সুশীলের মনে কৌতূহল হওয়াতে সে বললে–তুমি কোথায় থাক?
মেটেবুরুজে বাবুজি।
কিছু কর নাকি?
জাহাজে কাজ করতাম, এখন কাজ নেই। ঘুরি-ফিরি কাজের খোঁজে। রোটির জোগাড় করতে হবে তো?
লোকটার সম্বন্ধে সুশীলের কৌতূহল আরও বেড়ে উঠল। তা ছাড়া লোকটার কথাবার্তার ধরনে মনে হয় লোকটা খুব খারাপ ধরনের নয় হয়তো। সুশীল বললে–জাহাজে কতদিন খালাসিগিরি করছ?
দশ বছরের কুছু ওপর হবে।
কোন কোন দেশে গিয়েছ?
সব দেশে। যে দেশে বলবেন সে দেশে। জাপান লাইন, বিলেত লাইন, জাভা-সুমাত্রার লাইন–এস এস পেনগুইন, এস এস গোলকুন্ডা–এস এস নলডেরা, পিয়েনোর বড়ো জাহাজ নলডেরা, নাম শুনেছেন?
পিয়েনো কী জিনিস, পল্লিগ্রামের সুশীল তা বুঝতে পারলে না। না, ওসব নাম সে শোনেনি।
তা বাবুজি, আপনার কাছে ছিপাব না। সরাব পিয়ে পিয়ে কাজটা খারাবি হয়ে পড়ল, জাহাজ থেকে ডিসচার্জ করে দিলে। এখন এই কোষ্টো যাচ্ছে, মুখ ফুটে কাউকে বলতে ভি পারিনি। কী করব, নসিব বাবুজি!
জাহাজের কাজ আবার পাবে না?
পাব বাবুজি, ডিসচার্জ সাটিক-ফিটিক ভালো আছে। সরাব টরাবের কথা ওতে কুছু নেই। কাপ্তানটা ভালো লোক, তাকে কেঁদে গোড়-পাকড়ে বললাম–সাহেব আমার রোটি মেরো না। ওকথা লিখো না!
লোকটি আর-একটু কাছে এসে ঘেঁষে বসল। বললে–আমার নসিব খারাপ বাবু–নয় তো আমায় আজ চাকরি করে খেতে হবে কেন? আজ তো আমি রাজা!
সুশীল মৃদু কৌতূহলের সুরে জিজ্ঞাসা করলে–কীরকম?
লোকটি এদিক-ওদিক চেয়ে সুর নামিয়ে বললে–আজ আর বলব না। এইখানে কাল আপনি আসতে পারবেন?
কেন পারব না?
তাই আসবেন কাল। আচ্ছা বাবু, আপনি পুরোনো লিখা পড়তে পারেন?
সুশীল একটু আশ্চর্য হয়ে ওর মুখের দিকে চেয়ে বললে–কী লেখা?
সে কাল বালাব। আপনি কাল এখানে আসবেন, তবে, বেলা থাকতে আসবেন–সুর ডুববার আগে।
মামার বাসায় এসে কৌতূহলে সুশীলের রাতে চোখে ঘুমই এল না। এক-একবার তার মনে হল, জাহাজি মাল্লা কত দূর কত দেশ ঘুরেছে, কোনো এক আশ্চর্য ব্যাপারের কথা কি তাকে বলবে? কেননা নতুন দেশের কথা? পুরোনো লেখা কীসের? …
ওর ছোটো মামাতো ভাই সনৎ ওর পাশেই শোয়। গরমে তারও চোখে ঘুম নেই। খানিকটা উশখুশ করার পরে সে উঠে সুইচ টিপে আলো জ্বাললে। বললে–দাদা চা খাবে? চা করব?
এত রাত্তিরে চা কী রে?
