আমি চুপ করিয়া রহিলাম। এ জীবন বেশ লাগিতেছিল। বদ্ধ জীবনের চেয়ে অনেক ভালো। দিনে দিনে এ জীবনকে আমি ভালোবাসিয়াছি। কেবল ভাবি, মা কেমন আছেন, কীভাবে আছেন! সেদিন বসিয়া অনেক কিছু ভাবিলাম। বাড়ি তো যাইবই, কিন্তু এ জীবনের সঙ্গে বন্ধন ছিন্ন হইয়া যাইব–আর এখানে ফিরিতে পারিব না, আর এ জীবনে ফিরিতে পারিব না। তার চেয়ে আর কিছুদিন থাকিয়া যাই। মনুর উপর একটা মায়া পড়িয়াছে, হঠাৎ ছাড়িয়া গেলে সে তো কষ্ট পাইবে।
মনুকে লইয়া বিকালে বাহির হইলাম। এক জায়গায় একটা গাছের গুঁড়ির মধ্যে কী পাখি
বাসা বাঁধিয়াছিল, মনু আমাকে দেখাইতে লইয়া গেল।
আমি বলিলাম–ওর মধ্যে হাত দিও না যেন, সাপ থাকে।
সে আর আমাকে শিখিয়ে দিতে হবে না। মনে নেই সেই সাপের কথা!
মনে নেই আবার?
কথা শেষ হইতে-না-হইতে মস্ত বড়ো একটা গোখুরা সাপ গাছের খোড়লের ভিতর হইতে ফোঁস করিয়া উঠিল। মনু অমনি সাপটার গলা চাপিয়া ধরিল ডান হাতে। সাপটা তাহার হাতে পেঁচ দিয়া জড়াইতে লাগিল। সে এক ভয়ানক দৃশ্য হইল দেখিতে। আমি তাড়াতাড়ি হাতের দা দিয়া সাপটাকে খানিকটা কাটিয়া ফেলিলাম–তাহাতে সে এমন জোর করিতে লাগিল যে মনু তাহার মুখ আর চাপিয়া রাখিতে পারে না। মনুর হাতের উপর আমিও জোর করিয়া চাপিয়া ধরিলাম। ইতিমধ্যে বিপদের উপর বিপদ– কোথা হইতে আর একটা সাপ দেখি আমাদের দুজনের মাথার উপর দুলিতেছে। ডালে তাহার ল্যাজ আটকানো। আমি চিৎকার করিয়া উঠিলাম। কিন্তু সাপটা আমার কাছেও আসিল না, ক্রমে দূরে সরিয়া যাইতে লাগিল এবং থুতুর মতো জিনিস আমাদের দিকে জোরে ফেলিতে লাগিল।
মনু বলিল–সাবধান! চোখ ঢাকো–চোখ ঢাকো–চোখ অন্ধ হয়ে যাবে—
আমি চোখ ঢাকিলে মনু মারা পড়ে, মনুও চোখ ঢাকিতে পারে না। চোখ অন্য দিকে ফিরাইয়া যতদূর সম্ভব চোখ বাঁচাইতেছি–মনুকে বলিলাম–খুব সাবধান, চোখ সাবধান–
সাপের থুতু লাগিতেছে আমার ঘাড়ে, মাথার চুলে, কানের পাশে। চোখ ভয়ে চাহিতে পারিতেছি না, মনুরও নিশ্চয় সেই অবস্থা। মিনিট দশ বারো এই অবস্থায় কাটিল, সাপের থুতু-বৃষ্টি আর থামে না। চাহিয়া দেখিতে ভরসা পাইতেছি না, সাপটা আমাদের কাছে আসিতেছে না দূরে যাইতেছে।
আমাদেরও সেখান হইতে চলিয়া যাইবার কোনো উপায় নাই। সাপটা একটা কেয়াঝোঁপের মধ্যে–যে জায়গাটুকু ফাঁক, সেখানেই ওই সাপটা থুতু ছুড়িতেছে। কেয়াকাঁটার মধ্যে হাতে সাপ জড়ানো অবস্থাতেই শেষে সন্তর্পণে ঢুকিয়া গেলাম দু-জনে। হাত-পা কাঁটায় ছড়িয়া গিয়া রক্তপাত হইতে লাগিল। সেই কেয়াবনের মধ্যে দাঁড়াইয়া আমি সন্তর্পণে সাপটাকে প্যাঁচাইয়া কাটিয়া তিনটুকরা করিলাম–শোল কিংবা ল্যাটা মাছের মতো। রক্তে মনুর কাপড় ভাসিয়া গেল। মরা সাপটাকে হাত হইতে খুলিয়া ফেলিয়া সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফিরি।
রাত্রে কিন্তু ভাত খাইয়া মনু আমাকে বলিল–আবার সেই গাছের খোড়লে যেতে হবে এখন!
