আমরা বজরা হইতে বাহির হইয়া দেখিলাম, বহু নিষ্কর্মা লোক এবং ভিক্ষুক বজরার কাছে জড়ো হইয়াছে। যাহা হউক, আমরা তীরে উঠিলাম। দাদামহাশয় একজন বিশ্বস্ত লোকের হাতে আমার ভার দিয়া নিজে তীর্থকার্য করিতে গেলেন। আমি সেই লোকটির সঙ্গে ঘুরিয়া ঘুরিয়া মেলা দেখিয়া বেড়াইতে লাগিলাম।
দাদামহাশয় সমস্ত দিন তাঁহার নিজের কাজ লইয়া থাকিতেন, আমি কী করিতাম না করিতাম তাহা দেখিবার তাঁহার অবসর ছিল না। আমি সমস্ত দিন মেলায় ঘুরিয়া বেড়াইতাম। মেলায় যে কেবল ঘুরিয়া বেড়াইতাম, তাহা নয়। দাদামহাশয়ের হুকুম ছিল, আমি যখন যাহা চাহিব, তখনই তাহা দিতে হইবে। সুতরাং, আমার খুব মজা। আমি নাগরদোলায় চড়িতাম, যাহা খুশি কিনিতাম–তিন দিন কী আনন্দেই না কাটাইয়াছিলাম! কেবল সেই তিন দিনের মধ্যে মেলায় যে-সমস্ত জিনিস আসিয়াছিল, এটা-ওটা করিয়া তাহার প্রায় সমস্ত জিনিসের অন্তত এক-একটি করিয়া আমি সংগ্রহ করিয়া লইলাম।
আমার চলাফেরা এবং ভাবগতিক দেখিয়া সকল লোকই আমাকে লক্ষ করিত এবং অনেক নিষ্কর্মা লোক আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরিত। আমরা যেদিন সেখানে পৌঁছিলাম, তাহার পরদিন হইতে দেখিলাম, মগের মতো চেহারা একটা লোক, প্রায় সমস্ত দিনই আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরিল। কিন্তু সে-লোকটি অন্যান্য লোকের মতো আমাদের কাছে কাছে বড়ো থাকে নাই এবং কোনো কথাও আমাদিগকে জিজ্ঞাসা করে নাই, দূরে দূরে থাকিয়া আমাদিগকে লক্ষ করিতেছিল। পরদিন আমরা মেলায় গিয়া সে-লোকটাকে আর দেখিতে পাইলাম না। কিন্তু একটি মগ বালক সেদিন আমার সঙ্গ লইল। সে ছিল আমার সমবয়সি। সুতরাং, অতি অল্পকাল মধ্যেই তাহার সহিত আমার বেশ ভাব হইয়া গেল। মেলায় বেড়াইতে সে সেই স্থানের অনেক বিবরণ আমাকে দিল, অনেক গল্প করিল এবং আমাদের বাড়িঘরের কথাও জিজ্ঞাসা করিল। ছেলেটিকে আমি মেলা হইতে কয়েকটা জিনিস কিনিয়া দিলাম এবং সন্ধ্যার সময় বজরায় ফিরিলাম। মনে পড়ে ছেলেটি আমার সঙ্গে সঙ্গে বজরা পর্যন্ত আসিয়াছিল; আমি বজরায় উঠিলে সে ফিরিয়া যায়। এই মগ বালকটির উপর আমার কেমন একটু মায়া হইয়াছিল, আমি বজরার ভিতরে যাইয়া, সে চলিয়া গিয়াছে কিনা দেখিবার জন্য তীরের দিকে চাহিলাম। চাহিয়া দেখি, সেই বালকটি তীরের কিছু দূরে পূর্বদিনের সেই লোকটার সঙ্গে দাঁড়াইয়া কী যেন কথা কহিতেছে। মগ বালকটির উপর সেদিন আমার যেমন একটু মায়া হইয়াছিল, সেই লোকটার প্রতি তেমনি পূর্বদিন আমার কেমন একটা বিরক্তি জন্মিয়াছিল। তাই সেই মগ বালককে লোকটার সহিত কথা কহিতে দেখিয়া আমার কেমন যেন ভালো বোধ হইল না।
যাহা হউক পরদিন প্রাতঃকালে আমাদের বাড়ি ফিরিবার কথা; সুতরাং তাহার বন্দোবস্ত হইতে লাগিল। দাদামহাশয় সন্ধ্যার সময় আসিয়া বলিয়া গেলেন যে, তিনি সমস্ত রাত্রি কপিল মুনির মন্দিরে বসিয়া জপ-তপ করিবেন, ভোরে বজরায় ফিরিয়া আসিবেন এবং তখনই বজরা খোলা হইবে।
সন্ধ্যার পরেই আমাদের খাওয়া শেষ হইল এবং সমস্ত দিনের ক্লান্তির পর অল্পকাল মধ্যেই আমি ঘুমাইয়া পড়িলাম।
