মনু বলিল–কী ভাই নিবারণ, বাঘ কোথায় গেল?
তাই তো! পায়ের দাগ কোথায় গেল?
বাঘ এখানেই আছে, কোথাও যায়নি।
তা হয় তো খুঁজে বার করো।
নিবারণ এইবার খুঁজিয়া খালের ধারের কাদায় আসিয়া কী একটা চিহ্ন দেখিয়া উত্তেজিত সুরে বলিল–শিগগির এসো, বাঘ পাওয়া গেছে।
আমরা ছুটিয়া গেলাম। কই বাঘ? কোথায়? কিছুই তো আমাদের চোখে পড়ে না। নিবারণ একটা শুকনো হিজলপাতার দিকে আঙুল দেখাইয়া বলিল–ওই দেখছ না! রক্তমাখা হিজলপাতাটা বাঘের থাবায় উলটে গিয়েছে? থাবার রক্ত?
মনু বলিল–বাঘ কোথায়?
–বাঘ ওপারে! ডিঙিতে ওঠো– কোথায় আছে, আমি বুঝতে পেরেছি।
ডিঙিতে খাল পার হইয়া মস্ত বড়ো একটা বেতঝোঁপ। তাহার পাশে একটা ভাঙা বাড়ির ইটের স্তূপ। সেই ঘন জঙ্গলে ইটের বাড়ির ধ্বংসস্তূপ কোথা হইতে আসিল। আমি খুব অবাক হইয়া গেলাম। নিবারণকে বলিলাম কথাটা? তাহার বা মনুর এ সম্বন্ধে বিশেষ কৌতূহল দেখিলাম না।
নিবারণ বলিল–অত কথায় আমাদের দরকার কী বাপু? যা করতে এসেছ তাই করো।
দেখতেও তো এসেছি।
দেখবে আবার কী?
কারা এই জঙ্গলে বাড়ি করেছিল, এটা জানবার কথা নয়?
বাপ-দাদাদের মুখে শুনেছি, দেবতারা করেছিল।
দেবতাদের কী গরজ?
তা জানি নে বাপু, যা শুনেছি তাই বললাম।
ব্যাস! ইহার বেশি উহাদের কৌতূহলের দৌড় নাই, ও কী করিবে? আমরা সেই ইষ্টক স্থূপে উঠিয়া এখানে-ওখানে খুঁজিতেছি, এমন সময়ে নিবারণ বিজয়গর্বে চিৎকার করিয়া বলিল–ওই যে!
গিয়া দেখি এক জায়গায় ইটের আড়ালে বাঘটা মরিয়া পড়িয়া আছে। হাঁ করিয়া উঁচু দিকে মুখ করিয়া দাঁতের পাটি বাহির করিয়া চিত হইয়া শুইয়া আছে।
মনু এক লাফে বাঘটার কাছে যাইতেই নিবারণ সতর্ক চিল্কারে তাহাকে সাবধান করিয়া দিল।
মরবে! মরবে! খবরদার।
তাই মনু বাঁচিয়া গেল।
সে এক অদ্ভুত ও ভীষণ দৃশ্য। মৃত বাঘটা হঠাৎ এক লম্ফে চিত অবস্থা হইতে সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া উঠিল। পরক্ষণেই একটা লাফ দিল আমার দিকে।
আমার দূরত্ব ছিল তাহার লাফের পাল্লার বাহিরে, তাই রক্ষা পাইলাম। মনু মরিত যদি নিবারণ তাহাকে সতর্ক না করিত। বাঘটার সেই শেষ লাফ– সেই যে মাটিতে পড়িয়া গেল, আর উঠিল না। আমরা দেখিলাম, নিবারণ আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বিজ্ঞ। সে এখনও আমাদের বারণ করিতেছে–খবরদার, বিশ্বাস নেই, ও হল সাক্ষাৎ যম, ওর কাছেও যেও না। আগে দেখি ভালো করে—
নিবারণ ভূপতিত ও পঞ্চত্বপ্রাপ্ত বাঘটার গায়ে একটা ঢিল মারিল।
আমি বলিলাম–নট নড়নচড়ন নট কিচ্ছ—
নিবারণ আর একটা ঢিল ছুড়িল। এবারও বাঘ নড়িল না। তখন আমরা সবাই মিলিয়া কাছে গেলাম। বাঘের মাথার পিছন দিকে নিবারণের দাঁড়ের জবর ঘা লাগিয়া খুলি চিরিয়া ঘিলু ঝরিতেছে। বাঘের শক্ত প্রাণ বটে! এ অবস্থাতেও অমন লাফ দিতে পারা সোজা শক্তির কথা! মস্ত বড়ো বাঘ। আমরা তিনজনে সেটাকে টানিয়া-হেঁচড়াইয়া জলের ধারে আনিলাম। ডিঙিতে উঠানো বড়ো কঠিন কাজ। এক হাঁটু কাদার মধ্য দিয়া অত বড়ো ভারি মৃত জন্তু ডিঙি পর্যন্ত নেওয়াই মুশকিল।
বলিলাম–এটা এখানে থাক, চলো লোক ডেকে আনি—
নিবারণ বলিল–তা থাকবে না, চামড়া নষ্ট হবে—
কীসে?
