একস্থানে গিয়া মনু বলিল– চেয়ে দেখো, তুমি অবাক হয়ে যাবে।
কী দেখব?
এগিয়ে চলো।
সত্যিই অবাক কান্ড!
সেই ঘন বনের মধ্যে প্রকান্ড একটা বাড়ির ধ্বংসাবশেষ। শুধু একটা বাড়ি নয়, আশপাশে আরও অনেক বাড়ির চিহ্ন দেখা যাইতেছে। বড়ো বড়ো পাথরের খিলান খসিয়া পড়িয়াছে, দুর্ভেদ্য বেতজঙ্গলে পাথরে কড়ির হাঙরমুখ ঢাকা পড়িয়াছে। মনু বলিল–আরও দেখবে?
হুঃ।
চলো রানির জঙ্গল দেখিয়ে আনি—
কত দূর?
এখান থেকে দূর আছে। বাঘের ভয় আছে পথে।
–চলো যাব।
কিন্তু বেশি দূর যাইতে-না-যাইতে আর একটি বড়ো বাড়ির ধ্বংসস্তূপে আমাদের পথ আটকাইয়া গেল। বড়ো বড়ো পাথর ও ইটের জমাট চাঁই, বেতলতার শক্ত বাঁধনে আবদ্ধ। এক স্থানে একটা মন্দির। মন্দিরের ছাদটা দাঁড়াইয়া আছে, অন্ধকার গর্ভগৃহে মনে হইল এখনও বিগ্রহ জীবন্ত।
মনু তাড়াতাড়ি বলিল–ও কি? কোথায় যাও? ঢুকো না, ঢুকো না। আমি ততক্ষণে ঢুকিয়া পড়িয়াছি। মন্দিরের বহু শতাব্দীর জমাট অন্ধকারে দেবতার বেদি আবিষ্কার করিতে পারিলাম, মনে হইল কোন অতীতকালের বাংলায় পূজাবেদিতে অর্ঘ্য সাজাইয়া নিবেদন করিতে আসিয়া পথভ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছি–সে অতীত দিনে ফিরিয়া যাইবার সকল পথ আজ আমাদের রুদ্ধ।
কে আমাকে হাত ধরিয়া সে বাংলায় ফিরাইয়া লইয়া যাইবে?
কেহ নাই।
আমাদের সে অতীত দিনের পূর্বপুরুষদের আজ আমরা আর চিনিতে পারিব না।
তাহারাও আমাদের আর চিনিতে পারিবে কি তাহাদের বংশধর বলিয়া?
হঠাৎ অন্ধকারের মধ্যে কীসের গর্জন শুনিয়া শিহরিয়া উঠিলাম। মনু বাহিরে দাঁড়াইয়া আছে, সে আমাকে দেখিতে পাইতেছে না ভগ্নদেউলের অন্ধকারে।
বিকট ফোঁস ফোঁস শব্দে অন্ধকার যেন আমার দিকে দাঁত খিচাইতেছে, কোথায় আছে কালসর্প আমার অতি কাছে, এই ঘন আঁধারের মধ্যে সে আমার জীবনলীলার অবসান বুঝি করিয়া দিল! উচ্চরবে আর্তকণ্ঠে ডাকিলাম–মনু! মনু! সাপ! সাপ! শিগগির এসো–
আমার ডান পায়ের পাশেই আবার সেই ফোঁস ফোঁস শব্দ এবং সঙ্গেসঙ্গে আমার গায়ে কে যেন শক্ত লাঠির ঘা বসাইয়া দিল। আবার ফোঁস ফোঁস শব্দ।
মনু আসিয়া বলিল– কী? কী?
খেয়ে ফেললে, বড়ো সাপ!
সরে এসো। এক লাফে ওই ইটের ওপর উঠে যাও।
সঙ্গে সঙ্গে আমার ডান পায়ে আর একটা লাঠির বাড়ি এবং ঝাঁটার কাঠি ফোঁটানোর মতো বেদনা। একটা মস্ত ইট কী পাথর ছোঁড়ার শব্দ শুনিলাম। মনু বোধ হয় কালসর্পের দিকে ছুড়িয়া মারিল। আমার কাছে ছুটিয়া আসিয়া বলিল–কামড়েছে?
হুঁ।
কোথায়? চলো তাড়াতাড়ি বাইরে! এক-শো বার বারণ করলাম, ওর মধ্যে ঢুকো না। আমার সব কথা তোমার টক লাগে!
