এসব এক মিনিটের মধ্যে ঘটিয়া গেল। পরের মিনিটে মনে হইল, আমি একটা অন্ধকার অতলস্পর্শ গুহার দিকে চলিয়াছি। গুহাটা ক্রমশ বড়ো হইতেছে, ক্রমশ আমাকে গিলিয়া খাইতে আসিতেছে।
অনেক লোক মিলিয়া কোথায় যেন চিৎকার করিতেছে শুনিলাম। তারপর আমি নিজের চেষ্টায় গুহা হইতে জোর করিয়া মাথা উঠাইয়া আবার দেখি সামনে বিস্তৃত পোের নদী, ওপারের সবুজ গোলগাছ ও হেঁতালঝোঁপের সারি। অস্পষ্ট দেখাইতেছে দূরের তটরেখা। নদীর বুকে রৌদ্র চিকচিক করিতেছে।
কে একজন বলিয়া উঠিল কানে গেল–বেঁচে আছে! বেঁচে আছে।
আমি আশ্চর্য হইয়া ভাবিলাম– কে বাঁচিয়া আছে, কাহার কথা বলিতেছে ডিঙির লোকেরা?
অমনি আবার বুঝিলাম মাছটা আমাকে একটা প্রবল ডানার ঝাঁপটা মারিয়া অবশ করিয়া ফেলিবার চেষ্টা করিল। আমার হাঁটু তখন মুক্ত, যে কারণে হউক, মাছটা আমাকে ছাড়িয়া দিয়াছে। এবার কামড়াইবার পূর্বেই আমাকে ডিঙিতে উঠিতেই হইবে। জলের জানোয়ার জলে বাঘের মতো শক্তি ধরে। আমি সেখানে অসহায়। এবার আমাকে ডুবাইয়া মারিবে।
আমি সাঁতার দিয়া ডিঙির দিকে আসিবার চেষ্টা করিতেই আর একটা ভীষণ ডানার ঝাঁপটা খাইলাম। এবারের ঝাঁপটায় আমার সারাদেহ যেন অবশ হইয়া গেল। আমি দুই-পা জলের উপর ভাসাইয়া জল ঠেলিয়া ডিঙির কাছে আসিতে চেষ্টা করিলাম।
অনেকগুলি হাত একসঙ্গে আমাকে টানিয়া ডিঙির উপর তুলিয়া লইল। ডিঙির উপর উঠিতেই আমি হাঁটুর নীচে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করিলাম। এতক্ষণ যন্ত্রণা বুঝিতে পারি নাই। হাঁটুর নীচে চাহিয়া দেখি, রক্তে সে জায়গাটা লাল হইয়া গিয়াছে।
নিবারণ বলিল–এঃ, কী কামড় দিয়েছে দেখো!
যন্ত্রণায় আমি মাঝে মাঝে অজ্ঞান হইয়া পড়িতেছিলাম–মাঝে মাঝে জ্ঞান হইতেছিল। অনেকে কী সব শিকড়-বাকড়ের রস মাখাইতে লাগিল, বাঁধাবাঁধি করিল। যখন ভালো জ্ঞান হইল, তখন দেখি মনু আমার শিয়রে। আনন্দে উহার হাত জড়াইয়া ধরিয়া বলিলাম–ভাই মনু, আমি কোথায়?
চুপ করো। তুমি বাড়িতে।
কী করে এলাম?
কাল রাতে দিয়ে গিয়েছে।
সে কী কথা! কাল রাত্রির কথার মানে বুঝিলাম না। দুপুরে আমাকে মাছে কামড়াইয়াছিল জানি। এতক্ষণ আমার জ্ঞান ছিল না–
বলিলাম–এখন বেলা কত?
বিকেল হয়েছে।
মাছটা মারা হয়েছে?
কোন মাছ?
যে মাছ আমাকে কামড়েছিল?
তোমাকে মাছ কামড়ায়নি।
কে কামড়ে ছিল?
হাঙরে।
সে কী? আমি যে দেখলাম দয়ে-ভাঙন মাছ জালে পড়ল—
সেটা দয়ে-ভাঙন নয়, সেটা মস্ত ভীষণ মানুষ-খেকো হাঙর।
আমায় সারাদেহ শিহরিয়া উঠিল, চৈতন্য আবার লোপ পাইবার উপক্রম হইল। হাঙরের হাতে পড়িয়া কী করিয়া বাঁচিয়া ফিরিলাম? সর্বনাশ! বাঁচিয়া আছি তো?
ডাকিলাম–ও ভাই মনু—
কথা বোলো না!
হাঙর কী করে জানা গেল? কে বললে হাঙর?
সেটা মারা পড়েছে। কাল দেখো তার পেটে একটা মানুষের হাতের বালা পাওয়া গিয়েছে। হাঙর মিষ্টি জলেও যায়। কোনো গ্রামের কাউকে ধরেছিল–ছোটো মেয়ের হাতের বালা।
দেখি বালাটা?
