জামাতুল্লা বললে–এগুলো কী বাবুজি?
সুশীল বললে–আমার মনে হয় এটাই ধনভান্ডার।
সনৎ বললে–আমরা ঠিক জায়গায় পৌঁছে গিয়েছি—
জামাতুল্লা হঠাৎ অন্য দেওয়ালের দিকে গিয়ে বললে–এই দেখুন বাবুজি–
সে-দিকে দেওয়ালের গায়ে বড়ো বড়ো কুলুঙ্গির মতো অসংখ্য গর্ত। প্রত্যেকটার মধ্যে ছোটো-বড়ো কৌটোর মতো কী সব জিনিস।
সুশীল বললে–যাতে-তাতে হাত দিও না; এসব পাতাল-ঘরে সাপ থাকা বিচিত্র নয়। এই ঘোর অন্ধকারে পাতালপুরী বিষাক্ত সাপের রাজ্য হওয়াই বেশি সম্ভব।
কিন্তু চারিদিকে ভালো করে টর্চ ফেলে দেখেও সাপের সন্ধান পাওয়া গেল না।
সনৎ ও জামাতুল্লা কুলুঙ্গি থেকে একটা কৌটো বার করে দেখলে। ভেতরে যা আছে তা দেখে ওরা খুব উৎসাহিত হয়ে উঠল না। এ কী সম্ভব, এত বড়ো একটা প্রাচীন সাম্রাজ্যের গুপ্ত ধনভান্ডারে এত কান্ড করে পাতালের মধ্যে ঘর খুঁড়ে তাতে পুরোনো হরতুকি রাখা হবে?
ওদের হতভম্ব চেহারা দেখে সুশীল বললে–কী ওর মধ্যে?
সনৎ বললে–পুরোনো হরতুকি দাদা—
দূর পাগল–হরতুকি কী রে?
এই দেখো—
সুশীল গোল গোল ছোটো ফলের মতো জিনিস হাতে নিয়ে নেড়ে-চেড়ে বললে–আমি জানিনে এ কী জিনিস, কিন্তু যখন এত যত্ন করে একে রাখা হয়েছে, তখন এর দাম আছে। থলের মধ্যে নাও দু-এক বাক্স–
সব কৌটোগুলোর মধ্যে সেই পুরোনো হরতুকি!
ওরা দস্তুরমতো হতাশ হয়ে পড়ল। এত কষ্ট করে পুরোনো হরতুকি সংগ্রহ করতে ওরা এতদূর আসেনি।
হঠাৎ সুশীল বলে উঠল–আমার একটা কথা মনে হয়েছে—
সনৎ বললে–কী দাদা?
এ জিনিস যাই হোক, এ-ই ছিল পুরোনো সাম্রাজ্যের প্রচলিত মুদ্রাকারেন্সি–এই আমার স্থির বিশ্বাস। সঙ্গে নাও কিছু পুরোনো হরতুকি–
জামাতুল্লা অনেক কৌশল করে একটা তামার জালা পাড়লে। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও তার ঢাকনি খোলা গেল না। জামাতুল্লা বিরক্ত হয়ে বললে–এ কি রিবিট করে এঁটে দেওয়া বাবুজি? এ খোলবার হদিশ পাচ্ছি নে যে–
টানাটানি করতে গিয়ে একটা ঢাকনি খটাং করে খুলে গেল।
সনৎ বললে–দেখো ওর মধ্যে থেকে আবার পুরোনো আমলকি না বার হয় দাদা—
কিন্তু জালাটা উপুড় করে ঢাললে তার মধ্যে থেকে বেরোলো রাশি রাশি নানা রং-বেরঙের পাথর। দামি জিনিস বলে মনে হয় না। সাঁওতাল পরগনা অঞ্চলে যেকোনো নদীর ধারে এমনি নুড়ি অনেক পাওয়া যায়।
জামাতুল্লা বললে–তোবা! তোবা! এসব কী চিজ বাবুজি?
কতকগুলো কৌটোর মধ্যে শনের মতো সাদা জিনিসের গুলির মতো। মনে হয় বহুকাল আগে শনের নুড়িগুলিতে কোনো গন্ধদ্রব্য মাখানো ছিল–এখনও তার খুব মৃদু সুগন্ধ শনের নুড়িগুলোর গায়ে মাখানো।
সনৎ বললে–দাদা, ওটা তাদের ওষুধ-বিষুদ রাখার ভাঁড়ার ছিল না তো?