আমি আশ্চর্য হইয়া বলিলাম– কেন?
আছে মজা।
কী শুনি না? একবার বিপদে পড়ে আশ মেটেনি?
তা নয়। আমি ওখানে বিনা কারণে তখন যাইনি।
কী কারণে বলো। সেবার তো প্রাণ যেতে বসেছিল।
ওখানে সাপের মণি আছে।
কী সাপ?
সে আমি কী জানি, চলো দেখাবো।
সত্যই সাপের মণি আছে। আমি কখনো শুনিনি। মনু আমাকে সে অন্ধকার-রাত্রে বনের মধ্যে কেয়াগাছের কাঁটার পাশে লইয়া গিয়া দাঁড় করাইল। দু-জনে তারপর সেই গাছটার ডালে উঠিয়া বসিলাম।
আমি বললাম–মণি কই? গাছে উঠলে কেন?
সাপ আমাদের গাছের তলা দিয়ে যাবে একটু পরে।
কী সাপ?
গোখুরা বা অজগর। নিজের চোখেই দেখো।
কিছুক্ষণ পরে ঘোর অন্ধকারে আমাদের গাছের নীচে একটা জোনাকির মতো কী জিনিস চলিয়া-ফিরিয়া বেড়াইতে লাগিল। স্নিগ্ধ স্থির আলো, জোনাকির মতো একবার জ্বলিয়া আবার নিবিয়া যায় না। মনু বলিল–দেখেছ?
অই নাকি?
অই তো! তোমার কী মনে হয়?
বুঝতে পারছি না।
জিনিসটা অনেকক্ষণ নড়িয়া বেড়াইল। তারপরে আমাদের গাছটার ঠিক নীচে আসিয়া স্থির হইয়া রহিল। কী জিনিস কিছুই বুঝিলাম না।
মনু বলিল– সেই সাপটা!
কোনটা?
যেটা থুতু ফেলেছিল?
তুমি কী করে জানলে?
আমি অনেক দিন থেকে দেখছি।
মনি কী করে নেবে?
এক তাল গোবর ওর ওপর চাপা দিতে হবে। একটু পরে মণি নাবিয়ে রেখে সাপটা পোকামাকড় খুঁজবে, সেই সময়।
কিন্তু সে-সুযোগ সাপটা আমাদের দিল না! খানিকটা এদিক-ওদিক নড়িয়া-চড়িয়া সেটা চলিয়া গেল। আমরা আবার পরদিন সন্ধ্যার পর সেখানে গেলাম। সেদিনও সাপ আসিল বটে কিন্তু মণি নামাইতে তাহাকে দেখিলাম না। সে-রাত্রে আর কিছু হইল না, পরের রাত্রেও সেরকম গেল।
আরও দু-দিন কাটিল! মনু বল্লম লইয়া গিয়াছিল সেরাত্রে। বল্লম তুলিয়া মারিতে গেলে আমি উহার হাত ধরিয়া বারণ করিলাম। সাপের মণি আছে কিনা জানি না, কিন্তু শুনিয়াছি এভাবে মণি সংগ্রহ করিলে অমঙ্গল হয়। মনু ও আমি ফিরিয়া আসিলাম। দিনদশেক পরে মনু একটি মরা সাপ আমাকে দেখাইল। তাহার মাথার উপর একটা সাদা আঁশ। মনু বলল–এই দেখো মণি, কাল রাতে একা গিয়ে সাপটাকে মারি। আলো তখুনি নিবে গেল। বুড়ো সাপের মাথায় এইরকম আঁশ হয়, রাত্রে জ্বলে। একেই বলে সাপের মণি। সব সাপের হয় না, কোনো কোনো সাপ বুড়ো হয়ে গেলে এই আঁশ গজায়।