মনু বলিল–বাবা, আপনারা যা করেছেন, তা করেছেন। কাল বদলাচ্ছে না? ভেবে দেখুন, আগে যা করেছেন, তা এখন আর করতে পারেন কি?
এই পর্যন্ত কথা হইয়াছে, এমন সময় জঙ্গলের ওধারে হুইসিল শোনা গেল এবং সঙ্গেসঙ্গে একবার বন্দুকের আওয়াজ হইল। আমরা জঙ্গলের দিকে ছুটিয়া যাইতেছি, এমন সময় জনাচারেক পুলিশের পোশাক পরা লোককে অদূরে দেখিতে পাইলাম। ইহারা সকলেই বাঙালি, দেখিয়াই মনে হইল।
একজন আমাদের দিকে ছুটিয়া আসিল। চাহিয়া দেখিলাম, মনুর বাবার মুখ শুকাইয়া গিয়াছে। তিনি বেশ বুঝিয়াছেন, এবার আর কোনো উপায় নাই। পুলিশ কি তাঁহার সন্ধানে আসিল। পরক্ষণেই দেখা গেল তাহা নহে, পুলিশ ইহারা নয়, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোক। আমাদের বলিল– কে?
মনুর বাবা বলিলেন–যাত্রী।
কীসের?
পুজো দিতে এসেছি ঠাকুরের কাছে।
কীসের ঘর এ?
বনবিবির দরগাঘর।
তুমি তো দেখছি মগ, কী নাম, কী করো?
আমার নাম টুং পে নু। আমি মাছ-ধরা-জেলে, এরা সব আমার লোক।
কোথায় মাছ ধর?
পশোর নদীর মধ্যে আর খালে।
মাছ-ধরা পাশ আছে? দেখাও!
এখানে তো মাছ ধরতে আসিনি হুজুর। দরগাতলায় পুজো দিতে এসেছি।
খবরদার গাছ কাটবে না।
না না, সে কী কথা! গাছ কাটব কেন?
তাহাদের মধ্যে একজন আমার দিকে অনেকক্ষণ হইতে চাহিয়াছিল, আমার কাছে আসিয়া বলিল– এ কে?
মনুর বাবা বলিলেন–আমার এখানে কাজ করে।
এ তো দেখছি বাঙালি।
ওর কেউ নেই। অনেকদিন থেকে আমার কাছে আছে।
তোমার নাম কী ছোকরা?
আমার বুকের ভেতর ঢিপ ঢিপ করিতেছে। চাহিয়া দেখি উহাদের সকলের মুখ সাদা হইয়া গিয়াছে। এমনকী মনুরও। এই তো আমার অবসর, এই সময় কেন বলি না আমার আসল কথা? উহারা দু-জন বন্দুকধারী লোক। উহাদের কাছে ইহারা কী করিবে? আমার মুক্তির এই তো শুভক্ষণ উপস্থিত!
মনুর দিকে চাহিয়া দেখিলাম। তাহার চোখ-মুখে কাতর প্রার্থনার আকুতি। মনুর বাবার মুখও শুকাইয়া গিয়াছে। উদবিগ্ন দৃষ্টি আমার মুখের দিকে নিবদ্ধ। ভগবান এবার কি সুবিচার করিয়াছেন, দয়া করিয়া কি শুভক্ষণ জুটাইয়া দিয়াছেন? একবার মুখের কথা খসাই না কেন?
কিন্তু পরক্ষণেই ভাবিলাম, ইহাও এক প্রকারের বিশ্বাসঘাতকতা। মনুকে ভাই বলিয়া ডাকি, তাহার বাবাকে এরূপ হীনভাবে ধরাইয়া দিলে আমার ভালো হইবে বটে কিন্তু উহাদের সর্বনাশ হইবে। মনু কোনো অপরাধ করে নাই, সে তখন নিতান্ত বালক ছিল–বাবা যাহা করেন, সে কীভাবে তাহাতে বাধা দিতে পারিত?
এসব চিন্তাভাবনা চক্ষের নিমেষে মনের মধ্যে করিয়া ফেলিলাম। ভাবিবার সময় কই? বড়ো হইয়াছি, আগের চেয়ে অনেক কিছু বুঝি। পুলিশের লোকের মুখের দিকে চাহিয়া বলিলাম, আমার নাম নীলমণি রায়। আমি এদের এখানে কাজ করি? অনেক দিন আছি।
পুলিশের লোক বলিল– তোমার কেউ নেই?
