মনু বলিল–পড়েছে?
তাই তো মনে হচ্ছে।
এগিয়ে চলো।
একটা গাছের তলায় দেখি অদ্ভুত উপায়ে পাতা একটা ফাঁদে একটা ছোটো বাঘের ছানা ধরা পড়িয়া বেড়ালের মতো মিউমিউ করিতেছে। বড়ো একটা গাছের গুঁড়ির দুই দিক দিয়া দুইটা তার বাঁধিয়া সামনের ফাঁদের ফাঁস বাঁধা। একটি বড়ো তার গাছটি বেষ্টন করিয়া ফাঁদ পর্যন্ত গিয়াছে। এই তারের কাজ বোধ হয় ফাঁদের ফাঁস শক্ত ও আঁটো করিয়া রাখা। বাঘ বা যেকোনো জানোয়ার অন্ধকারে এই স্থান দিয়া যাইবার সময় তারটি ঢিলা করিয়া দিবে, দিলেই তৎক্ষণাৎ নীচের ফাঁদে ফাঁস পড়িয়া যাইবে এবং জন্তুটি ফাঁসের মধ্যে আটকা পড়িবে।
আমাদের অত্যন্ত নিকটে আসিতে দেখিয়া ধৃত জন্তুটি লম্ফঝম্প দিতে আরম্ভ করিল। আমরা সকলেই বিষম আগ্রহে ও কৌতূহলে ছুটিয়া কাছে গেলাম। শুনিতে পাইলাম জন্তুটির ক্রুদ্ধ গর্জন।
হঠাৎ নিবারণ ও মনু হতাশ সুরে বলিয়া উঠিল–এঃ—
বলিলাম–কী? পালাচ্ছে নাকি?
নিবারণ বলিল–যাদু পালাবে সে-পথ নেই। কিন্তু দেখছ না—
দেখছি তো! বাঘের বাচ্ছা!
বাঘের বাচ্ছা অত সোজা নয়। মিথ্যে মিথ্যে ফাঁদ পাতা পরিশ্রম।
এঃ—
কী এটা তবে?
জানোয়ার চেনো না? এটা কী জানোয়ার ভালো করে দেখে বলো না?
বাঘের বাচ্ছা।
ছাই! তাহলে তো দুঃখ করতাম না।
মনু বলিল–ছুঁচো মেরে হাত কালো!
বলিলাম–তবে কী বেড়াল?
ঠিক ধরেছেন। সাবাস–এটা বনবেড়াল, তবে খুব বড়ো বনবেড়ালও নয়। এর চেয়েও বড়ো বনবেড়াল সুন্দরবনে অনেক আছে দেখতে পাবে। এটা ছোটো বনবেড়াল। সব মাটি!
বাঘ মারা পড়ে কিনা এমন ফাঁদে–আমি উহাকে জিজ্ঞাসা করি।
ও বলিল–নিশ্চয়ই।
এইরকম বাঘ?
না। দেখলে তোমার দাঁত লাগবে এমন বড়ো।
এখন এই বনবেড়ালটা নিয়ে কী করবে? ছেড়ে দেবে?
ও তো এখুনি ছাড়তে হবে। বাড়ি নিয়ে গেলে বকুনি শুনবে কে?
ফাঁস খুলিয়া বনবিড়ালটিকে মুক্ত করিয়া দিবার সঙ্গেসঙ্গে সেটা পালাইবার চেষ্টা করিল, কিন্তু পারিল না। উহার একখানা পা সম্ভবত খোঁড়া হইয়া গিয়াছিল। আমি কাছে গেলাম ধরিতে, কিন্তু সেটার গায়ে হাত দিবার আগেই থাবা তুলিয়া ফ্যাঁচ করিয়া কামড়াইতে আসিল।
মনু বলিল– আঁচড়ে কামড়ে দেবে, বনের জানোয়ার, খবরদার ওর কাছেও যেও না।
তা তো যাব না, কিন্তু বাঘের কী হল?
নিবারণ জানে।
নিবারণ মুখ ফিরাইয়া বলিল–বাঘ দেখাব তবে ছাড়ব, বড় হাসাহাসি হচ্ছে!
মনু বলিল–না ভাই, আমি হাসিনি। আমি তো জানি তোমায়।
আজই পারব না, তবে বাঘ দেখাবই। তবে আমার নাম নিবারণ।
বলিলাম– বেশ দেখিও। ফাঁদটা পাতো দেখি।
রাত্রে?
দোষ কী?
আজ রাত্রেই এ ফাঁদে বাঘ এনে ফেলতে পারি, তবে একটা টোপ চাই তাহলে।
কীসের টোপ? ছাগল?
