লোকটা বললে–কিছু বুঝলেন বাবু?
না:, তবে হিন্দুর সঙ্গে এ জিনিসের সম্পর্ক আছে বলে মনে হল। দেড় হাজার টাকার জিনিসটা তুমি যে বড়ো বিক্রি করে ফেলনি এতদিন?
ওই যে নটরাজন বলেছিল এই খোদাই-করা আঁক-জোকের মধ্যে আসল মালের হদিশ পাওয়া যাবে– সেই লোভেই একে হাতছাড়া করে ফেলিনি।
নটরাজনের স্ত্রী কোথায়?
তাকে কেটিউপ্পা গাঁয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি। মাসে মাসে টাকা পাঠাই। শহরে খরচ বেশি, গাঁয়ে খরচ কম। ঘর ভাড়া লাগে না। সেই সেদিনও পাঁচ টাকা ডাকে পাঠিয়েছি। এখন চাকরি নেই–নিজের পেটই চলে না।
কাগজপত্র আর ম্যাপগুলো?
ওই নটরাজনের স্ত্রী–তাকে আমি মা বলি– সেখানে তার কাছেই আছে। সঙ্গে নিয়ে বেড়াইনে, বড় দামি ও দরকারি জিনিস–আমার কাছে থাকলে হারিয়ে যেতে পারে। সে বুড়ি তার বেতের পেটরায় তুলে রেখে দিয়েছে, যখন দরকার হবে, নিয়ে আসব গিয়ে।
এসব আজ কত বছরের কথা হল?
বেশি দিনের নয়। আজ দু-বছর আগে আমি নটরাজনের গাঁয়ে গিয়ে বুড়ির সঙ্গে প্রথম দেখা করি।
তোমাকে একটা পরামর্শ দিই শোনো। এই মানিকখানা বিক্রি করে ফেলে টাকাটা নটরাজনের স্ত্রীকে দাওগে। তার জীবনটা একটু ভালোভাবে কাটবে। দেড় হাজার টাকা হাতে পেলে সে খুব খুশি হবে। তাদেরই জিনিস ধৰ্মত দেখতে গেলে, তোমার নিজের কাছে রাখা মানে চুরি করা।
কিন্তু বাবু, তাহলে হদিশ চলে গেল যে।
যাবে না। প্যারিস প্লাস্টারের ছাঁচে ওটা তুলে নিলেই চলে। ওই ছবিটার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক। মানিকখানা যার জিনিস, তাকে দাও ফিরিয়ে। তুমি যখন মা বলে ডাকো, তখন তার আশীর্বাদ তোমার বড়ো দরকার। মানিকখানা যদি বুড়ি বিক্রি করে, যে কিনবে সে ওর খোদাই ছবির কোনো মানে করতে পারবে না, তার কোনো কাজেই লাগবে না।
বেশ বাবুজি, আপনিই কাজটা করিয়ে দিন না?
কাল এটা সঙ্গে করে নিয়ে আমার সঙ্গে এখানে দেখা কোরো। আমার একটা জানাশুনো লোক আছে, সে এইসব কাজ করে–তাকে দিয়ে করিয়ে দেব।
রাত হয়ে গিয়েছিল। সুশীল মাঠ থেকে ফিরতে ফিরতে কত কথাই ভাবলে। তার মাথার মধ্যে যেন কেমন করছে। এ যেন আরব্য উপন্যাসের কাহিনির মতো অদ্ভুত! এমনভাবে গড়ের মাঠে বেড়াতে বেড়াতে একজন মুসলমান লশকরের সঙ্গে দেখা হবে– সে তাকে এমন একটি আজগুবি গল্প বলে যাবে–এ কখনো সে ভেবেছিল? গল্পটা আগাগোড়া গাঁজাখুরি বলে উড়িয়ে দিতেও পারত সে, যদি ওই চুনির সিলমোহরখানা সে না দেখত নিজের চোখে।
লোকটার গল্প যে সত্যি, তা ওই পাথরখানা থেকে বোঝা যাচ্ছে। সন তারিখ ও জায়গা মিলিয়ে এমনভাবে সে গল্প বলে গেল–যা অবিশ্বাস করা শক্ত। সুশীল ওকে শেষের দিকে। যে প্রশ্নটা করেছিল, অর্থাৎ কতদিন আগে বুড়ির সঙ্গে তার প্রথম দেখা হয়েছিল, সেটা শুধু সময় সম্বন্ধে তাকে জেরা করা মাত্র।
সুশীল বাড়ি গিয়ে সনৎকে বললে–এই কলকাতা শহরেই অনেক মজা ঘটে যায় দেখছি।
সনৎ বললে–কী দাদা?