কতক্ষণ ঘুমাইয়াছিলাম জানি না। হঠাৎ কী একটা শব্দে আমার ঘুম ভাঙিয়া গেল। অন্ধকারে জাগিয়া অকারণেই কেমন যেন একটু ভয় ভয় করিতে লাগিল। রাত্রি প্রভাত হইয়াছে কিনা দেখিবার জন্য আমি বজরার এক ধারের জানালা তুলিয়া তীরের দিকে চাহিলাম, কিন্তু এ কী, তীর কোথায়! চাহিয়া দেখিলাম, যত দূর দৃষ্টি যায়, কেবল জল! নদীর দিকের জানালাটা খুলিয়াছি মনে করিয়া, ফিরিয়া গিয়া অন্য দিকের জানালাটা খুলিলাম; দেখিলাম,–সেদিকেও তাহাই, চারিদিকেই জল, কূলকিনারা নাই। বড়ো ভয় হইল। আমার যিনি অভিভাবক ছিলেন তাঁহাকে ডাকিলাম এবং তিনি উঠিলে তাঁহাকে সমস্ত বলিলাম। তিনি আমার কথা শুনিয়া বাহিরে গেলেন, গিয়া দেখিলেন–সত্যসত্যই বজরা আর তীরের কাছে বাঁধা নাই, অকূল সমুদ্রে ভাসিয়া চলিয়াছে। তিনি তৎক্ষণাৎ মাঝিদিগকে ডাকিয়া তুলিলেন। তিনি মনে করিয়াছিলেন বুঝি কোনো প্রকারে বজরার বাঁধন খুলিয়া গিয়াছে এবং সেইজন্য বজরা স্রোতে ভাসিয়া চলিয়াছে। মাঝিরা তাড়াতাড়ি উঠিল এবং উঠিয়া যাহা দেখিল তাহাতে একটু ভীত হইল। একজন মাঝি তাড়াতাড়ি হালের দিকে যাইবে, এমন সময় হালের নিকট হইতে কে অতি কর্কশ কণ্ঠে কহিল, খবরদার, কেউ এক পা নড়েছ কী মরেছ?
মাঝি চাহিয়া দেখিল, হালের কাছে তিনজন লোক তলোয়ার হাতে দাঁড়াইয়া আছে! ওদিকে বজরার সম্মুখের দিকে ছয়-সাতজন লোক নিঃশব্দে বসিয়াছিল, তাহারাও এই কথায় উঠিয়া দাঁড়াইল। রাত্রির ক্ষীণ আলোকে আমি নৌকার ভিতর হইতে দেখিলাম, তাহাদের প্রত্যেকের হাতেই তলোয়ার রহিয়াছে। আমার অভিভাবক তাড়াতাড়ি আমার কাছে আসিয়া বলিলেন, সর্বনাশ হয়েছে, আমরা আরাকানী দস্যুদের হাতে পড়েছি।
ডাকাতের হাতে পড়িয়াছি শুনিয়া আমার সর্বাঙ্গ হিম হইয়া গেল। আমি আর কথা কহিতে পারিলাম না। বজরায় আমাদের সঙ্গে দুইজন বরকন্দাজ ছিল। তাহারাও ঘুমাইতেছিল। গোলমালে ঘুম ভাঙিয়া যাওয়াতে, কোন হ্যায়রে, কোন হ্যায়রে–বলিতে বলিতে তাহারাও উঠিল। উঠিয়া যাহা দেখিল, তাহাতে মুহূর্তের জন্য তাহারাও একটু থতমতো খাইয়া গেল। কিন্তু সে মুহূর্ত মাত্র, পরমুহূর্তে তাহারা তলোয়ার খুলিয়া বজরার দরজা চাপিয়া দুইজনে দাঁড়াইয়া বলিল, খবরদার, এদিকে এসো না, যতক্ষণ হাতে তলোয়ার আছে, ততক্ষণ কারো সাধ্যি নেই যে মনিবের চুলটিও স্পর্শ করে। আমাদের নৌকায় ছয়জন মাঝি, দুইজন বরকন্দাজ, দুইজন চাকর, আমার অভিভাবক ও আমি। এদিকে ডাকাতেরা প্রায় সাত আটজন। বরকন্দাজের কথা শুনিয়া একজন ডাকাত হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল, অকূল সমুদ্রে রাত্রির নিস্তব্ধতার মধ্যে সেই বিকট হাসি আকাশে প্রতিধ্বনিত হইল; সে-হাসিতে আমার বুকের রক্ত যেন শুকাইয়া গেল। পরমুহূর্তেই অস্ত্রের ঝনঝনা আমার কানে গেল। চাহিয়া দেখি, উভয় পক্ষে ঘোর যুদ্ধ আরম্ভ হইয়াছে। দেখিতে দেখিতে বরকন্দাজদের তলোয়ারের আঘাতে দুইজন দস্যু জলের মধ্যে পড়িয়া গেল। কিন্তু পরমুহূর্তেই আমাদের একজন বরকন্দাজও দস্যুদের হাতে প্রাণ হারাইল। আমি ভয়ে একেবারে আড়ষ্ট হইয়া গিয়াছিলাম, তারপর আবার এই ভয়ানক দৃশ্য চোখের উপর দেখিয়া আমার চক্ষু আপনি মুদ্রিত হইয়া আসিল। ক্রমে যেন চেতনা হারাইলাম। তারপর কী হইল, তাহা আর কিছুই জানিতে পারিলাম না।