ধৎ! বড়ো বাঘে ছাগল খেতে আসবে না, ও আসে কেঁদো বাঘে। হয় গোরু নয়তো দু বছরের বাছুর; কিন্তু মোষ হলে সবচেয়ে ভালো টোপ হত– মোষ বা মোষের বাচ্ছা। চলো আজ রাত্রে ফিরি। কাল সকালে ফাঁদ আবার পাতব।
নিবারণের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই হঠাৎ এক ভীষণ গর্জন শোনা গেল বাঘের। যেন হাঁড়ির ভেতর হইতে শব্দ বাহির হইতেছে নিকটে কোথাও। সমস্ত বন যেন কাঁপিয়া উঠিল। নিবারণ বলিল–আরে!
মনু বলিল–গাছে উঠবে?
না দাঁড়াও, আবার ডাকবে এখুনি। আগে বুঝি ও কী করছে।
তখন আবার সেই বিকট গর্জনধ্বনি। কেওড়া গাছের ডালপালা যেন কাঁপিয়া উঠিল। এত রাত্রে গভীর বনমধ্যে বাঘের ডাক কখনো শুনি নাই। এ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা।
আবার একবার গর্জন। এবার খুব যেন কাছে।
২. কেওড়া গাছ
মনু আমার হাত ধরিয়া একটা কেওড়া গাছে উঠিল। নিবারণ আমাদের পাশের একটা গরান গাছের আড়ালে লুকাইয়া দাঁড়াইল, গাছে উঠিল না। খানিকটা পরে সে দেখি গাছের গুঁড়ির ওদিক হইতে এদিকে ঘুরিতেছে। আমরা গাছে উঠিবার সময় জ্বলন্ত মশাল দুইটি মাটিতে নামাইয়া রাখিয়াছি, তাই বোধ হয় নিবারণ বাঁচিয়া গেল।
মনু আমার গা ঠেলিয়া নিঃশব্দে আঙুল দিয়া আমাদের ডান দিকের একটা বেতঝোঁপের দিকে দেখাইল। মশালের আলোতে দেখিয়া আমার গা কেমন করিয়া উঠিল। সমস্ত হাত-পা অবশ হইয়া গেল। প্রকান্ড একটা বাঘ ডান দিকের বেতঝোঁপ হইতে বাহির হইয়া খানিকটা আসিয়া দাঁড়াইয়া নিবারণের দিকে চাহিয়া আছে। মশালের আলো পড়িয়া উহার চক্ষু দুইটি জ্বলিয়া উঠিল। আবার নিবিয়া গেল। আবার জ্বলিয়া উঠিল। মনু জাতে মগ, সাহসী বীর বটে! ও দেখি নামিয়া পড়িতে চাহিতেছে নিবারণকে বাঁচাইবার জন্য। অথচ আমি জানি মনু সম্পূর্ণ নিরস্ত্র। মনু যদি লাফায়, তবে আমাকেও লাফাইয়া পড়িতে হইবে–আমি গাছে বসিয়া থাকিব না। কিন্তু কী লইয়া নামি? মাথার উপরের দিকে একটা মোটা ডালের সন্ধানে চাহিলাম। মরিতে হয় তো যুদ্ধ করিয়া মরিব। এমন সময় এক অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়িল। মনু উত্তেজিতভাবে আমাকে আর এক ঠেলা মারিল। সম্মুখে চাহিলাম। ওদিকের বড়ো কেওড়া গাছের ওপার হইতে একটা বাঘিনী বাহির হইয়া আমাদের গাছের তলার দিকে আসিতে আসিতে দাঁড়াইল, সম্ভবত জ্বলন্ত মশালের আলোয় ভয় পাইয়া। ঠিক বলা কঠিন। সঙ্গেসঙ্গে বাঘটা আরও আগাইয়া আসিল। তারপর দু-টিতে একত্র হইতেই বাঘিনী জিভ বাহির করিয়া বাঘের গা চাটিতে লাগিল। নিবারণ ঠিক উহাদের পাশেই কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়াইয়া আড়ষ্ট হইয়া আছে। উহার দিকে ইহারা দু-টিতে যেন অবজ্ঞাভরেই দৃষ্টি দিলে না। না, বেঁচে গেল এযাত্রা। বাঘ ও বাঘিনী ক্রমশ খালের উজানের জঙ্গলের দিকে চলিয়া গেল। আমরা হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিলাম। নিবারণের হাতের ইশারায় আমরা গাছ হইতে নামিলাম।