খুব বুঝেছি, বলে যাও।
আমার মনে হল, আমি সেখানে গিয়ে পড়েছিলাম ঘুরতে ঘুরতে। সে পুরোনো শহর আমি দেখেছি। নটরাজন যা বের করতে পারেনি, আমি সেখানে একটা গোটা দিন কাটিয়েছি। এই জায়গা সুলু সি-র ধারে, তাও আমি জানি। যদিও ঠিক বলতে পারব না হয়তো–কিন্তু দূর থেকে দেখলে বোধ হয় চিনব।
ত্রিবাঙ্কুরের সেই গাঁয়ে গেলে না?
লোকটা বললে, প্রথমে ওর লোভ হয়েছিল খুব। পদ্মরাগ মণিটার দাম যাচাই করে দেখা গেল প্রায় দেড় হাজার টাকা দাম সেটার। তা ছাড়া আরও লোভ হল, নটরাজনের ছেলেকে ম্যাপ দেবার কী দরকার? এই ম্যাপের সাহায্যে সে-ই তো জায়গাটা খুঁজে বার করতে পারে। বিশেষ করে একবার যখন সেখানে সে গিয়েছিল। কিন্তু তিন-চার দিন ভাবার পরে ওর মনে হল মরবার আগে বিশ্বাস করে নটরাজন ওর হাতে জিনিসগুলো সঁপে দিয়েছে তার ছেলেকে দেবার জন্যে। এখন যদি না দেয়, তবে নটরাজনের ভূত ওর পেছনে লেগে থাকবে, হয়তো-বা মেরেও ফেলতে পারে। অতএব খানিকটা ইচ্ছা এবং খানিকটা অনিচ্ছাতে সেখানে যেতে সে বাধ্যই হল। বড়ো মজার ব্যাপার ঘটল কিন্তু সেখানে।
সুশীল বললে–কীরকম?
বাবুজি, অনেক কষ্ট করে বেউয়া কাপ্পিয়াম নদীর ধারে সেই কেটিউপ্পা গাঁয়ে গিয়ে পৌঁছোলাম। দেখলাম নটরাজন মিথ্যে বলেনি, নদীটা একেবারে ওদের গ্রামের নীচে দিয়েই গিয়েছে বটে। নিজের পকেট থেকে যাওয়ার খরচ করলাম। গাঁয়ে গিয়ে যাকেই জিজ্ঞেস করি, কেউ নটরাজনের ছেলের খোঁজ দিতে পারে না। নটরাজনের কথাই অনেকের মনে নেই। দু একজন বুড়ো লোক বললে, নটরাজনকে তারা চিনত বটে–তবে অনেকদিন আগে সে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়, তার স্ত্রী-ছেলেকে নিয়ে কোথায় চলে গিয়েছে তারা জানে না।
তারপর?
মানে খানিকটা আনন্দ যে না হল তা নয়। ছেলেকে যদি সন্ধান না করতে পারি তবে আমার দোষ কী! তবুও একে ওকে জিজ্ঞেস করি। শেষকালে গাঁয়ের কাছারিতে কী ভেবে গিয়ে খোঁজ করলাম। তারা শুনে বললে, অনেকদিন আগে নটরাজনের জায়গা-জমি নীলাম করতে হয়েছিল খাজনা না দেওয়ার জন্যে। নীলামের নোটিশ তারা পাঠিয়েছিল ত্রিবেন্দ্রাম শহরে।
পেলে খুঁজে?–
ঠিকানা তো খুঁজে বার করলাম। ছোট্ট একটা কাঠের বাড়ি, নারকেল গাছের বাগান সামনে। শহরের মধ্যে বাড়িটা নয়, শহর থেকে মাইল খানেক দূরে। অনেক ডাকাডাকির পর এক বুড়ি এসে দোর খুলে দিলে। মাথার চুল সব সাদা হয়েছে, অথচ মুখ দেখে খুব বয়স হয়েছে বলে মনে হয় না। বললে–কাকে চাও? আমি বললাম নটরাজনের ছেলের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। বুড়ি আমার মুখের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে বললে–ও নাম কোথায় শুনলে? ও নাম তো কেউ জানে না। আমি তখন সব কথা বুড়িকে বললাম। শুনে বুড়ি কেঁদে ফেললে। বললে–আমার ছেলেও আজ নিরুদ্দেশ, তার বাপের মতো সেও বেরিয়েছে– আজ তিন বছর হয়ে গেল। কোনো খবর পাইনি।
তুমি কী করলে?
