মনু বলিল–খুব বেঁচে গিয়েছ!
নিবারণ শুকনো মুখে হাসি আনিয়া বলিল–ভারি।
আমি বলিলাম–নিবারণ, গিয়েছিলে আর একটু হলে।
তা আর না!
ভয় করছিল?
করবে না? সাক্ষাৎ যম। জানিস মনু, আমি ভাবছিলাম যদি বাঘে থাবা মারে, তবে কোথায় আগে মারবে। কানে যেন না মারে, ক-দিন থেকে আমার কানে ব্যথা। আবার ভাবছি, বাবুদের ওই নতুন ছেলেটা কখনো বনে আসেনি, ওটাকে কেন মরতে নিয়ে এলাম।
আমরাও চুপ করে বসে থাকতাম না নিবারণ। মনু লাফ দিয়েছিল আর একটু হলে।
মনু লাফিয়ে কী করত? নিজে মরত, তোমাকেও মারত বই তো নয়!
অনেক রাত্রে আমরা বাড়ি আসিলাম। পরদিন নিবারণ আসিয়া আমাদের ডাকিল।
বলিলাম–কোথায়?
নেমন্তন্ন খেতে চলো।
কোথায় আবার?
মনু আর তুমি চলো।
তিনজনেই আমরা চলি। অনেক দূর চলি খালের পথে। সুন্দরবনে ডিঙি ছাড়া চলার পথ নাই। সব দিকে ডিঙি, সব দিকে খালের পথ। দুইটি বাঁক ছাড়াইয়া দেখি, একটা উঁচু ট্যাঁকে অনেক লোক একত্র হইয়া কী উৎসব করিতেছে। ডিঙি হইতে নামিতে তাহাদের ভিতর হইতে কয়েকজন আগাইয়া আসিয়া আমাদের বলিল–আসুন বাবু, আপনাকে এনেছে বুঝি নিবারণ? এসো গো মনু সাহেব–
মনু বলিল–আমি সাহেব নই—
তাহারা হাসিয়া বলিল–বেশ, চলে এসো। তুমি যা আছ, তা আছ।
নিবারণকে বলিলাম– কে এরা?
আমাদের গাঁয়ের লোক। আমাদের গাঁয়ের নাম ঝাউতলা। ওরা আজ এখানে এসেছে বনবিবির দরগায় পুজো দিতে।
একজন বলিল–সেজন্যেই বাবু ও জায়গাটার নাম বনবিবির ট্যাঁক।
আমি উহাদের মধ্যে অনেকের সঙ্গে আলাপ করিলাম। উহারা বেশ সরল, অমায়িক। একজনের নাম কালু পাত্র। বয়স আমার বাবার চেয়েও বেশি বলিয়া মনে হইল। কিন্তু একেবারে ছোটো ছেলের মতো সরল। আমার সঙ্গে কালু পাত্রের বড়ো ভাব হইয়া গেল। কালু পাত্র আমাকে সঙ্গে করিয়া গিয়া দেখাইল, একটা প্রাচীন কেওড়া গাছের তলায় চার পাঁচটি ছাগল বাঁধা। অনেক মেয়ে-পুরুষ গাছতলায় বসিয়া গল্প করিতেছে। একটা হাঁড়িতে অনেকখানি খেজুর গুড়। এক কলসিভরতি দুধ।
নিবারণকে বলিলাম–পুজো করবে কে?
আমরাই।
পুরুত আসেনি?
না, পুরুত থাকে না। কালু পাত্র সব করবে।
বাজনা বাজিয়া উঠিল। তিনটি ঢোল এবং একাট কাঁসি বাজিতেছিল। একটি মেয়ে গরানফুলের মালা ঢুলির গলায় পরাইয়া দিল। উহাই নাকি নিয়ম। আজ ঢুলিকে সম্মান দেখানো মস্ত বড়ো নিয়ম। ইহাদের পূজার কিছু বুঝিলাম না। কোনো নিয়ম নাই। পাঁচটা ছাগল প্রাচীন দরগাতলায় বলি দেওয়া হইল। সেই মাংস পাক হইল।
কালু পাত্র আমার কাছে আসিয়া বলিল–বাবু, ঝাল খান?
বেশি নয়। কম করে দিতে বলো।
এটা আমাদের বছরের পুজো। বনবিবির দরগায় পুজো না দিয়ে কোনো কাজ হবে না আমাদের।
কী কাজ?
যেকোনো কাজ। আমরা এই জঙ্গলের লোক। বনবিবিকে তুষ্ট না রাখলে বাঘে নিয়ে যাবে।
বিশ্বাস করি না।
বিশ্বাস করেন না, ও-কথা বলবেন না বাবু।
কেন?
আমার চোখে দেখা। এখানে বাস করে বনবিবিকে মানিনে যিনি বলেন, তাঁর মস্ত বড়ো বুকের পাটা।
আমি তো বলছি।
আপনি বিদেশি লোক, আপনার কথা আলাদা। আমরা মোম-মধু সংগ্রহ করি, কাঠ কাটি, এই ভাবে পয়সা জোগাড় করি। জঙ্গলের মধ্যে আমাদের মুখের অন্ন। বনবিবিকে পুজো না দিলে চলে?
আমি বনবিবিকে পুজো করব, যদি তিনি আমার একটা কাজ করেন।
কী কাজ?
সে এখন বলব না। তোমাকে বলব গোপনে।
তারপর সে কী নাচ আর ঢুলির বাদ্য। ঢুলিরাও নাচে, লোকজনও নাচে। অনেক বেলায় সেই প্রাচীন কেওড়াতলায় আমরা খাইতে বসিয়া গেলাম। আমাদের মাথার উপর নীল আকাশ। নীচে দিয়া ভাটার টানে খালের জল কলকল করিয়া পাশের নদীর দিকে চলিয়াছে। নিবারণ ও কালু পাত্র পরিবেশন করিল। মোটা চালের রাঙা ভাত, বেগুনপোড়া ও প্রসাদী মাংস। মাংস প্রচুর দিল, যে যত খাইতে পারে। মেয়েরা আসিয়া আমাদের কাছে দাঁড়াইয়া যত্ন করিয়া আমাদের খাওয়ার তদারক করিতেছিলেন।
একটি মেয়ে আমাকে বলিলেন–তুমি কে বাবা? কোথায় থাক?
মনু বলিল–আমাদের বাড়ি। কেন?
মেয়েটি থতমতো খাইয়া গেলেন। অপ্রতিভ মুখে বলিলেন–না, তাই বলছি।
মনু বলিল–যাও এখান থেকে—
আমি বাধা দিয়া বলিলাম–কেন, উনি মন্দ কথা কী বলেছেন?
মনু উত্তেজিত স্বরে বলিল–তুমি চুপ করো।
কেন চুপ করব?
আলবৎ চুপ করবে।
মুখ সামলে কথা বলো, মনু।
তুমি মুখ সামলে কথা বলো কিন্তু বলে দিচ্ছি। জান কি, কোথায় এসেছ?
জানি বলেই বলছি! তোমরা ডাকাত, আমাকে চুরি করে এনেছ। আনোনি? তুমিও তাদের সাহায্য করেছ। আমার মা-বাপ নেই, তাঁদের জন্য আমার মন কাঁদে না? তুমি ভেবেছ কী মনু?
যিনি এনেছেন, তাঁর কাছে এসব কথা বলো ভাই, আমি আনিনি।
তুমি জান না কে এনেছে? তুমি কেন তাকে অনুরোধ করো না আমাকে ছেড়ে দিতে?
আমি ছেলেমানুষ, আমার কথা কে শুনবে? তবে একটা কথা তোমায় বলে দিচ্ছি, কখনো আমায় ডাকাত–একথা আর বলবে না। আমি তোমাকে বন্ধুর মতো ভালোবাসি, তাই বলছি একথা।
বললে না হয় তোমরা আমাকে মেরে ফেলবে, এ ছাড়া আর কী করবে?
আমাদের কাছে যাহারা আসিয়াছিল, তাহারা বেগতিক বুঝিয়া অনেকে সরিয়া পড়িল ইতিমধ্যে। কিন্তু সেই মেয়েটির কথা কখনো ভুলিব না। তিনি আমাদের কাছে আসিয়া মনুর ও আমার ঝগড়া থামাইবার জন্য অনেক চেষ্টা করিতে লাগিলেন।
আমাকে বার বার বলিলেন–চুপ করো বাবা–