জামাতুল্লা বললে–উঠুন বাবুজি।
সুশীল বিমূঢ়ের মতো বললে–কেন?
ভোর হয়েছে। ইয়ার হোসেনের লোক এখনো ওঠেনি–আমাদের কেউ কোনো সন্দেহ না করে। সনৎবাবুকে ওঠাই—
একটু বেলা হলে ইয়ার হোসেন উঠে ওদের ডাকলে। বললে–পরশু এখান থেকে তাঁবু ওঠাতে হবে। জাঙ্কওয়ালা চীনেম্যান আমার নিজের লোক। ও অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। আর থাকতে চাইছে না। এখানে আপনারা এলেন ফোটো তুলতে আর ছবি আঁকতে এত পয়সা খরচ এর জন্যে করিনি।
সুশীল বললে–যা ভালো বোঝেন মি. হোসেন।
সনৎ বললে–তাহলে দাদা, আমাদের সেই কাজটা এই দু-দিনের মধ্যে সারতে হবে। ইয়ার হোসেন সন্দেহের সুরে বললে–কী কাজ?
সুশীল বললে–বনের মধ্যের একটা মন্দিরের গায়ে পাথরের ছবি আছে, সেটা আমি আঁকছি। সনৎ ফোটো নিচ্ছে তার।
ইয়ার হোসেন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হেসে বললে–ওই করতেই আপনারা এসেছিলেন আর কী! করুন যা হয় এই দু-দিন।
সনৎ বললে–তাহলে চলো দাদা আমরা সকাল সকাল খেয়ে রওনা হই।
ইয়ার হোসেনের অনুমতি পেয়ে ওদের সাহস বেড়ে গেল। দিন দুপুরেই ওরা দুজন রওনা হয়ে গেল–শাবল, গাঁতি, টর্চ ওরা কিছুই আনেনি, সিঁড়ির মুখের প্রথম ধাপে রেখে এসেছে। শুধু ক্যামেরা আর রিভলবার হাতে বেরিয়ে গেল।
জামাতুল্লা গোপনে বললে–আমি কোন ছুতোয় এরপরে যাব। একসঙ্গে সকলে গেলে চালাক ইয়ার হোসেন সন্দেহ করবে। আজ কাজ শেষ করতে হবে মনে থাকে যেন, হয় এসপার নয়তো ওসপার। আর সময় পাব না।
সনৎ বললে–মনে থাকে যেন একথা। আজ আর ফিরব না শেষ না দেখে।
সুশীলের বুকের মধ্যে যেন কেমন করে উঠল সনতের কথায়। সনতের মুখের দিকে ও চাইলে। কেন সনৎ হঠাৎ এ কথা বললে?
আবার সেই অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে রহস্যময় গহ্বরে সুশীল ও সনৎ এসে দাঁড়াল। আসবার সময় সিঁড়ির প্রথম ধাপ থেকে ওরা গাঁতি ও টর্চ নিয়ে এসেছে। পাথরে নর্তকীমূর্তি দেওয়ালের গায়ে এক জায়গায় কাত করে রাখা হয়েছে। যেন জীবন্তপুরী দেওয়ালে ঠেস দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে মনে হয়। সুশীল সে-দিকে চেয়ে বললে–আর কিছু না পাই, এই পুতুলটা নিয়ে যাব। সব খরচ উঠে এসেও অনেক টাকা লাভ থাকবে–শুধু ওটা বিক্রি করলে।
তারপর দু-জনে নীচের পাথরের চৌবাচ্চাটাতে নামল।
সনৎ বললে–উত্তর কোণের গায়ে চিহ্নটা দেখতে পাচ্ছ দাদা!
-–এখন কিছু কোরো না, জামাতুল্লাকে আসতে দাও।
সনৎ ছেলেমানুষ, সে সত্যিই অবাক হয়ে গিয়েছিল। বাংলা দেশের পাড়াগাঁয়ে জন্মগ্রহণ করে একদিন যে জীবনে এমন একটা রহস্যসংকুল পথযাত্রায় বেরিয়ে পড়বে, কবে সে একথা ভেবেছিল? সুশীল কিন্তু বসে বসে অন্য কথা ভাবছিল।
গত রাত্রের স্বপ্নের কথা তার স্পষ্ট মনে নেই, আবছাভাবে যতটুকু মনে আছে, সে যেন গতরাত্রে এক অদ্ভুত রহস্যপুরীর পথে পথে কার সঙ্গে অনির্দেশ যাত্রায় বার হয়েছিল, কত কথা যেন সে বলেছিল, সব কথা মনে হয় না। তবুও যেন কী এক অমঙ্গলের বার্তা সে জানিয়ে দিয়ে গিয়েছে, কী সে বার্তা, কার সে অমঙ্গল কিছুই স্পষ্ট মনে নেই–অথচ সুশীলের মন ভার ভার, আর যেন তার উৎসাহ নেই। এ কাজে ফিরবার পথও তো নেই।
ওপরের ঘর থেকে জামাতুল্লা উঁকি মেরে বললে–সব ঠিক।
এসেছ?
