অবাক হইয়া মার মুখের দিকে চাহিয়া বলিলাম–হুঁ।
কোথায় দেখি?
এই যে হাঁটুতে।
আহা হা, কী সর্বনাশ!
তিনি আমার পাশে বসিয়া অনেক ভালো ভালো কথা বলিলেন। আমাকে কলা ও মুড়ির সব মোয়াগুলি খাওয়াইলেন, আমার নিজের মা আজ এখানে থাকিলে এরকমই করিতেন। এদিক-ওদিক চাহিয়া বলিলেন–তোমাকে বাড়ি পাঠাবার চেষ্টা করেছি অনেক, কিন্তু পেরে উঠছি না। এদের সবাই ভয় করে কিনা।
আমি বলিলাম–কী চেষ্টা করেছেন?
ডিঙি ভাড়া করে তোমাকে পাঠাবার চেষ্ট করেছি, কেউ যেতে চায় না।
দরকার নেই এখন। আপনার কোনো বিপদ হয় এ আমি চাই না।
কতদিন হল এনেছে তোমায়?
তিন বছর হয়ে গিয়েছে। তেরো বছর বয়সে এনেছিল, এখন আমার বয়েস ষোলো।
আহা-হা! কী করে আছেন তোমার মা? তোমার যেতে ইচ্ছে হয় তো?
অনেক সয়ে গিয়েছে মা। আপনাকেই মা বলে ডাকি।
তিনি হাসিয়া আমার মাথায় হাত দিয়া আদর করিলেন। আমার জন্যে আবার খাবার লইয়া আসিবেন বলিলেন। আমি কি খাইতে ভালোবাসি–মুড়ির মোয়া? মাছের তরকারি? উহারা মগ–মাছের তরকারি রান্নার কী জানে? তিনি ভালো ভাবে তরকারি রান্না করিয়া আমাকে খাওয়াইতে আসিবেন! মা চলিয়া গেলেন।
কতক্ষণ পর্যন্ত আমি একদৃষ্টে চাহিয়া রহিলাম সে-দিকে।
মনু একদিন আমায় বলিল–ভাই, তোমার সঙ্গে একটা পরামর্শ আছে। চলো নিবারণ আসবার আগে আজ আমরা ডিঙি নিয়ে বার হই।
পশোর নদীর মধ্যে পড়িয়া আমরা ধীরে ধীরে অনেক দূরে গেলাম। জঙ্গলের মধ্যে সেখানে একস্থানে ডিঙি বাঁধিয়া মনু আমায় গভীর জঙ্গলের মধ্যে লইয়া গেল। তখন গ্রীষ্মের শেষ, বর্ষা দেখা দিয়েছে। নাবাল জমি ডুবিতে শুরু হইয়াছে। মৌমাছির উপদ্রবে জঙ্গলে হাঁটা নিরাপদ নয়, কারণ এ সময় মৌমাছির ঝাঁক গৃহহারা হইয়া ঘুরিয়া বেড়ায়। বেতের টক ফল খাইতে খাইতে আমরা কত দূর গেলাম।
সেখানে জঙ্গলের মধ্যে একটা গোলপাতার ঘর দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া মনুকে জিজ্ঞাসা করিতেই সে বলিল–এখানে এসো, বসা যাক। এ আমাদের ঘর। তোমাকে আর আমাকে আজ এখানে আসবার কথা বাবা বলে দিয়েছে।
কেন?
আজ আমাদের বোম্বেটের কাজে ভরতি হতে হবে।
সে কী কথা।
তাই। এটা জলের ডাকাতদের ঠাকুরঘর। এখানে দীক্ষা হয়।
দীক্ষা?
ডাকাতদের কাজে ভরতি হবার আগে এখানে পুজো দিতে হয়। অনেক কিছু করতে হয়। তোমাদের কথায় তাকে দীক্ষা বলে তো, সেদিন বইয়ে পড়লে যে!
