তার বাড়ি আগে ছিল পশ্চিমে। কিন্তু অনেকদিন থেকে সে বাংলা দেশে আছে এবং বাঙালি খালাসিদের সঙ্গে কাজ করে বাংলা শিখেছে। লোকটা মুসলমান, ওর নাম জামাতুল্লা। একবার কয়েকজন তেলুগু লস্করের সঙ্গে সে একটা জাহাজে কাজ করে–ডাচ ইস্ট-ইণ্ডিজের বিভিন্ন দ্বীপে নারকোল-কুচি বোঝাই দিয়ে নিয়ে যেত মাদ্রাজ থেকে। সেই সময় একবার তাদের জাহাজ ডুবো-পাহাড়ে ধাক্কা লেগে অচল হয়ে পড়ে। সৌরাবায়া থেকে তাদের কোম্পানির অন্য জাহাজ এসে তাদের জাহাজের মাল তুলে নিয়ে যাবার আগে সাতদিন ওরা সেইখানে পড়েছিল। একদিন সমুদ্রের বিষাক্ত কাঁকড়া খেয়ে জাহাজসুদ্ধ লোকের কলেরা হল।
এইখানে সুশীল জিজ্ঞেস করলে–সবারই কলেরা হল?
কেউ বাদ ছিল না বাবু। খাবার পাওয়া যেত না, পাহাড়ের একটা গর্তে কাঁকড়া পেয়ে সেদিন ওরা তাই ধরেছিল। ছোটো-ছোটো–লাল কাঁকড়া।
তারপর?
দু-জন বাদে বাকি সব সেই রাত্রে মারা গেল। বাবুজি, সে-রাতের কথা ভাবলে এখনও ভয় হয়। সতেরো জন দিশি লস্কর আর দু-জন ওলন্দাজ সাহেব–একজন মেট আর একজন ইঞ্জিনিয়ার–সেই রাত্রে সাবাড়। রইলাম বাকি কাপ্তান আর আমি।
তারপর জাহাজের কাপ্তান ওকে বললে–মড়াগুলি টান দিয়ে ফেলে দাও জলে—
ও বললে–আমি মুদাফরাশ নই সাহেব, ও আমি ছোঁব না—
সাহেব ওকে গুলি করে মারতে এল। ও গিয়ে লুকোলো ডেকের ঢাকনি খুলে হোল্ডের মধ্যে। সেই রাত্রে কাপ্তান সাহেব খুব মদ খেয়ে চিৎকার করে গান গাইছে–ও সেই সময় জাহাজের বোট খুলে নিয়ে নামাতে গেল।
ডেভিট থেকে বোট নামাবার শব্দে সাহেবের মদের নেশা ভাঙল না তাই নিস্তার ডেকের ওপরে তখন দুটো মড়া পড়ে রয়েছে–মরণের বীজ জাহাজের সর্বত্র ছড়ানো, ভয়ে ও কিছু খায়নি সকাল থেকে, পাছে কলেরা হয়। সুতরাং অনাহারে ও ভয়ে খানিকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে।
দূরে ডাঙা দেখা যাচ্ছিল, দুপুরের দিকে ও লক্ষ করেছিল। সারারাত নৌকো বাইবার পর ভোরে এসে বোট ডাঙায় লাগল। ও নেমে দেখে ডাঙায় ভীষণ জঙ্গল–ওদেশের সব দ্বীপেই এ ধরনের জঙ্গল ও জানত। লোকজনের কোনো চিহ্ন নেই কোনোদিকে।
বোট ডাঙায় বেঁধে ও জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে দু-দিন হাঁটলে, শুধু গাছের কচি পাতা আর এক ধরনের অম্ল-মধুর ফল খেয়ে। মানুষের বসতির সন্ধানে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে জঙ্গলের মধ্যে এক জায়গায় এসে হঠাৎ একেবারে ও অবাক হয়ে গেল।
