ও বললে–কত বড়ো বনমানুষ?
খুব বড়ো বাবুজি। ইন্দোরের পালোয়ন রামনকিব সিং-এর চেয়েও একটা বাচ্চার গায়ে জোর বেশি। নিজের আঁখসে দেখলাম।
কী করে দেখলে?
ডাল ফাড়লে হাত আর পা দিয়ে ধরে! আমার মাথার ওপর গাছপালার ডালগুলো তো বনমানুষে বিলকুল ভরতি হয়ে গিয়েছিল।
তবে তো তুমি সুমাত্রা দ্বীপে কিংবা বোর্নিওতে গিয়েছিলে কিংবা ওর কাছাকাছি কোনো ছোটো দ্বীপে। তুমি যে বনমানুষ বলছ–ও হচ্ছে ওরাং ওটাং-ও ছাড়া আর কোনো বনমানুষ ও দেশে থাকবে না–
লোকটা হঠাৎ অত্যন্ত বিস্ময়ে সুশীলের মুখের দিকে চেয়ে বলে উঠল–দাঁড়ান–দাঁড়ান, বাবুজি, কী জায়গার নাম করলেন আপনি?
সুমাত্রা আর বোর্নিও–
ওঃ, বাবুজি, আপনি বহুৎ পড়ালিখা আদমি! এই না, কতকাল শুনিনি জানেন? আজ দশ বারো বছর। শেষের নামটা–কী বললেন বাবুজি? বোর্নিও? ঠিক। সুলু সি-র নাম জাহাজি চার্টে দেখবেন। সুলু সি-র কাছাকাছি, এপার-ওপার। কেন জানেন বাবুজি? এই নাম শুনলে আমার বহুত কথা মনে পড়ে যায়! তাজ্জব কথা! আজ দেখচেন আমায় এই গড়ের মাঠে বসে দু-একটা পয়সা ভিক্ষে করছি–কিন্তু আমি আজ–আচ্ছা, সেকথা এখন থাক।
তারপর কী করলে বলো না! জঙ্গল থেকে এসে উঠলে আবার জাহাজে?
হ্যাঁ, উঠলাম। সেই কাপ্তান তখন মদ খেয়ে বেহুঁশ হয়ে নিজের কেবিনে চাবি দিয়ে ঘুমোচ্ছে–আমি আগে তো ভাবলাম মরে গিয়েছে। মড়াগুলি কতক কাপ্তান ফেলে দিয়েছে –কতক তখনও রয়েছে। ভীষণ বদ গন্ধ–আর সেই গরম! আমি জাহাজের কিছু খেতে পারিনে কলেরার ভয়ে। ডাঙায় গিয়ে মাছ ধরতাম–আর কচ্ছপ।
কাপ্তেন বেঁচে ছিল?
বেঁচে ছিল, কিন্তু বেচারির মগজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল একেবারে। তখনকার দিনে বেতার ছিল না, আমাদের জাহাজে যে অমন হয়ে গেল, সে খবর কোথাও দেওয়া যায়নি। ওসব দিকের সমুদ্রে জাহাজ বেশি চলাচল করে না–জাহাজের লাইন নয়। এগারো দিন পরে সৌরাবায়া থেকে জাহাজ যাচ্ছিল পাসারাপং,–তারা আমাদের আগুন দেখে এসে জাহাজে তুলে নিয়ে বাঁচায়।
কীসের আগুন?
ডুবো পাহাড়ের খানিকটা ভাটার সময় বেরিয়ে থাকত। পাটের থলে জ্বালিয়ে সেখানে রোজ আগুন করতাম–অন্য জাহাজের যদি চোখে পড়ে। তাতেই তো বেঁচে গেলাম।
এ পর্যন্ত শুনে সুশীল বুঝতে পারলে না লোকটার ভাগ্য কীসে ফিরেছিল। তবে লোকটা যে মিথ্যা কথা বলছে না, ওর কথার ধরন থেকে সুশীলের তা মনে হল। কিন্তু এইবার লোকটা যে কাহিনি বললে, তা শেষ পর্যন্ত শুনে সুশীল বিস্মিত ও মুগ্ধ হয়ে গেল– অল্পক্ষণের জন্য সারা গড়ের মাঠ, এমনকী বিরাট কলকাতা শহরটাই যেন তার সমস্ত আলোর মালা নিয়ে তার চোখের সামনে থেকে গেল বেমালুম মুছে–বহু দূরের কোনো বিপদসংকুল নীল সমুদ্রে সে একা পাড়ি জমিয়েছে বহুকালের লুকোনো হীরে-মানিক-মুক্তোর সন্ধানে–পৃথিবীর কত পর্বতে, কন্দরে, মরুতে, অরণ্যে অজানা স্বর্ণরাশি মানুষের চোখের আড়ালে আত্মগোপন করে আছে–বেরিয়ে পড়তে হবে সেই লুকোনো রত্নভান্ডারের সন্ধানে –পুরুষ যদি হও! নয় তো অফিসের দোরে দোরে মেরুদন্ডহীন প্রাণীদের মতো ঘুরে ঘুরে সেলাম বাজিয়ে চাকুরির সন্ধান করে বেড়ানোই যার একমাত্র লক্ষ্য, তার ভাগ্যে নৈব চ, নৈব চ!
