ওকে দেখে লোকটা ক্ষীণ কণ্ঠে তেলুগু ভাষায় বললে দেশের লোককে দেখতে পাইনে। যখন হংকং হাসপাতালে ছিলাম, অনেক দেশের লোক দেখতাম সেখানে। বোসস এখানে। আহা, ভারতের লোক তুমি! মুসলমান? তা কী? এতদূর বিদেশে তুমি শুধু ভারতের লোক, যে দেশের মাটিতে আমার জন্ম, সেই একই দেশের মাটিতে তোমারও জন্ম। এখানে তুমি আমার ভাই।
ও রোগীর বিছানার পাশে বসল। সেই অপরিচিত মুমূর্ষ স্বদেশবাসীকে দেখে ওর মনে একটা গভীর অনুকম্পা ও মমতা জেগে উঠল– যেন সত্যিই কতকালের আপনার জন।
রোগী বললে–আমার নাম নটরাজন, ত্রিবেন্দ্রাম শহর থেকে এগারো মাইল দূরে কাটিউপ্পা বলে ছোট্ট একটি গ্রামে আমার বাড়ি। কোচিন থেকে যে স্টিমলঞ্চ ছাড়ে ত্রিবেন্দ্রাম যাবার জন্যে, সে স্টিমার আমার গ্রামের ঘাট ছুঁয়ে যায়। বেউয়া কাপ্পিয়াম নদীর ধারে, চারিধারে ঘন আর ছোটো ছোটো পাহাড় কাটিউস্লা গ্রাম তুমি দেখোনি, বুঝতে পারবে না সে কী চমৎকার জায়গা। আমি অনেক দেশ বেড়িয়েছি পৃথিবীর, ভবঘুরে হয়ে চিরদিন কাটিয়ে দিলাম জীবনটা–কিন্তু আমি তোমায় বলছি শোনো, ভারতবর্ষের মধ্যে তো বটেই, এমনকী পৃথিবীর মধ্যে ত্রিবাঙ্কুর একটি অদ্ভুত সুন্দর দেশ। কিন্তু আমার দেশের বর্ণনা শোনাবার জন্যে আজ তোমায় আমি ডাকিনি। আমার দিন শেষ হয়ে এসেছে, কাল যে সূর্যদেব উঠবে আকাশে, তা আমি চোখে বোধ হয় দেখতে পাব না–তুমি আমার দেশবাসী ভাই, একটা উপকার করবে আমার?
কী বলুন? আপনি আমার চাচার বয়সি, যা হুকুম করবেন বলুন। সম্ভব হলে নিশ্চয়ই করব।
রোগীর পান্ডুর মুখ অল্পক্ষণের জন্যে আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল–নিবুনিবু প্রদীপের শিখার মতো। ওর দিকে গভীর দৃষ্টিতে চেয়ে বললে–কথা দিলে? কিন্তু ভীষণ লোভ দমন করতে হবে ভাই!
আল্লার নামে বলছি, যা করতে বলবেন, তাই করব।
আমার মাথার বালিশের তলায় একটা চামড়ার ব্যাগ আছে, সেটা বার করে নাও। আমার মৃত্যুর পরে ব্যাগটা আমার গ্রামে আমার স্ত্রীর কাছে পৌঁছে দেবে।
ও রোগীর মাথাটা সন্তর্পণে একধারে সরিয়ে আস্তে আস্তে একটা ছোটো চামড়ার ব্যাগ বার করলে। ব্যাগের মধ্যে কতগুলো কাগজপত্র ছাড়া আর কিছু আছে বলে মনে হল না ওর।
বৃদ্ধ নটরাজন বললে–তোমার কাছে আমি কোনো কথা লুকোব না। ব্যাগটার মধ্যে একখানা ম্যাপ আছে–জীবনে অনেক সাহসের কাজ করেছি, অনেক বনে-জঙ্গলে ঘুরেছি –অনেকরকম লোকের সঙ্গে মিশেছি। এই ম্যাপখানা এবং ব্যাগের মধ্যে যা যা আছে–তা আমি সৎপথে থেকে হস্তগত করিনি। সংক্ষেপে কথাটা বলে নিই, কারণ বেশি বলবার আমার সময় বা শক্তি নেই। আজ বিশ-বাইশ বছর আগে এই ব্যাগ আমার হস্তগত হয়। যে ম্যাপখানা এই ব্যাগের মধ্যে আছে–তার সাহায্যে যেকোনো লোক দুনিয়ায় মহাধনী লোক হয়ে যেতে পারে। সুলু সি-র একটা খাড়ির ধারে নিবিড় জঙ্গলের মধ্যে প্রাচীন আমলের এক নগরের ভগ্নস্তূপ আছে। সেই নগর প্রাচীন যুগের এক হিন্দু রাজ্যের রাজধানী ছিল। তার এক জায়গায় প্রচুর ধনরত্ন লুকোনো আছে। যার কাছ থেকে এ ম্যাপ আমি পাই, সে আমারই বন্ধু, দু-জনে মিলে সুলু সমুদ্রে বোম্বেটেগিরি করেছি দশ বছর ধরে। সে জাতিতে মালয়, ম্যাপ তার তৈরি– সে নিজে ওই শহরের সন্ধান খুঁজে বার করেছিল। সেখানে নিজের প্রাণ বিপন্ন করে, সামান্য কিছু পাথর ছাড়া সে বেশি কোনো জিনিস আনতে পারেনি সেখান থেকে। তার নিজের লেখা জাহাজের লগ বুকের (Log Book) কয়েকখানা পাতা আমি মালয় ভাষা থেকে নিজের সুবিধার জন্যে ইংরেজিতে অনুবাদ করিয়ে নিই সৌরাবায়াতে এক গরিব মালয় স্কুল মাস্টারকে ধরে। সেই অনুবাদের কাগজখানাও এই ব্যাগের মধ্যে আছে। তারপর ম্যাপখানা হস্তগত করে আমি নিজে অনেক খোঁজাখুঁজি করি–কিন্তু সুলু সমুদ্র ও ওদিকের বহুশত বসতিহীন ও বসতিযুক্ত ছোটো ও বড়ো দ্বীপ– তাদের প্রত্যেকটিতে ভীষণ জঙ্গল। ম্যাপেও যা আছে, তা খুব নিখুঁত নয় মোটের ওপর সে-দ্বীপ আমি বার করতে পারিনি। দেশের গ্রামে আমার ছেলে আছে, তাকে নিয়ে গিয়ে ম্যাপটা আর ব্যাগ দিও। এর মধ্যে আর একটা জিনিস আছে–আমার বোম্বেটে বন্ধু সেই প্রাচীন শহরে একটা জিনিস পায়। জিনিসটা একটা সিলমোহর বলেই মনে হয়। একখানা গোটা পদ্মরাগ মণির ওপর সিলমোহরটা খোদাই করা। সেটা এর মধ্যে আছে। সেই মোহরের ওপর যে অদ্ভুত চিহ্নটি আঁকা আছে–আমার বিশ্বাস ছিল, সেটা একটা বড়ো হদিশ ওই প্রাচীন নগরীর রত্নভান্ডারের। তাই ওখানা আমি কবচের মতো গলায় ঝুলিয়ে বেড়িয়েছি এতদিন। কিন্তু আজ বুঝেছি আমার দিন শেষ হয়ে এসেছে। উনিশ বছর আগে গ্রাম থেকে যখন চলে আসি, তখন আমার ছেলে ছিল দু-বছরের–আর আমার স্ত্রী-পুত্রকে দেখিনি এই উনিশ বছরের মধ্যে। বেঁচে থাকলে আজ সে একুশ-বাইশ বছরের যুবক। তার হাতে এগুলো সব দিয়ে বলে দিও, বাপের ছেলে যদি হয়, সে যেন খুঁজে বার করে সেই নগরী, তার বাবা যা পারেনি। আর আমার কিছু বলবার নেই! ব্যাগটা নাও হাতে তুলে।
রোগী এই পর্যন্ত বলে ক্লান্তিতে চোখ বুজল। চীনা আড্ডাধারীর ইঙ্গিতে ও রোগীর ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
সুশীল বললে–তারপর?
বাবুজি, যখন ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম, নটরাজন বাঁচল কি মারা গেল সেদিকে কোনো খেয়াল করিনি। আমার মাথা তখন ঘুরছে। ব্যাগ খুলে দেখলাম কতকগুলো পুরোনো কাগজপত্র ও ম্যাপখানা ছাড়া আর কিছুই নেই। পদ্মরাগ মণিটা নেড়ে-চেড়ে দেখে কিছু বুঝলাম না–ওসব জিনিসের আমরা কী বুঝি বলুন! কিন্তু তখন আমার আর একটা বড়ো কথা মনে হয়েছে। নটরাজন যখন ওর গল্প করছিল, আমার মনে পড়ল সাত বছর আগের সেই ঘটনা। জাহাজে সেই কলেরা হওয়া, আমার জাহাজ থেকে পালানো এবং বন-জঙ্গলের মধ্যে সেই বিহ্মমুনির দেশের মধ্যে গিয়ে পড়া, বুঝলেন না বাবুজি?