হাঁ বাবুজি। অনেকটা দড়ি এনেছি লুকিয়ে–
নেমে পড়ো।
আপনার ক্যামেরা এনেছেন?
কেন বল তো?
ইয়ার হোসেনকে ফাঁকি দিতে হলে ক্যামেরাতে ফোটো তুলে নিয়ে যেতে হবে—
সব ঠিক আছে।
জামাতুল্লা ওদের সঙ্গে এসে যোগ দেবার অল্পক্ষণ পরেই সনৎ হঠাৎ কী ভেবে দেওয়ালের উত্তর কোণের সে চিহ্নটা চেপে ধরলে এবং সঙ্গেসঙ্গে পাথরের চৌবাচ্চার তলা একদিকে কাত হয়ে উঠতেই ফাঁক দিয়ে সনৎ নীচের দিকে অতলস্পর্শ অন্ধকারে লাফিয়ে পড়ল।
সুশীল ও জামাতুল্লা দু-জনেই চমকে চিৎকার করে উঠল। অমন অতর্কিতভাবে সনৎ লাফ মারতে গেল কেন, ওরা ভেবে পেল না।
কিন্তু লাফ মারলে কোথায়।
জামাতুল্লা সভয়ে বললে–সর্বনাশ হয়ে গেল বাবুজি। তারপর ওরা দুজনেই কিছু না ভেবেই পাথরের চৌবাচ্চার তলার ফাঁক দিয়ে লাফ দিয়ে পড়ল।
ওরা ঘোর অন্ধকারের মধ্যে নিজেদের দেখতে পেলে।
সনৎ অন্ধকারের ভেতর থেকেই বলে উঠল–দাদা, টর্চ জ্বালো আগে, জায়গাটা কীরকম দেখতে হবে—
ওরা টর্চ জ্বেলে চারিদিক দেখে অবাক হয়ে গেল। ওরা একটা গোলাকার ঘরের মধ্যে নিজেদের দেখতে পেলে–ঘরের দু-কোণে দুটো বড়ো পয়োনালির মতো কেন রয়েছে ওরা বুঝতে পারলে না। ছাদের যে জায়গায় কড়িকাঠের অগ্রভাগ দেওয়ালের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবার কথা, সেখানে দুটো বড়ো বড়ো পাথরের গাঁথুনি পয়োনালি, একটা এদিকে, আর একটা ওদিকে। সমস্ত ঘরটায় জলের দাগ, মেঝে ভয়ানক ভিজে ও স্যাঁৎসেঁতে, যেন কিছুক্ষণ আগে ও ঘরে অনেকখানি জল ছিল।
জামাতুল্লা বললে–এ ঘরে এত জল আসে কোথা থেকে বাবুজি?
সুশীল কিছু বলতে পারলে না; প্রকান্ড ঘর, অন্ধকারের মধ্যে ঘরের কোথায় কী আছে ভালো বোঝা যায় না।
সনৎ বললে–ঘরের কোণগুলো অন্ধকার দেখাচ্ছে, ওদিকে কী আছে দেখা যাক–
টর্চ ধরে তিন জনে ঘরের একদিকের কোণে গিয়ে দেখে অবাক চোখে চেয়ে রইল।
ঘরের কোণে বড়ো বড়ো তামার জালা বা ঘড়ার মতো জিনিস, একটার ওপর আর একটা বসানো, ঘরের ছাদ পর্যন্ত উঁচু। সে-দিকের দেওয়ালের গা দেখা যায় না– সমস্ত দেওয়াল ঘেঁসে সেই ধরনের রাশি রাশি তামার জালা–ওরা এতক্ষণ ভালো করে দেখেনি, সেই তামার জালার রাশিই অন্ধকারে দেওয়ালের মতো দেখাচ্ছিল।