আমি তন্দ্রা থেকে জাগিয়া উঠিলাম যেন। না, কেহ কোথাও নাই। মনু আমার চুলের ঝুটি ধরিয়া টানিতেছে আর বৃদ্ধ ওঝা আমার পায়ের উপর ছপাৎ ছপাৎ বেতের বাড়ি মারিতেছে।
মনু উহাকে জিজ্ঞাসা করিল–কীরকম বুঝছ ওস্তাদজি।
ওস্তাদ বৃদ্ধ বলিল–আশা আছে। ঘুমিয়ে না পড়ে আবার! ঘুমোলে চলবে না–ঘুমের মধ্যেই মরে যাবে। আমাকে ডাকিয়া বলিল–জলতেষ্টা পাচ্ছে?
–হুঁ।
–মনু, ওকে গরমজলটা খাইয়ে দাও এবার।
–তুমি ততক্ষণ মারো বেত। এই দেখো ঢুলছে—
দু-জনে মিলিয়া কী মার আমায় মারিল আর কী পরিশ্রমটাই করিল। ছেলের জন্যে বাবা যেমন কষ্ট ও চেষ্টা করে, বৃদ্ধ ওঝা তাহার চেয়ে একটুও কম কষ্ট আমার জন্যে করেনি।
মনু বলিল–ওস্তাদজি, এবার কী মনে হয়?
হয়ে গেল।
শেষ হয়ে গেল?
আমাদের কাজ শেষ হল।
বেঁচে গেল তো?
আলবৎ। নইলে আর ওঝাগিরি করব না।
বেলা হইল। গাছের মাথায় প্রাতঃসূর্যের রোদ পড়িয়াছে। বসন্তবৌরি পাখির ডাক শোনা যায় বনের মধ্যে। অনেকক্ষণ আগে বাঁধনগুলি কাটা হইয়া গিয়াছে। কিন্তু আমার পা অবশ, কসিয়া বাঁধন দেওয়ার ফলে আমার পা আড়ষ্ট–হাঁটিবার উপায় নাই।
ওস্তাদ খাইতে দিল আমাকে। একটা পাতায় গরমভাত ও গরম ফ্যান, জংলি গোঁড়া লেবু একটা আস্ত আর নুন। কোনো উপকরণের বাহুল্য নাই। সেই ভাত আর লেবুর রস সোনা হেন মুখ করিয়া খাইলাম। ডিঙিতে উঠিবার সময় ওস্তাদ বৃদ্ধকে নমস্কার করিয়া বলিলাম–আবার আসব।
অবশ্য আসবে, বাবা।
তুমি খুব বাঁচা বাঁচিয়েছ আজ।
তেনার হাত, তিনি বাঁচিয়েছেন।
ডিঙি বাহিয়া যাইতে যাইতে কেবলই মনে হইতেছিল, এ আমার জীবনের এক নতুন প্রভাত। মানুষের মধ্যে যে ভগবান বাস করেন, তাহা আজ বুঝিয়াছি। নতুবা মনু আমার কে? কেন সে এত প্রাণের টান দেখাইল আমাকে বাঁচাইতে? বৃদ্ধ ওঝা আমার কে? কেন সে সারারাত্রি জাগিল আমায় জীবন দিতে? মনুকে আজ নতুন চোখে দেখিতেছি। ও আমার ভাই। উহাদের কাছে সারাজীবন থাকিতে পারি। মা না থাকিলে নিশ্চয় থাকিতাম।
মনু বলিল–ভালো মনে হচ্ছে!
হুঁ।
বলছিলে যে শেষ হয়ে গেল।
তুমি না থাকলে তাই হত। তুমি আমার ভাই।
থাক। কাল না কত কথা বলছিলে, মনে নেই?
সেসব ভুলে যা মনু। দুই-ভাইয়ের মতো থাকব এখন থেকে।
একটা কথা।
কী?
বাড়ি গিয়ে এসব কথা কিন্তু বলতে পারবে না মাকে বা বাবাকে। কেমন?