ওর সামনে প্রকান্ড বড়ো সিংহদরজা–কিন্তু বড়ো বড়ো লতাপাতা উঠে একেবারে ঢেকে ফেলে দিয়েছে। সিংহদরজার পর একটা বড়ো পাঁচিলের খানিকটা–আরও খানিক গিয়ে একটা বড়ো মন্দির, তার চুড়ো ভেঙে পড়েছে–মন্দিরের গায়ে হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তি বলে তার মনে হল। সে ভারতের লোক, হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তি সে চেনে। এ ক্ষেত্রে হয়তো সে ঠিক চিনতে পারেনি–তবে তার ওইরকম বলেই মনে হয়েছিল।
অবাক হয়ে সে আরও ঘুরে ঘুরে দেখলে। জায়গাটা একটা বহুকালের পুরোনো শহরের ভগ্নস্তূপ মনে হল। কত মন্দির, কত ঘর, কত পাথরের সিংহদরজা, গভীর বনের মধ্যে বড়ো বড়ো কাছির মতো লতার নাগপাশ বন্ধনে জড়িয়ে কত যুগ ধরে পড়ে আছে। ভীষণ বিষধর সাপের আড্ডা সর্বত্র। একটা বড়ো ভাঙা মন্দিরে সে পাথরের প্রকান্ড বড়ো মূর্তি দেখেছিল–প্রায় আট-দশ হাত উঁচু।
সন্ধ্যা আসবার আর বেশি দেরি নেই দেখে তার বড়ো ভয় হয়ে গেল। এসব প্রাচীনকালের নগর শহর–জিন পরীর আচ্ছা, তেলুগু লস্করেরা যাকে ওদের ভাষায় বলে বিহ্মমুনি।
বিহ্মমুনি বড়ো ভয়ানক জিন, হিন্দুদের পুরোহিত মারা যাওয়ার পর বিহ্মমুনি হয়। এই গহন অরণ্যের মধ্যে লোকহীন পরিত্যক্ত বহু প্রাচীন নগরীর অলিতে-গলিতে ঝোপে ঝোপে ধুম্রবর্ণ, বিকটাকার, কত যুগের বুভুক্ষু বিহ্মমুনির দল সন্ধ্যার অন্ধকার পড়বার সঙ্গে সঙ্গে শিকারের সন্ধানে জাগ্রত হয়ে উঠে হাঁক পাড়ে–ম্যায় ভুখা! তাদের হাতের নাগালে
পড়লে কি আর রক্ষে আছে? অতএব এখান থেকে পালানোই একমাত্র বাঁচবার পথ।
সুশীল এক মনে শুনছিল, পালিয়ে গেলে কোথায়?
সেই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আবার দু-দিন তিন দিন ধরে হেঁটে সমুদ্রের ধারে পৌঁছোলাম। জাহাজে উঠব এসে এই তখন খেয়াল।
আবার সেই মড়া-ভরতি জাহাজে কেন?
বুঝলেন না বাবুজি? যদি জাহাজে উঠি, তবে তো দেশে পৌঁছোবার ঠিকানা মেলে। নয়তো সেই জংলি মুলুকে যাব কোথায়? চারিধারে সমুদ্র, যদি জাহাজ না পাই তবে সেই জংলি মুলুকে না খেয়ে মরতে হবে–নয়তো জংলি লোকেরা খুন করে ফেলবে। বাবুজি, তখন এমন ডর, যে রাতে ঘুমোতে পারি নে। একদিন প্রকান্ড এক বনমানুষের হাতে পড়তে পড়তে বেঁচে গেলাম–নসিবের জোর খুব। অমন ধরনের জানোয়ার যে দুনিয়ায় আছে তা জানতাম না। গাছের ওপর একদল বনমানুষ ছিল–ধাড়িটা আমার দেখতে পেলে না বাবুজি, দেখলে আর বাঁচতাম না।
সুশীল মনে মনে একবার চিন্তা করে দেখলে। লোকটা মিথ্যা কথা বলছে না সত্যি বলছে, ওর এই বনমানুষের কথা তার একটা মস্ত বড়ো পরীক্ষা। সুশীল জন্তুজানোয়ার সম্বন্ধে কিছু কিছু পড়াশুনো করেছিল, বাড়িতে আগে নানারকম পাখি, বেঁজি, খরগোশ, সজারু, ও বাঁদর পুষত। গাঁয়ের লোকে ঠাট্টা করে বলত, মুস্তাফিদের চিড়িয়াখানা। এ সম্বন্ধে ইংরেজি বইও নিজের পয়সায় কিনেছিল।