এই কথা শুনে আমার বড়ো কষ্ট হল, বাবুজি। আমি সেখানে বুড়ির বাড়ি সাত-আটদিন রইলাম। তাকে মা বলে ডাকি। বুড়িও আমায় বড়ো যত্ন করতে লাগল। বুড়ি বড়ো গরিব ভাড়াটে ঘরে থাকে। তার ছেলে স্কুলে পড়ত। সে রাঁধুনিগিরি করে ছেলের পড়ার খরচ ও নিজেদের খরচ চালাত। এখনও সে নারকেল তেলের গুদামের শেঠজিদের বাড়ি রাঁধে। কোনোরকমে একটা পেট চলে যায়। বুড়িকে পদ্মরাগ মণিটা আমি দেখাইনি–
এত কষ্ট করে গিয়ে ওটার বেলা ফাঁকি দিলে?
ওই যে নটরাজন বলেছিল, পদ্মরাগ মণির গায়ে একটা আঁক-জোক আছে–যা হদিশ দেবে হীরে-জহরতের–ওই হল ওখানা না দেওয়ার গোড়ার কথা। ভাবলাম কী জানেন? ভাবলাম এই, নটরাজনের ছেলে না-পাত্তা–বুড়ির কাজ নয় ম্যাপ দেখে সুলু-সি যাওয়া আর সেই দ্বীপের মধ্যে লুকোনো শহর খুঁজে বার করা। যদি ওকে দিই ওগুলো এখানে পড়ে নষ্ট হবে। তার চেয়ে যদি আমি নিই, হয়তো চেষ্টা করলে একদিন-না-একদিন আমি সেখানে গিয়ে পৌঁছেতেও পারি। যদি হীরে-জহরত পাই, বুড়িকে আমি ভালোভাবে খোরপোশ দিয়ে রাখব। কিন্তু যদি পদ্মরাগ মণিখানা দিয়ে দিই–তবে হদিশটা হাতছাড়া হয়ে গেল। বুড়ি এখুনি অপরকে মণি বিক্রি করবে। যে কিনবে, সে মণির গায়ে আঁকা সিলমোহরের কোনো মানেই বুঝবে না। লোহার সিন্দুকে আটকা থাকবে জিনিসটা। তাতে কারো কোনো উপকার নেই। কী বলেন আপনি?
তোমার যুক্তি মন্দ না। যদিও আমার মনে হয় জিনিসটা দেওয়াই তোমার উচিত ছিল। যাদের জিনিস, তারা সেটা নিয়ে যা খুশি করুক না কেন। তোমার ওপর শুধু পৌঁছে দেওয়ার ভার। সেটা তুমি রাখলে নিজের কাছে?
হাঁ বাবুজি। এই দেখুন আমার কাছেই আছে। আসুন ওই আলোর কাছে।
সুশীল আলোর নীচে গিয়ে বিস্ময় ও কৌতূহলের সঙ্গে ওর প্রসারিত করতলের ওপর প্রায় ঝুঁকে পড়ল। মস্ত একখানা পাথর, একটু চ্যাপটা গড়নের, উজ্জ্বল সবুজ রঙের–তার ওপর খোদাই-কাজ করা।
সুশীল ওর হাত থেকে সিলমোহরটা নিয়ে দেখলে উলটে-পালটে। খোদাই-কাজ করা এত বড়ো পাথর সে কখনো দেখেনি। বড় সাইজের একটা কলার লজে°সের মতো। সিলমোহরের মধ্যে চেয়ে সে অবাক হয়ে গেল–বড়ো একটা ওঁকারের ওঁর ল্যাজ জড়িয়ে জড়িয়ে পাকিয়েছে একটা বট গাছ কিংবা অন্য কোনো গাছকে। তারপর সে আরও ভালো করে চেয়ে দেখলে–আসলে ওটা ওঁকার নয়, যদিও সেইরকম দেখাচ্ছে বটে। কোনো নাগদেবতার মূর্তি হওয়াও বিচিত্র নয়। ত্রিভুজাকৃতি কী একটা আঁকা রয়েছে ছবির বাঁ-দিকে। কোনো নাম বা সন-তারিখ নেই।