ঢোক গিলিয়া বলিলাম–না।
আচ্ছা যাও, গাছ যেন কাটা না পড়ে।
উহারা সবাই একযোগে চলিয়া গেল।
মনুর বাবা আমার কাছে আসিয়া আমার দিকে খানিকক্ষণ চাহিয়া কী দেখিল, তারপর আমার পিঠ চাপড়াইয়া বলিল–সাবাশ ছেলে! বাহবা বাবা! মনু আমার হাত দু-খানা ব্যগ্রতার সহিত জড়াইয়া ধরিল। সঙ্গের দু-একজন লোক বলিল–ভালো বংশের ছেলে বটে, বাঃ।
মনুর বাবা আমার ও মনুর দিকে চাহিয়া বলিলেন– বোসো এখানে! আমি আজ বড়ো বিপদে পড়ে গিয়েছিলাম। গিয়েছিলাম একটা কাঁচা কাজ করবার জন্যে। এমন কাঁচা কাজ জীবনে কখনো করিনি। জীবনটি আজ চলে যেত। এই ছোকরা আজ আমাদের সকলের প্রাণ বাঁচিয়েছে। যে আমার বন্দি, তাকে নিয়ে দিনমানে কখনো এক বার হইনি, আজ তা বার হয়েছিলাম। নীলু বড়ো ভালো ছেলে, তাই আজ আমরা সবাই বেঁচে গেলাম। চলো আজ বাড়ি যাই, আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন–কী খেতে চাও বলো? বড়ো মাছ না খাসির মাংস? যা ইচ্ছে বলো!
আমার মনের মধ্যে একটি অপূর্বভাব আসিয়াছে তখন। খাওয়া অতি তুচ্ছ তাহার কাছে।
বলিলাম–যা হয় খাওয়াবেন, সেটা বড়ো কথা নয়। কিন্তু আমার দু-একটি কথা শুনবেন কি দয়া করে? মনুকে ভাইয়ের মতো দেখি, এ মুখের কথা নয়, তা তো দেখলেন!
মনুর বাবা ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন–না না, আগে বলো কী খাবে? বড়ো মাছ না খাসির মাংস?
খাসির মাংস।
বেশ, আমি এখুনি জোগাড় করে আনছি। তুমি আর মনু বাড়ি যাও। তোমাদের সঙ্গে কথা আছে।
আমাকে সন্ধ্যার পর মনুর বাবা তাঁহার কাছে ডাকিলেন। আমি কোনো কথা না বলিয়া চুপ করিয়া রহিলাম। মনুর বাবা বলিলেন– দেখো, আজ তোমার কাজে বড়ো সন্তুষ্ট হয়েছি। তুমি আমাদের আজ পুলিশে না ধরিয়ে দিয়ে একটা অদ্ভুত কাজ করেছ। তুমি যা খেতে চাও–অর্থাৎ খাসির মাংস, কাল সকালে তোমাকে খাওয়াব—
আমি মাথা নীচু করে বললাম–আমাকে মুক্তি দিন–
–সে তো তুমি আজ নিজের ইচ্ছেতে নাওনি! তোমাকে ছেড়ে দিতাম আজই, কিন্তু মনু তোমাকে বড়ো ভালোবাসে, তাই ভেবে পিছিয়ে যাচ্ছি। ওর লেখাপড়া যদি একটু হয়, তবে এ কাজ বন্ধ করে দেব। পুলিশ বড়ো পেছনে লেগে আছে, এ কাজ আর চলবে না।
আমাকে এখন কী করতে বলেন?
তোমাকে আমি ছেড়েই দিলাম। যেখানে খুশি যেও, ইচ্ছে হয় আমাকে বোলো। যা খেতে চাও তোমাকে খাওয়াব, কিন্তু একেবারে চলে যেও না। তুমি আমার ছেলের মতো। তুমি চলে গেলে তো আমাদের বড়ো কষ্ট হবে। মনুকে তুমি মানুষ করে দাও।