এখুনি শকুন পড়বে এর ওপর, চামড়াখানা যাবে। সুন্দরবনে শেয়াল নেই।
তবে আমি আর মনু থাকি, তুমি যাও।
এই বনে তোমাদের রেখে যেতে সাহস করিনে। তোমরা জঙ্গলের জান কী? কতরকম বিপদ ঘটতে পারে, তুমি কী খবর রাখ? দেখি দাঁড়াও, একটা মোটা ডাল–
এমন সময় খাল দিয়া আর একখানা ডিঙি যাইতে যাইতে আমাদের ও-অবস্থা দেখিয়া থামিল। নিবারণের মুখে সব শুনিয়া বলিল–বা রে ছোকরার দল। বলিহারি সাহস! সুন্দরবনে দাঁড় দিয়ে বাঘ মারা এই নতুন শোনা গেল বটে।
আমরা বলিলাম বাঘের মৃতদেহটা ডিঙিতে তুলিতে সাহায্য করিতে। তাহারা আমাদের সঙ্গে বাঘটা আমাদের ডিঙিতে তুলিয়া দিয়া গেল।
আমি তাহাদের একজনকে জিজ্ঞাসা করিলাম–এ কোথাকার নৌকো?
সরষেখালির।
সে কত দূর?
পাঁচ-ছ ক্রোশ এখান থেকে।
যাবেন কোথায়?
আমরা বড়ো চরের ট্যাঁকে মাছ ধরতে যাব। তুমি কোথায় থাক বাবু?
মনু আমার গায়ে ধাক্কা দিয়া বলিল–চলো চলো, বাজে কথা বলে লাভ নেই। ও আমাদের বাড়ির ছেলে। কেন, কী দরকার তোমাদের?
কেন, বললে দোষ কী?
না, বলার দরকার নেই। আমি ভালো ভাবেই তোমায় বলছি, ওতে আমাদের বিপদ হতে পারে।
কী বিপদ?
পুলিশে ধরবে আমার বাবাকে। বুঝলে?
আমি কথা বলিলাম না! বুঝিলাম মনুর সঙ্গ আমাকে ছাড়িতে হইবে। ও আমায় নজরবন্দি রাখিয়াছে–পাছে ওর বাবা বিপদে পড়েন, পাছে আমি পালাই। এ জীবন আমার মন্দ লাগিতেছে না। মনুকে আমি ভাইয়ের মতো ভালোবাসি। কিন্তু আমার মায়ের কাছে যাইতে আমার কী আকুল আগ্রহ, ও তাহার কী বুঝিবে?
সেদিন হইতে মনু আমার প্রতি খুব প্রসন্ন হইল। আমাকে ভাগ না দিয়া কোনো জিনিস খায় না, কোথাও গেলে আমায় সঙ্গে না লইয়া যায় না।
একদিন আমাকে বলিল–তোমাকে একটা নতুন জিনিস দেখাব–চলো যাই–
সেদিন নিবারণ আমাদের সঙ্গে ছিল না, শুধু আমি আর ও। আমি দাঁড় টানি, ও হাল ধরে। অবশ্য খালের ভিতর দিয়া যাইতে হাল ধরিতে কোনো কষ্ট নাই।
কিছু দূরে গিয়া দু-জনে জঙ্গলের মধ্যে নামিলাম। বড়ো বড়ো গোলপাতা গাছ জঙ্গলের ধারে নত হইয়া আছে। বেত ডাঁটার অগ্রভাগ ভাটার টানে দুলিতেছে। বাতাবি লেবুর মতো সেই ফলগুলি শুকাইয়া ঝরিয়া পড়িয়া গাছতলায় গড়াগড়ি যাইতেছে। বাঁদরের পাল হুপ হুপ করিয়া এগাছে-গাছে লাফালাফি করিতেছে। ইহারা মুখপোড়া হনুমান জাতীয় বানর নয়, রাঙামুখ বুপীবাঁদর। হনুমান হইতে আকারে কিছু ছোটো।