না, কেন চুপ করব? আমি ভয় করি না।
থামো বাবা থামো!
নিবারণ আসিয়া মনুকে হাত ধরিয়া অন্য দিকে লইয়া গেল। সেই সময় মেয়েটিও চলিয়া গিয়া অন্য মেয়েদের ভাত খাওয়াইতে লাগিলেন। এক সময় আড়চোখে উহাদের দিকে চাহিয়া দেখিয়া মেয়েটি চট করিয়া আমার কাছে আসিলেন। আমার হাত ধরিয়া বলিলেন–এসো—লুকিয়ে–
আমরা গিয়া একটি গোলপাতার ঝোপে দাঁড়াইলাম। তাঁহার প্রসন্ন মুখের দিকে চাহিয়া আমার মাকে দেখিতে পাইলাম। এই বিজন অরণ্যের মধ্যেও বিশ্বের পিতা ভগবান এমন স্নেহরস পরিবেশনের ব্যবস্থা করিয়াছেন।
বলিলাম–কী মা?
তুমি কে বাবা?
আমার নাম নীলু রায়, আমার দাদামহাশয়ের নাম ভৈরবচন্দ্র মজুমদার, বাড়ি পলাশগাছি, জেলা খুলনা। আমাকে ওরা ধরে এনেছে।
কী করে?
আমি সব খুলিয়া বলিলাম। মায়ের মতো স্নেহ পাইয়া এতদিন পরে আমার বড়ো কান্না পাইল। আমার বাবা নাই, জ্ঞান হইয়া অবধি মাকে ছাড়া আর কাহাকেও চিনি না। আমার সে মা আমার অভাবে কী কষ্টই না জানি পাইতেছে! রোজ রাত্রে মার কথা ভাবিয়া আমি কাঁদি। ভগবান ছাড়া আর কে সে-কথা জানে!
মেয়েটি আমার চোখের জল নিজের আঁচল দিয়া মুছিয়া দিলেন।
চুপ করো বাবা, কেঁদো না ছিঃ—
আমি সেজন্যে কাঁদিনি। শুধু ভাবছি মা কেমন করে আছেন—
সব বুঝেছি। আমার আগেই সন্দেহ হয়েছিল। একটা কথা বলি—
কী?
তোমার হাতে টাকা আছে?
কিছু না। গলায় সোনার হার ছিল, সে ওরা খুলে নিয়েছে।
মনু জানে?
না। ও ভালো ছেলে। আমাকে খুব ভালোবাসে।
মেয়েটি আঁচলের গিরো খুলিয়া আমার হাতে দুইটি টাকা দিয়া বলিলেন–এই নাও, রাখো।
আমি ঘাড় নাড়িয়া বলিলাম–না, এ আপনি রাখুন।
নাও না। আমার কথা শোনো।
না।
আবার একগুঁয়েমি। ছিঃ, রাখো!
আমি মেয়েটির মুখের দিকে আবার চাহিলাম। আমার মায়ের গলার স্নেহ-ভর্ৎসনার সুর। না, মেয়েটির মনে কষ্ট দিতে পারিব না, যেমন পারিতাম না আমার মায়ের মনে।
মেয়েটি বলিলেন–এই টাকা যত্ন করে রাখবে। কাজে লাগবে এর পরে।
কী আর কাজে লাগবে! ওরা দেখলে কেড়ে নেবে। আচ্ছা ওরা কী করে–আমাকে নিয়ে কী করবে?
শুনেছি হাটে বিক্রি করে।
কোথাকার হাটে?
যাদের ধরে, তাদের কেনা-বেচার হাটে বেচে। এরা অমন কেনে-বেচে, আমি শুনেছি। মনুর কোনো দোষ নেই। ওর সঙ্গে ভাব রেখো। আমি চেষ্টা করব তোমাকে ছাড়াতে। কিন্তু আমরা ওদের সঙ্গে মিলেমিশে বাস করি। ওদের ভয়ে আমাদের কিছু করবার জো নেই। ওদের তুষ্ট না রাখলে সুন্দরবনে আমাদের কাজ চলবে না। তবুও আমি বলছি, আমি চেষ্টা করব। তোমাকে উদ্ধার করবার যা চেষ্টা দরকার, তা আমার দ্বারা হবে। একথা কিন্তু কারো কাছে প্রকাশ করবে না, কেমন?