এই খালাসিটা হয়তো লেখাপড়া শেখেনি, হয়তো মার্জিত নয়–কিন্তু এ সপ্ত সমুদ্রে পাড়ি জমিয়ে এসেছে, দুনিয়ার বড়ো বড়ো নগর বন্দর, বড়ো বড়ো দ্বীপ দেখতে কিছু বাকি রাখেনি–এ একটা পুরুষ মানুষ বটে–কত বিপদে পড়েছে, কত বিপদ থেকে উদ্ধার হয়েছে!
বিপদের নামে ত্রিশ হাত পেছিয়ে থাকে যারা, গা বাঁচিয়ে চলবার ঝোঁক যাদের সারাজীবন ধরে, তাদের দ্বারা না ঘুচবে অপরের দুঃখ, না ঘুচবে তাদের নিজেদের দুঃখ। লক্ষ্মী যান না কাপুরুষের কাছে, অলসের কাছে–তাদের তিনি কৃপা করেন যারা বিপদকে, বিলাসকে, আরামপ্রিয়তাকে তুচ্ছ বোধ করে।
জাহাজ সৌরাবায়া এসে পৌঁছোবার সঙ্গেসঙ্গে ওদের দুজনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। সত্যিই ক্লান্তিতে, অনিদ্রায়, দুশ্চিন্তায়, অখাদ্য ভক্ষণে ওদের শরীর ভেঙে পড়েছিল। দিন পনেরো হাসপাতালে শুয়ে থাকবার পরে ক্রমশ ওর শরীর ভালো হয়ে গেল– কাপ্তেনের মস্তিষ্ক-বিকৃতির লক্ষণও ক্রমে দূর হল।
ওদের জন্যে কিছু টাকা চাঁদা উঠেছিল, ও হাসপাতাল থেকে যেদিন বাইরে পা দিলে, সেদিন এক দয়াবতী মেমসাহেব ওকে টাকাটা দিয়ে গেলেন। দুস্থনাবিকদের থাকবার জন্যে গভর্নমেন্টের একটা বাড়ি আছে সেখানে ওকে বিনি খরচায় থাকবার অনুমতি দেওয়া হল।
এই বাড়িতে সে প্রায় দু-মাস ছিল, তারপর অন্য জাহাজে চাকরি নিয়ে ওখান থেকে চলে আসে। তারপর পাঁচ-সাত বছর কেটে গেল। ও যেমন জাহাজে কাজ করে তেমনি করে যাচ্ছে। প্রাচ্যদেশের বড়ো বড়ো বন্দরের মদের দোকান ও জুয়ার আড্ডার সঙ্গে তখন সে সুপরিচিত।
একবার তাদের জাহাজ ম্যানিলাতে থেমেছে। ও অন্যান্য লস্করদের সঙ্গে নিয়ে এক পরিচিত জুয়ার আড্ডায় উঠেছে–এমন সময়ে আড্ডাধারী এসে ওকে বললে–একবার এসো তো! তোমাদের দেশের একজন লোক তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়।
ও অবাক হয়ে বললে–আমাদের দেশের?
আড্ডাধারী চীনাম্যান হেসে বললে–হ্যাঁ, ইণ্ডিয়ার। এতকাল দোকান করছি বন্দরে, ইণ্ডিয়ান মানুষ চিনিনে?
ও আড্ডাধারীর পিছু পিছু গিয়ে দেখলে জুয়ার আড্ডার পেছনে একটা পায়রার খোপের মতো ছোট্ট ভীষণ নোংরা ঘরে একজন লোক শুয়ে। লোকটার বয়স কত ঠিক বোঝবার জো নেই–চল্লিশও হতে পারে, আবার ষাটও হতে পারে। বিছানার সঙ্গে যেন সে মিশে গিয়েছে বহুদিন ধরে অসুখে ভুগে।