কী করি বল। ঘুম আসছে না চোখে–খাও একটু চা।
সনৎ ছেলেটিকে সুশীল খুব পছন্দ করে। কলেজে ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র, লেখা-পড়াতেও ভালো, ফুটবল খেলায় এরই মধ্যে বেশ নাম করেছে, কলেজ টিমের বড়ো বড়ো ম্যাচে খেলবার সময় ওকে ভিন্ন চলে না।
সনৎ-এর আর একটা গুণ, ভয় বলে কোনো জিনিস নেই তার শরীরে। মনে হয় দুনিয়ার কোনো কিছুকে সে গ্রাহ্য করে না। দু-বার এই স্বভাবের দোষে তাকে বিপদে পড়তে হয়েছিল, একবার খেলার মাঠে এক সার্জেন্টের সঙ্গে মারামারি করে, নিজে তাতে মার খেয়েছিলও, খুব-মার দিয়েছিলও। সেবার ওর বাবা টাকাকড়ি খরচ করে ওকে জেলের দরজা থেকে ফিরিয়ে আনেন। আর একবার মাহেশের রথতলায় একটি মেয়েকে গুণ্ডাদের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে গুন্ডার ছুরিতে প্রায় প্রাণ দিয়েছিল আর-কী। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক যুবকদল ওকে গুণ্ডাদের মাঝখান থেকে টেনে উদ্ধার করে আনে।
সুশীল বললে–সনৎ কতদূর লেখাপড়া করবি ভাবছিস?
দেখি দাদা। বি. এসসি. পর্যন্ত পড়ে একটা কারখানায় ঢুকে কাজ শিখব। কলকবজার দিকে আমার ঝোঁক, সে তো তুমি জানই–
আমি যদি কোনো ব্যবসায় নামি, আমার সঙ্গে থাকবি তুই?
নিশ্চয়ই থাকব। তুমি যেখানে থাকবে, যা করবে–আমি তাতে থাকি এ আমার বড়ো ইচ্ছে কিন্তু। কী ব্যাবসা করবে ভাবছ দাদা?
আচ্ছা, কাউকে এখন এসব কিছু বলিস নে। তোকে আমি জানাব ঠিক সময়ে। তোকে নইলে আমার চলবে না। চল আজ শুয়ে পড়ি–রাত দুটো বাজে–
পরদিন সুশীল গড়ের মাঠে নির্দিষ্ট জায়গাটিতে গিয়ে একা বসে রইল। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল–তবুও লোকটির দেখা নেই।
অন্ধকার নামল। আসবে না সে লোক? হয়তো নয়। কী একটা বলবে ভেবেছিল কাল, রাতারাতি তার মন ঘুরে গেছে।
রাত আটটার সময় সুশীল উঠতে যাবে, এমন সময়ে পেছনে পায়ের শব্দ শুনে সে চেয়ে দেখলে।
পরক্ষণেই তার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
লোকটা ঠিক তার পেছনেই দাঁড়িয়ে।
সেলাম, বাবুজি! মাপ করবেন, বড়ো দেরি হয়ে গেল। এই দেখুন–
লোকটার পায়ের ওপর দিয়ে ভারি একটা জিনিস চলে গিয়েছে যেন। সাদা কাপড়ের ব্যাণ্ডেজ বাঁধা–কিন্তু ব্যাণ্ডেজ রক্তে ভিজে উঠেছে।
সুশীল বললে–এঃ, কী হয়েছে পায়ে?
এই জন্যেই দেরি হয়ে গেল বাবুজি। বাড়ি থেকে বেরিয়েছি, আর একটা ভারী হাতেঠেলা গাড়ি পায়ের ওপর এসে পড়ল। দু-জন লোক ঠেলছিল, তাদের সঙ্গে মারামারি হয়ে গেল আমার সঙ্গের লোকদের।
বোসো বোসো। তোমার পায়ে দেখছি সাঙ্ঘাতিক লেগেছে! না এলেই পারতে!
না এলে আপনি তো হারিয়ে যেতেন। আপনাকে আর পেতাম কোথায়? রিকশা করে এসেছি বাবুজি, দাঁড়াতে পারছি নে!
লোকটা ঘাসের ওপর বসে পড়ল। বললে–আজ অন্ধকার হয়ে গিয়েছে বাবুজি, আজ কোনো কাজ হবে না।
লোকটা কথা বলবে, সুশীল শুনবে। এতে দিনের আলোর কী দরকার, সুশীল বুঝতে পারলে না। বললে–কী কথা বলবে বলেছিলে–বলে যাও না?
লোকটা ধীরে ধীরে চাপা গলায় অনেক কথা বললে–মোটামুটি তার বক্তব্য এই–