ঠিক আছে।
আমি যাই আজ। দাঁড়ান, আপনাকে প্রণাম করি।
না, আমার পায়ে হাত দিও না। আমরা ছোটো জাত।
আপনি মা, মায়ের আবার জাত কী? দাঁড়ান।
আমি প্রণাম করিলাম, তিনি চিবুকে হাত দিয়া চুমু খাইলেন, মাথায় হাত দিয়া আশীর্বাদ করিলেন।
অনেকদিন পরে মনে বল ও আনন্দ পাইলাম। আজ আমার বনবিবির দরগায় আসা সার্থক। কিংবা দয়াময়ী বনবিবিই একটি অসহায় ছোটো ছেলের দিকে মুখ তুলিয়া চাহিলেন।
রাত্রি অনেক হইয়া গিয়াছিল, আমরা নিবারণের সঙ্গে ফিরিলাম। মনুর দিকে চাহিয়া বলিলাম–আমার ওপর রাগ করেছ ভাই?
মনু বলিল–না।
আমি অন্যায় কথা বলিনি।
ওর সামনে বললে, তাই রাগ হয়েছিল। যা হোক, তুমিও কিছু মনে কোরো না।
ব্যাপারটা মনুকে সব খুলিয়া বলি নাই। কী জানি কী মনে করিবে হয়তো। মগ ডাকাতের ছেলে, উহার মনের খবর আমি সব কি জানি?
জলের ধারের জঙ্গলে হঠাৎ দৃষ্টি পড়িল। হেঁতাল গাছের ঝোঁপ ঠিক জলের ধারেই। কী সুন্দর সাদা ফুল ফুটিয়া আছে ঝোঁপের মাথায়! আমি যেমন সেদিকে চাহিয়াছি, অমনি ঝোঁপের ভিতর হইতে নিঃশব্দে কী একটা আসিয়া জলের ধারে দাঁড়াইল। কালোমতো কী একটা জানোয়ার। চুপ করিয়া দাঁড়াইতে দেখিয়া আমার সন্দেহ হইল। আমি মনুকে দেখাইব ভাবিতেছি, এমন সময় সেটা জলে ঝাঁপ মারিল এবং নৌকার দিকে সাঁতরাইয়া আসিতে লাগিল।
চিৎকার করিয়া বলিলাম–মনু! নিবারণ!
উহাদের সাড়া নাই। ভাটার টানে নৌকা আপনা-আপনি চলিয়াছে, উহারা ঘুমাইয়া পড়িয়াছে নাকি?
এমন সময় নিবারণ উঠিয়া দাঁড়াইয়া সবেগে দাঁড়ের বাড়ি মারিল জানোয়ারটার মাথায়। সঙ্গেসঙ্গে ভীষণ গর্জন বাঘের এবং নিবারণ ও মনু দুইদিক হইতে জানোয়ারটার মাথায় দুড়দাড় মারিতে লাগিল। বাঘটা মুখ ঘুরাইয়া ডাঙার দিকে চলিল। তাহার দেহের বেগ শিথিল হইয়া পড়িয়াছে। ডাঙায় উঠিয়া সেটা হেঁতাল ঝোঁপের মধ্যে মিশিয়া গেল। তারপর একটা আর্ত চিৎকার করিয়া উঠিল।
এতক্ষণে নিবারণ বলিল– উঃ, আজ তোমাকে নিয়েছিল আর একটু হলে!
মনু বলিল–ঝগড়া করতে ব্যস্ত ছিলে, এদিকে যে হয়ে গিয়েছিল! নিবারণ আর আমি দু-জনেই টের পাই। আমরা দাঁড় হাতে তৈরি ছিলাম। তুমি চেঁচিয়ে উঠে সব মাটি করলে। আরও কাছে এলে ওটার মাথার খুলি গুড়ো করে দিতাম।
নিবারণ বলিল–আমার মনে হয় ওটা ঘায়েল হয়েছে। কাল খুঁজতে হবে এই ঝোপে। ওঃ, আজ তোমাকে যমের মুখ থেকে বাঁচানো হয়েছে।
মনু বলিল–উঃ, আর একটু হলে কী সর্বনাশ হত!
দেখিয়া খুশি হইলাম–আমার বিপদ হইতে উদ্ধারের জন্য উহারা সকলেই সুখী। পরদিন সকালে একটু রৌদ্র উঠিলে আমরা ডিঙি করিয়া সেই হেঁতালঝোঁপ খুঁজিতে গেলাম। অনেক দূর পর্যন্ত খুঁজিয়াও কোথাও মৃত বাঘের চিহ্নও পাইলাম না। নিবারণ এক স্থানে রক্তের দাগ পাইল বটে, বাঘের থাবার দাগও দেখা গেল কিন্তু কিছু দূর পর্যন্ত, তারপর যেন বাঘটা হঠাৎ আকাশপথে উড়িয়া গিয়াছে।