ওরা পিছন ফিরে চেয়ে দেখলে সনৎ টর্চ ফেলে দেওয়ালের গায়ের একটা সাদা রেখার দিকে চেয়ে কথা বলছে। রেখাটা লম্বা অবস্থায় দেওয়ালের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত টানা।
জামাতুল্লা বললে–এ দাগ নোনা জলের দাগ–খুব টাটকা দাগ।
সুশীল ও সনৎ হতভম্ব হয়ে বললে–তার মানে? জল আসবে কোথা থেকে?
জামাতুল্লা বললে–বড় অন্ধকার জায়গা, ভালো করে কিছুই তো মালুম পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু একবার ভালো করে ঘরের চারিধারে দেখা দরকার। অজানা জায়গায় সাবধান থাকাই ভালো। এত স্যাঁৎসেঁতে কেন ঘরটা, আমি অনেকক্ষণ থেকে তাই ভাবছি।
জামাতুল্লা ও সনৎ হাতড়ে হাতড়ে সোনার চাকতি বের করে থলের মধ্যে একরাশ পুরে ফেলল–পাথরের নুড়িও কিছু নিলে–বলা যায় না যদি এগুলি কোনো দামি পাথর হয়ে পড়ে! বলা যায় কী! সনৎ ছেলেমানুষ, সে এত সোনার চাকতি দেখে কেমন দিশেহারা হয়ে গেল–উন্মত্তের মতো আঁজলা ভরে চাকতি সংগ্রহ করে তার তামার জালার মধ্যে থেকে, আর থলের ভেতর পুরে নেয়। যেন এ আরব্য উপন্যাসের একটা গল্প–কিংবা রূপকথার মায়াপুরী–পাতালপুরীর ধনভান্ডার! বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতায় বেলা দশটা থেকে বিকেল ছ-টা এস্তেক কলম পিষে সাঁইত্রিশ টাকা ন-আনা রোজগার করতে হয় সারা মাসে। সেই হল। রূঢ় বাস্তব পৃথিবী–মানুষকে ঘা দিয়ে শক্ত করে দেয়। আর এখানে কী, না–হাতের আঁজলা ভরে যত ইচ্ছে সোনা নিয়ে যাও, হীরে নিয়ে যাও–এ আলাদা জগৎ–পৃথিবীর অর্থনৈতিক আইনকানুনের বাইরে।
বহু প্রাচীনকালের মৃত সভ্যতা এখানে প্রাচীন দিনের সমস্ত বর্বর প্রাচুর্য ও আদিম অর্থনীতি নিয়ে সমাধিগর্ভে বিস্মৃতির ঘুমে অচেতন–এ দিন বাতিল হয়ে গিয়েছে, এ সমাজ বাতিল হয়ে গিয়েছে–একে অন্ধকার গহ্বর থেকে টেনে দিনের আলোয় তুলে বিংশ শতাব্দীর জগতে আর অর্থনৈতিক বিভ্রাট ঘটিও না।…
হঠাৎ কীসের শব্দে সুশীলের চিন্তার জাল ছিন্ন হল–বিরাট, উন্মত্ত, প্রচন্ড শব্দ–যেন সমগ্র নায়াগ্রা জলপ্রপাত ভেঙে ছুটে আসছে কোথা থেকে–কিংবা শিবের জটা থেকে যেন গঙ্গা ভীম ভৈরব বেগে ইন্দ্রের ঐরাবতকে ভাসিয়ে মর্ত্যে অবতরণ করছেন।
জামাতুল্লার চিৎকার শোনা গেল সেই প্রলয়ের শব্দের মধ্যে–জল! জল! পালান–ওপরে উঠুন–
জামাতুল্লার কথা শেষ না হতে সুশীলের হাঁটু ছাপিয়ে কোমর পর্যন্ত জল উঠল– কোমর থেকে বুক লক্ষ করে দ্রুতগতিতে ওঠবার সঙ্গেসঙ্গে জামাতুল্লা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললে– ওই দেখুন বাবু!
সুশীল সবিস্ময়ে ও সভয়ে চেয়ে দেখলে ঘরের ছাদের কাছাকাছি সেই দুটো পয়োনালা দিয়ে ভীষণ তোড়ে জল এসে পড়ছে ঘরের মধ্যে। চক্ষের নিমেষে ওরা ইঁদুর-কলে আটকা পড়ে জলে ডুবে দম বন্ধ হয়ে মরবে!… কিন্তু উঠবে কোথায়! উঠবে কীসের সাহায্যে? এ ঘরে সিঁড়ি নেই আগেই দেখে এসেছে।
সুশীল চিৎকার করে বললে–সনৎ–সনৎ ওপরে ওঠ–শিগগির—
সনৎ বললে–দাদা! তুমি আমার হাত ধরো–হাত ধরো–
তারপর হঠাৎ সব অন্ধকার হয়ে গেল–পুরোনো রাজাদের পোষ-মানা বেতাল যেন কোথায় হা হা করে বিকট অট্টহাস্য করে উঠল–সম্মুখে মৃত্যু! উদ্ধার নেই!