তুমি যা বলবে ভাই। বললাম তো, তুমি আমার ভাই আজ থেকে।
মনু কথার উত্তর না দিয়া একটুমাত্র হাসিল।
ইতিমধ্যে শীতকাল পড়িল। জঙ্গলের মধ্যে বর্ষার কাদা অনেকটা শুকাইয়া আসিল। পাশের নদীর দুইধারের ঝোপে পেতনিপোতার সাদা ফুল পেঁজাতুলার রাশির মতো শোভা পাইতে লাগিল। এই সময় মনুর বাবা দেখি বজরা সাজাইয়া অস্ত্রশস্ত্র লইয়া রোজই কোথায় বাহির হইয়া যায়। অনেক রাত্রিতে ফেরে। আমাদের ঘরে অনেক কাপড়চোপড়, খাবার জিনিস আর ধরে না।
একদিন মনুকে বলিলাম কথাটা।
মনু বলিল–ভাই, আমাকেও তো বড়ো হলে ওই করতে হবে। বাবাকে বারণ করব কেন?
তুমি আমার ভাইয়ের মতো। তোমাকে আমি ভালো পথে নিয়ে যেতে চাই।
তা হবে না। বাবা যা বলেন তাই হবে, তবে একটা কথা।
কী?
বাবা বলছিলেন, ক্রমে পুলিশের ভয় বাড়ছে। এ কাজ আর চলবে না?
তবে?
কী করি বলো তুমি।
আমি পথ বলে দিতে পারি। সে-কথা কি তোমার বাবা শুনবেন? লেখাপড়া শেখো। কানাইডাঙায় ডাক্তারবাবু স্কুল খুলেছেন। সেখানে ভরতি হও। কী করে খাবে দেখতে হবে তো?
তুমি বাবাকে বোলো। নিবারণ আমাদের লইয়া মাছ ধরিতে চলিত রোজই দুপুরের পর। এদিনও আসিল। বলিল –একটা জিনিস তোমাকে দেখাব। ফাঁদে বাঘ পড়ে না, বলেছিলে না?
বলিলাম–পড়েছে নাকি?
চলো দেখবে।
দূর হইতে দেখিলাম চার-পাঁচখানা ডিঙি পশোর নদীর দিকে চলিয়াছে। আমাদের ডিঙিও সেগুলির পিছনে পিছনে চলিল। নিবারণকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম, উহারা মাছ ধরিতে চলিয়াছে।
কিন্তু সেদিন অমন বিপদে পড়িতে হইবে জানিলে বোধ হয় নিবারণের সঙ্গে যাইতাম না।
পশোর নদীর মধ্যে গিয়া দেখি সেখানে আরও অনেক জেলেডিঙি। ইহারা ডাঙায় নামিয়া রান্না করিয়া খাইতেছিল। আমরা জাল ফেলিতেই মস্ত বড়ো একটা দয়ে-ভাঙন জালে আটকাইল। মাছটার ওজন আধ মণের উপর। দয়ে-ভাঙন সামুদ্রিক মাছ, এতদিন ইহাদের মধ্যে থাকিবার ফলে আমি এই মাছ চিনিয়াছিলাম। খাইতে খুব সুস্বাদু। অন্য সামুদ্রিক মাছ আমার মুখে রুচিত না, কেবল এই মাছ ছাড়া।
মাছটা ডিঙিতে তুলিতে গিয়া ডিঙি কাত হইয়া গেল।
কীভাবে পা পিছলাইয়া আমি জলে পড়িয়া গেলাম, সঙ্গেসঙ্গে সেই মস্ত মাছটা আমার দিকে তাড়া করিয়া আসিল; দয়ে-ভাঙন মাছ মানুষকে তাড়া করে কখনো শুনি নাই; চিৎকার করিতেই নিবারণ দাঁড় তুলিয়া মাছটার গায়ে এক ঘা মারিল। সেটা একবার ঝাঁপটা মারিতেই জালের দড়ি ছিঁড়িয়া গেল। মাছ আসিয়া আমার হাঁটু কামড়াইয়া ধরিল। আমি ডিঙির কানা ধরিতে চেষ্টা করিলাম, নাগাল পাইলাম না। মাছটার টান এবং ভাটার টানে মিলিয়া আমাকে ডিঙি হইতে দূরে লইয়া ফেলিল। একবার এক ঝলক লোনা-জলের খাবি খাইয়া বুঝিলাম মাছ আমাকে জলের তলায় লইবার চেষ্টা করিতেছে।
সেই সময় নিবারণ চিৎকার করিয়া অন্য ডিঙির লোকেদের ডাক দিল। একজন দূর হইতে এই ব্যাপার দেখিয়া এই দিকে ডিঙি বাহিয়া দ্রুত আসিতেছিল।