিল–অঃ, সব পালাল!
আমি বলিলাম–এমন ছবিটা ভেঙে দিলে নিবারণ?
নিবারণ গাছ হইতে লাফাইয়া হরিণের দলের পিছু পিছু ছুটিল। হরিণেরা প্রাণের ভয়ে তৃণভূমিতে ইতস্তত বিশৃঙ্খলভাবে ছড়াইয়া পড়িয়াছে। সেই-বা কী সুন্দর ছবি। সবগুলি ঢুকিয়া পড়িল বনের মধ্যে এবং অদৃশ্য হইয়া গেল চক্ষের পলকে। নিবারণ উহাদের সঙ্গে বনের মধ্যে ঢুকিল।
মনু বলিল–ও কী দিয়ে হরিণ মারবে?
কী জানি!
আমরা সেই তৃণক্ষেত্রে দাঁড়াইয়া সমুদ্র দেখিতেছি; মিনিট দশেক কাটিয়া গিয়াছে, এমন সময়ে জঙ্গলের মধ্যে নিবারণের আর্ত চিৎকার শুনিয়া দু-জনেই জঙ্গলের দিকে ছুটিলাম। আমায় মনে হইল গাছের উপর হইতে স্বরটি আসিয়াছে। মনুকে সাবধান করিয়া দিলাম– অজানা জঙ্গলে এভাবে না ছুটিয়া পথ দেখিয়া চলো। খানিকটা গিয়া দেখি নিবারণ একটা কেওড়া গাছের উপর বসিয়া পরিত্রাহি চিৎকার করিতেছে। কেন সে চিৎকার করিতেছে কিছু বুঝিলাম না। মনুকে আবার সাবধান করিয়া দিলাম।
মনু বলিল–কী নিবারণ?
নিবারণ হাত নাড়িয়া বলিল–এসো না, এসো না হোদো গাছের তলায় বাঘ–হরিণের দল তাড়া করেছিল। আমার গাছের তলায় বাঘ দাঁড়িয়ে আছে, তোমরা উঠে পড়ো।
উহার গাছের তলায় বড়ো বড়ো হোদো গাছের জঙ্গল। হোদো জঙ্গলে বাঘ লুকাইয়া থাকিলে বাহির হইতে বোঝা যায় না। হোদো কাছের পাতা বিদ্যাপাতার মতো, তবে চার হাত পর্যন্ত লম্বা হয়। এগুলিকে ইংরেজিতে টাইগার ফার্ন বলে, তাহা পরে জানিয়াছিলাম। মনু আমার হাত ধরিয়া নিকটের গাছে উঠিতে যাইবে, এমন সময় হোদো জঙ্গল দুলাইয়া বাঘ নিঃশব্দে এক লাফ দিয়া, মনু পূর্বে যেখানে দাঁড়াইয়াছিল, সেখানে আসিয়া পড়িল। অর্থাৎ মনু আমাকে লইয়া না সরিলে সেই ভীষণ বাঘটা অব্যর্থ লক্ষ্যে তাহাকে ও আমাকে পিষিয়া দিত। বাঘে খাওয়া কিংবা আঁচড়ানো কামড়ানো পরের কথা–সাত-আট মণ ওজনের একটা বাঘের তীব্র লাফের পূর্ণ ঝাঁপটেই তো আমাদের প্রাণ বাহির হইয়া যাইতে পারে!
মনু সঙ্গেসঙ্গে বন্দুক তুলিয়া গুলি করিল। গুলি খাইয়া বাঘ আর একটা লাফ মারিল। যেখানে আমরা দাঁড়াইয়াছিলাম। মনু গুলি করিয়া বাঁ-দিকে লাফ দিয়া সরিয়া গিয়াছে। বাঘ এবার আর এক লাফ মারিল কিন্তু আমাদের দিকে নয়–সেই টাইগার ফার্নের জঙ্গলের মধ্যে।
ততক্ষণ আমি আর মনু গাছের উপর ঠেলিয়া উঠিয়াছি।