জামাতুল্লা বললে–কী দাওয়াই আছে এর মধ্যে বাবুজি?
তা তুমি আমি কী জানি? প্রাচীন যুগের লোকের কত অদ্ভুত ধারণা ছিল। হয়তো তাদের বিশ্বাস ছিল এই সবই অমর হওয়ার ওষুধ।
হঠাৎ সুশীল একটা জালার মুখ খুলে বলে উঠল–দেখি, বোধহয় টাকা! জালা উপুড় করলে তার মধ্যে থেকে পড়ল একরাশ বড়ো বড়ো চাকতি, বড়ো বড়ো মেডেলের আকারের, প্রায় সিকি ইঞ্চি পুরু।
সুশীল একখানা চাকতি হাতে করে বললে–সোনা বলে মনে হয় না?
জামাতুল্লা বললে–আলবৎ সোনা–তবে টাকা বা মোহর নয়।
সুশীল বললে–কোনোরকম ছাপ নেই। মুদ্রা করবার জন্যে এগুলো তৈরি করা হয়েছিল–কিন্তু তারপর ছাপ এতে মারা হয়নি। এ অনেক আছে–
সনৎ বললে–সবরকম কিছু কিছু নাও দাদা—
জামাতুল্লা বললে–এ যদি সোনা হয়–এই এক জালার মধ্যেই লাখ টাকার সোনা—
সুশীল আর একটা জালা পেড়ে ঢাকনি খুলে উপুড় করে ঢাললে। তার মধ্যেও অবিকল অমনি ধাতব চাকতি একই আকারের, একই মাপের।
জামাতুল্লা বললে–শোভানাল্লা! দু-লাখ হল–যদি আমরা দেখি সব জালাতেই এ-রকম–
এই সময় সুশীল প্রায় চিৎকার করে বলে উঠল–শিগগির এদিকে এসো—
ওরা গিয়ে দেখলে অন্ধকার ঘরের কোণে কতকগুলো মানুষের হাড়গোড়–ভালো করে টর্চ ফেলে দেখা গেল, দুটো নরকঙ্কাল!
সেই সূচিভেদ্য অন্ধকার পাতালপুরীর মধ্যে নরকঙ্কালদুটো যেন ওদের সমস্ত আশা ও চেষ্টাকে দাঁত বার করে উপহাস করছে। কাল রাত্রে স্বপ্নের কথা ওর মনে এল, মৃত্যুর চেয়ে মহারহস্য জগতে কী আছে? মূঢ় লোকে চারিপাশে মৃত্যু অহরহ দেখছে, অথচ ভাবে না কী গভীর রহস্যপুরীর দ্বারপালস্বরূপ ইহলোক ও পরলোকের পথে মৃত্যু আছে দাঁড়িয়ে।…
নরকঙ্কালটি কী কথা না জানি বলত যদি এরা এদের মরণের ইতিহাস ব্যক্ত করতে পারত? সে হয়তো দুর্নিবার লোভ ও নৃশংস অর্থলিপ্সার ইতিহাস, হয়তো তা রক্তপাতের ইতিহাস, জীবন-মরণ নিয়ে খেলার ইতিহাস, ভাই হয়ে ভায়ের বুকে ছুরি বসানোর ইতিহাস…
জামাতুল্লা কঙ্কালগুলো সরিয়ে রাখতে গিয়ে বললে–হাড় ভেঙে যাচ্ছে বাবুজি বহুৎ পুরোনো আমলের হাড়গোড় এসব। কমসে কম এক-শো-দেড়-শো বছরের পুরোনো–কিন্তু দেখুন বাবুজি মজা, হাড়ের গায়ে এসব কী?
ওরা হাতে করে নিয়ে দেখলে।
প্রায় এক ইঞ্চি করে লবণের স্তর শক্ত হয়ে জমাট বেঁধে আছে কঙ্কালের ওপরে। সুশীল ভালো করে টর্চের আলো ফেলে বললে–চোখের কোটরগুলো নুনে বুজোনো–দেখো চেয়ে!
এর যে কী কারণ ওরা কিছুই ঠিক করতে পারলে না।
অন্ধকার পাতালপুরীর শহরে ওদের হাড়ে নুন মাখাতে এসেছিল কে?
সে-সময়ে সনৎ বললে–দেখো দাদা, দেখো জামাতুল্লা সাহেব–এটা কীসের দাগ?