এ জলে সাঁতার দেওয়া যাবে না সুশীল জানে–এ মরণের ইঁদুরকল। বুক ছাপিয়ে জল তখন উঠে প্রায় নাকে ঠেকে-ঠেকে–
কে যেন অন্ধকারের মধ্যে চেঁচিয়ে উঠল–দাদা-দাদা–আমার হাত ধরো–দাদা–
একজোড়া শক্ত বলিষ্ঠ হাত ওকে ওপরের দিকে তুললে টেনে। ঘন অন্ধকার। টর্চ কোথায় গিয়েছে সেই উন্মত্ত জলরাশির মধ্যে। সুশীলের প্রায় জ্ঞান নেই। সে ডাকছে–কে? সনৎ?
কোনো উত্তর নেই। কেউ কাছে নেই।
সুশীলের ভয় হল। সে চেঁচিয়ে ডাকলে–সনৎ! জামাতুল্লা!
তার পায়ের তলায় উন্মত্ত গর্জনে যেন একটা পাহাড়ের মাথার হ্রদ খসে পড়েছে। উত্তর দেয় না কেউ-না সনৎ, না জামাতুল্লা।
প্রায় দশ মিনিট পরে জামাতুল্লা বললে–বাবু, জলদি আমার হাত পাকড়ান–
কেন?
পাকড়ান হাত–উপরে উঠব–সাবধান!
সনৎ, সনৎ কোথায়? তাকে রেখে এলে উপরে!
জলদি হাত পাকড়ান–হুঁ—
কত যুগ ধরে ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে ঘুরে ঘুরে সে ওঠা প্রলয়ের অন্ধকারের মধ্য দিয়ে– তারপর কতক্ষণ পরে পৃথিবীর ওপর এসে হাঁপ ছেড়ে বাঁচা পাতালপুরীর গহ্বর থেকে! বনের মধ্যে সন্ধ্যার অন্ধকার যেন ঘনিয়ে এসেছে। সুশীল ব্যথভাবে বললে–সনৎ কই? তাকে কোথায়
জামাতুল্লা বিষাদ-মাখানো গম্ভীরসুরে বললে–সনবাবু নেই–আমাদের ভাগ্য বাবুজি—
সুশীল বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে বললে–নেই মানে?
সনবাবু তো পাতালপুরী থেকে ওঠেননি–তাঁকে খুঁজে পাইনি। আপনাকে তুলে ওপরে রেখে তাঁকে খুঁজতে যাব এমন সময় ঘরের মেঝে দুলে উঠে এঁটে গেল। তিনি থেকে গেলেন তলায়–আমরা রয়ে গেলাম ওপরে। তাঁকে খুঁজে পাই কোথায়?
সে কী! তবে চলে গিয়ে খুঁজে আনি!
জামাতুল্লা বিষাদের হাসি হেসে বললে–বাবুজির মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে, এখন কিছু বুঝবেন না। একটু ঠাণ্ডা হোন, সব বলছি। সনৎবাবুকে যদি পাওয়া যেত তবে আমি তাঁকে ছেড়ে আসতাম না।
কেন? সনৎ কোথায়? হ্যাঁরে, আমি তোকে ছেড়ে বাড়ি গিয়ে মার কাছে, খুড়িমার কাছে কী জবাব দেব?–কেন তুমি তাকে পাতালে ফেলে এলে?
জামাতুল্লা নিজের কপালে আঙুল তুলে দেখিয়ে বললে–নসীব, বাবুজি–
উদভ্রান্ত সুশীলের বিহ্বল মস্তিষ্কে ব্যাপারটা তখনও ঢোকেনি। জলের মধ্যে হাবুডুবু খেয়ে দম বন্ধ হয়ে সনৎ ওপরে উঠবার চেষ্টা করেও উঠতে পারেনি। অন্ধকারের মধ্যে জামাতুল্লাও ওকে খুঁজে পায়নি। ওরই হাত ধরে টেনে তুলবার পরে ঘরের মেঝে এঁটে গিয়ে রত্নভান্ডারের সঙ্গে ওদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ওই ঘরে ছাদ পর্যন্ত জল ভরতি হয়ে গিয়েছে এতক্ষণ–সেখানে মানুষ কতক্ষণ থাকতে পারে?