মনুকে ইতিমধ্যে আমি বই পড়াইয়াছি খানকতক, বাংলা বেশ ভালো শিখাইয়াছি। বিদ্যার গুণে উহার মন যে ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হইতেছে, এ আমি বুঝিয়াছি। হাজার হউক, আমাদের বয়স বাড়িয়াছে, অনেক কিছু বুঝি, অনেক কিছু ভাবি। মনুর বাবা এ সমস্ত তত পছন্দ করেন না, তাও জানি। মনুর অনুরোধে তিনি খুলনা হইতে বাংলা বই মাঝে মাঝে আনিয়া দিয়াছেন বটে, কিন্তু তাহাকে বলেন, বেশি বই পড়িয়া কি বাঙালি বনিয়া যাইবি নাকি? অত বই পড়ার মধ্যে কী আছে?
মনুর কথা শুনিয়া প্রমাদ গনিলাম। আমাকেও কি ডাকাত হইতে হইবে নাকি?
মনু বলিল–আমার অনুরোধে তোমাকে বিক্রি করা হয়নি। তোমার আমার ভাব দেখে বাবা ঠিক করেছেন আমাদের একসঙ্গে রাখবেন। নইলে আরাকানে কিংবা রেঙ্গুনে তোমাকে বিক্রি করা হত।
বল কী!
তাই।
এখন কী করবে ভাবছ?
তুমি যা বলবে তাই করব। ওই জন্যেই একটু আগে এখানে তোমাকে নিয়ে এলাম।
বেশি কথা বলিবার সময় পাওয়া গেল না। মনুর বাবা ও আরও কয়েকজন লোক একখানা ছিপে আসিয়া পড়িল। এই দস্যুদের আমি দেখিতে পারি না। মনুর বাবার মধ্যে মানুষের হৃদয় নাই জানি, থাকিলে আমায় এভাবে বন্দি করিয়া রাখিতে পারেন কি?
মনুর বাবা বলিলেন–সব তৈরি হয়ে নাও। আজ তোমাদের ভরতি হবার দিন। নেয়ে এসো নদীর জলে। মুরগি বলি দিয়ে আমরা কাজ আরম্ভ করব।
আমি বলিলাম–কী কাজ?
বললাম যে, আমাদের দলে তোমাদের ভরতি করে নেব আজ!
মনুকে নিন। আমি ডাকাতি করব না।
তোমার কথায় হবে?
দেখুন আপনি আমার বাবার মতো। মিথ্যে কথা বলব না আপনার সঙ্গে। আমি ভদ্রবংশের ছেলে, এ কাজ আমার নয়। আমার বয়েস হল সতেরো বছর, সব বুঝি।
ওসব চলবে না।
মানুষ খুন আমার দ্বারা হবে না। লুঠপাটও হবে না।
তোমাকে বিক্রি করে দেব, জান? কেনা চাকর হয়ে চীন দেশে গিয়ে থাকতে হবে।
যা হয় করুন। ডাকাতি আমার দ্বারা হবে না।
মনু বলিল–বাবা, আমারও এই মত।
মনুর বাবা ভয়ানক রাগিয়া গেলেন। আমাকে বলিলেন–তোমার সঙ্গে মিশে মনুও উচ্ছন্নে গিয়েছে তা আমি সন্দেহ করেছি আগে থেকেই। আজ শুধু তোমাদের পরীক্ষা করবার জন্যেই এখানে এনেছি, তা জান? কী করতে চাও তোমরা? কী করে খাবে এর পরে?
আমি আকাশের দিকে আঙুল দেখাইয়া বলিলাম–ওঁর ওপর নির্ভর করুন। তিনি যা করেন। পরের জিনিস লুঠ করে খেতে তিনি নিশ্চয় বলবেন না। আপনারও বয়েস হয়েছে, ভেবে দেখুন।
মনুর বাবা একে রাগিয়া ছিলেন, এবার আমার মুখে ভগবানের কথা শুনিয়া তেলেবেগুনে জ্বলিয়া আমাকে লাঠি তুলিয়া মারিতে আসিলেন। মনু গিয়া তাঁহার হাতের লাঠি ধরিয়া ফেলিল। তাঁহার সঙ্গের লোকেরাও বাধা দিল। উহাদের মধ্যে একজন বলিল–এরা যা বলছে ভেবে দেখুন সর্দারজি। ডাকাতি করা চলবে না। দু-খানা পুলিশ লঞ্চ সর্বদা ঘুরছে শুধু এক পশোর নদীতে। ফরেস্ট বিভাগের লোকও আজকাল খুব সতর্ক।