এখন ভাই কথা বোলো না বেশি। চলো বাইরে যাচ্ছি।
আমি ধরে নিয়ে যাই।
কিছু না, আমি নিজে যেতে পারব।
দুইটা ছোটো ছিদ্র দেখা গেল গোড়ালির কাছে। মনু আমার কোমরের কাপড় ছিঁড়িয়া ফেলিয়া তিনটি শক্ত বাঁধন দিল। তারপর আমার হাত ধরিয়া ডিঙিতে উঠাইয়া অতি দ্রুত ডিঙি বাইতে লাগিল–কিন্তু উলটো দিকে, যেদিকে বাড়ি সেদিকে নয়। আমি ভুল দেখিতেছি না তো?
বলিলাম–ভাই মনু—
চুপ–
আমার শেষ হয়ে এসেছে—
আবার!
মার সঙ্গে ভাই দেখা হল না–
আঃ—
–তুই আমার বড়ো বন্ধু ছিলি—
–আবার বকে! চুপ!
আমার মনে হইল আমরা উলটো দিকে চলিয়াছি। আগেই মনে হইয়াছিল–বলিয়াছি। ও কোথায় চলিয়াছে পাগলের মতো এ অন্ধকারের মধ্যে দিয়া?
একটা জায়গায় ডিঙি রাখিয়া সে আমাকে নামাইয়া লইল। জঙ্গলের মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গায় গোলপাতায় ছাওয়া একখানা কুটির। কুটিরের সামনে গিয়া সে ডাকিল–ওস্তাদজি, ওস্তাদজি—
ঘর হইতে বাহির হইয়া আমাদের সামনে যে আসিল তাহাকে দেখিয়া হাসিব কি কাঁদিব বুঝিতে পারিলাম না। লোকটা কি যাত্রাদলের নারদ? কারণ সেইরকমই সাদা লম্বা দাড়ি, তাহার বয়স যে কত তাহা আমার বুঝিবার কথা নয়। তবে সে যে অতি বৃদ্ধ, এ বিষয়ে কোনো ভুল নাই।
বৃদ্ধ আসিয়া অন্ধকারের মধ্যে আমাদের দেখিয়া ভয় পাইয়া গেল। থতমতো খাইয়া বলিল–কে বাবা তোমরা?
মনু বলিল–আমি। ভালো করে চেয়ে দেখো। আমার এই ভাইকে জাতসাপে কামড়েছে। সময় নেই–একে বাঁচাও।
ওস্তাদ তখনি আমার কাছে আসিয়া বলিল–দেখি দেখি, কোথায়?
এই যে, দাঁতের দাগ দেখো।
ঠিক।
বাঁচবে?
তেনার হাত, আমি কী জানি? যা বলি তা করো।
বলো।
একে আরও বাঁধন দিতে হবে; দড়ি দিচ্ছি।
আমাকে ইহারা দুজনে মিলিয়া কী কসিয়াই বাঁধিল! এ যন্ত্রণার চেয়ে মৃত্যু বোধ হয় ভালো ছিল।
হঠাৎ কানে গেল মনু বলিতেছে–ঘুমিও না ভাই–এই, ঘুমিও না—
ঘুমাইতেছি? কে বলিল?
কিন্তু পরক্ষণেই আমার মনে হইল দেশের বাড়ির দাওয়ায় আমি বসিয়া আছি। মা একবার আসিয়া বলিলেন–কী হয়েছে নীলু, বাবা আমার, কোথায় কী হয়েছে দেখি?
মা আমায় গায়ে তাঁহার পদ্মহস্ত বুলাইয়া দিলেন। তারপর একথালা গরম ভাত ও মাগুরমাছের ঝোল আনিয়া আমায় খাওয়াইতে বসিলেন।
আমি বলিলাম–মা তোমাকে কত দিন দেখিনি—
মা হাসিলেন, কী প্রসন্ন হাসি!
বলিলাম–ওরা ধরে রেখেছিল, তোমার কাছে আসতে দিচ্ছিল না। এই সময়ে আরও অনেক লোক আসিল আমাদের পাড়ার। বিলু পিসি, কার্তিক, সুনু, বৃন্দাবনদা। উহারা আমায় দেখিয়া বড়ো খুশি। সকলেই বলিল–ওমা, আমাদের নীলু যে আবার ফিরে এসেছে! ও নীলু? নীলু?