না, এখন চুপ করে থাকো। কাল সব দেখাব।
পরদিন অনেকখানি সুস্থ হইয়া উঠিলাম। নিবারণ আসিয়া বলিল–বাঘ দেখেছ? ফাঁদে পড়েছিল যে–
কোথায় বাঘ?
তোমাকে যে বাঘ প্রায় শেষ করেছিল হে! জলের বাঘ!
তুমি কি আমাকে ওই বাঘ দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলে?
, ডাঙার বাঘও দেখাবো। দাঁড়াও জলের বাঘ দেখাই।
নিবারণ সেই প্রকান্ড হাঙর আমার সামনে টানিয়া আনিল। তাহার বিকট দশনপাটি দেখিয়া বুঝিলাম কাল জলের মধ্যে আমার কী বিপদ গিয়াছে। এই ভীষণ বাঘের হাত হইতে নিতান্ত যে রক্ষা পাইয়াছি, তাহা ভগবানের দয়া।
মনু বলিল–এই দেখো সেই বালা। এর আসল দাঁত তুমি দেখোনি। চামড়ার খাপে ঢাকা থাকে, এই দেখো দেখাই।
ছোট্ট বালা দুইটি হাতে করিয়া কষ্ট হইল। কোন বালিকার প্রাণনাশ করিয়াছে এই হিংস্র নরখাদক জানোয়ারটা? দেখিতে অবিকল দয়ে-ভাঙন অথবা আড়মাছের মতো। কে জানে সেটা অত ভীষণ জানোয়ার! খাপে ঢাকা উহার ছেদনদন্তগুলি ক্ষুরের মতো তীক্ষ্ণ ও ভয়ানক।
পায়ের নীচের দিকে চাহিয়া দেখি অনেকটা পটি দেওয়া বাঁধা। এক মাস পরে জংলি লতাপাতার রস মাখাইতে মাখাইতে ঘা সারিয়া গেল। সকলে বলিল, পুনর্জন্ম! কারণ হাঙরের দাঁতের বিষে ঘা পচিয়া মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হয়। এদেশে প্রবাদ আছে–কুমিরে নিলে বরং বাঁচে, হাঙরের ঘায়ে সাবাড়!
রোগশয্যায় শুইয়া বড়ো দুর্বল হইয়া পড়িয়াছি।
বাড়ি হইতে বেশিদূর কোথাও যাই না আজকাল। একটা কেওড়া গাছের ছায়ায় বসিয়া ছবি আঁকি মনে মনে, নয়তো মনুর সঙ্গে গল্প করি। বই পড়িতে ভালোবাসি–কিন্তু এখানে বাংলা বই কোথায়? দেশে আমার বাবার কত ভালো ভালো বই আছে–এখন মনে পড়িল। সেদিন বিকালে কেওড়াতলায় বসিয়া বড়ো মন খারাপ হইয়া গেল। যদি এযাত্রা মরিয়া যাইতাম তবে মার সঙ্গে দেখার আশাও চিরতরে লুপ্ত হইত। মা কী ভাবিতেছেন কী জানি? তিনি কি রোজ আমার কথা ভাবিয়া চোখের জল ফেলেন না? মনু পিছন হইতে আসিয়া চোখ টিপিয়া ধরিল।
ছেড়ে দাও হে, আমি জানি।
কী ভাবছ?
উহার দিকে চাহিয়া বলিলাম–জান না?
সে বলিল–জানব কী করে?
খুব জান!
বাড়ির কথা তো?
তবে? মার কথা!
মনু চুপ করিয়া গেল। আমার বড়ো দুঃখ হয়, আমার দুঃখের কথায়, কষ্টের কথায় ও সহানুভূতি দেখায় না কেন? মনু আমাকে বলিল–আমাকে লেখাপড়া শেখাবে? আমি বলিলাম–বাংলা না ইংরেজি? মগ-ভাষা তো জানি নে। কত গল্প হইত দু-জনে। সবই ভালো। কিন্তু বাড়ির কথা বলিলে মনু চুপ হইয়া যায়। কিছুক্ষণ বসিয়া সে চলিয়া গেল। তারপরে একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটে। আমার পিছন হইতে কে আসিয়া আমার মাথায় হাত দিল। চমকিয়া পিছন ফিরিয়া চাহিয়া দেখিলাম সেদিনকার বনবিবিতলার সেই মা! আমার হাতে একছড়া পাকা কলা ও চারিটি বড়ো মুড়ির মোয়া দিয়া বলিলেন–তোমার জন্যে এনেছি, খাও। সব শুনলাম নিবারণের কাছে, হাঙরে নাকি ধরেছিল তোমায়?