সে একটা অদ্ভুত গল্প। যদি বলবার দরকার বুঝি তবে বলব—
পরদিন গড়ের মাঠে আবার সে নির্দিষ্ট জায়গাটিতে বসে রইল। একটু পরে জামাতুল্লা খালাসি এসে ওর পাশে নিঃশব্দে বসে পড়ল। বললে–আমার কথা ভাবলেন বাবুজি?
চলো আমার সঙ্গে। একটা ছাঁচ তোমাকে করিয়ে দিই। এনেছ ওটা?
হাঁ বাবুজি। দেখুন, আমি ভিক্ষে করে খাচ্ছি আজ দু-মাস, তবুও এত বড়ো দামি পাথরটা বিক্রি করিনি শুধু বড়ো একটা লাভের আশায়। কিন্তু যত দিন যাচ্চে, তত আমার মনে হচ্চে নসিব আমার খারাপ, নইলে সেই জায়গায় গিয়েও তো কিছু করতে–
জামাতুল্লা, তুমি লেখাপড়া-জানা লোক না হলেও খুব বুদ্ধি আছে। একা তুমি কিছু করতে পারবে না তা বেশ বোঝো। এ কাজে টাকা চাই, লোক চাই, জাহাজ চাই। অনেক টাকার খেলা সেসব। তোমার অত টাকা নেই। মিছে কেন নটরাজনের স্ত্রীর পাওনা জিনিস থেকে তাকে বঞ্চিত করবে?
২. প্যারিস প্লাস্টার
দু-একদিনের মধ্যে প্যারিস প্লাস্টারের ছাঁচটা হয়ে গেল। সুশীল প্রাচীন ধনী বংশের সন্তান, ওর যে ছাঁচ গড়িয়ে দিলে, সে ভাবলে ওদের পূর্বপুরুষের সম্পত্তি এটা। ফেরত দেওয়ার সময় সে বললে–এটা আমার এক বন্ধুকে একবার দেখতে দেবে?
কেন বল তো?
আমার সে বন্ধু মিউজিয়ামে কাজ করে। পন্ডিত লোক। যদি গভর্নমেন্টের তরফ থেকে এটা কিনে নেওয়া হয় তাই বলছি।
তাকে তোমার স্টুডিয়োতে কাল নিয়ে এসো।
পরদিন জামাতুল্লাকে নিয়ে সুশীল বন্ধুর স্টুডিয়োতে গিয়ে দেখলে একটি সৌম্যদর্শন ভদ্রলোক সেখানে বসে আছেন।
বন্ধুটি বলে উঠল–এই যে এসো সুশীল, ইনি এসে অনেকক্ষণ বসে আছেন–আলাপ করিয়ে দিই–ডা. রজনীকান্ত বসু, এম. এ., পিএইচ. ডি.–মিউজিয়ামে সম্প্রতি চাকুরিতে ঢুকেছেন।
কিছুক্ষণ পরে ডা. বসু পদ্মরাগের সিলমোহরের ওপর ঝুঁকে পড়ে ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে পরীক্ষা করতে করতে বিস্ময়ে প্রায় চিৎকার করে উঠে বললেন–এ জিনিসটা আপনি পেলেন কোথায়?
সুশীলের আর্টিস্ট বন্ধু বললে–ওটা ওদের বংশের জিনিস। ওরা পল্লিগ্রামের প্রাচীন ধনী বংশ।
ডা. বসু সন্দিগ্ধ মুখে বললেন–কিন্তু এ তো তা নয়! এ যে বহু পুরোনো জিনিস! এ আপনারা পেয়েছিলেন কোথায় তার ইতিহাস কিছু জানেন? যদি বলতে বাধা না থাকে–
সুশীল বললে–না ডা. বসু, আমি এ সম্বন্ধে কিছু বলতে পারব না। আপনি কী আন্দাজ করছেন।