সামনে-পেছনে গিয়ে কী হবে?
সুশীল লক্ষ করে দেখলে চৌবাচ্চার ডানদিকের দেওয়ালে একটা কালো রেখা আছে সেইটে ধরে যদি সামনে বা পেছনে যাওয়া যায় তবে চৌবাচ্চার তলাটা একবার নামে, একবার ওঠে। ছেলেদের see-saw খেলার তক্তাটার মতো।
সনৎ বললে–ব্যাপারটা কী?
সুশীল বললে–অর্থাৎ এটা যদি কোনোরকমে ওঠানো যায়, তবে এর মধ্যে আর কিছু রহস্য আছে। কিন্তু সেটা কী করে সম্ভব বুঝতে পারা যাচ্ছে না।
জামাতুল্লা বললে–বাবু, গাঁতি দিয়ে তলা ভেঙে ফেলতে পারি তো–অন্য কোনো পথ যদি না পাওয়া যায়। কিন্তু আজ থাকলে হত না বাবুজি? বড্ড দেরি হয়ে গেল আজ–সকাল হয় হয়—
হঠাৎ সুশীল চৌবাচ্চার এক জায়গায় টর্চের আলো ফেলে বলে উঠল–এই দেখো সেই চিহ্ন–
সনৎ ও জামাতুল্লা সবিস্ময়ে দেখলে, চৌবাচ্চার কালো রেখার ওপরে উত্তর দিকের
কোণে, দু-খানা পাথরের সংযোগস্থলে তাদের অতিপরিচিত সেই চিহ্নটি আঁকা।
সুশীল বললে–হদিশ পেয়েছি বলে মনে হচ্ছে–
অর্থাৎ
অর্থাৎ এই চিহ্নের ওপর টিপলেই চৌবাচ্চার তলার পাথরখানা একদিকে খুব বেশি কাত হয়ে, ভেতরে কী আছে দেখিয়ে দেবে। কিন্তু আজ বড্ড বেলা হয়ে গেল। আজ থাক, চলো।
জামাতুল্লা তাতে মত দিলে। সবাই মিলে তাঁবুতে ফিরে এল যখন, তখনও ভোরের আলো ভালো করে ফোটেনি। ইয়ার হোসেনের মালয় ভৃত্য বলো হাতে তাঁবুর দ্বারে চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে আছে। জামাতুল্লার ইঙ্গিতে সুশীল ও সনৎ উপুড় হয়ে পড়ে বুকে হেঁটে নিজেদের তাঁবুর মধ্যে ঢুকে পড়ল।
জামাতুল্লা বললে–ঘুমিয়ে পড়ন বাবুজিরা–কিন্তু বেশি বেলা পর্যন্ত ঘুমোবেন না, আমি উঠিয়ে দেব সকালেই। নইলে ওরা সন্দেহ করবে।
সুশীল বললে–আমাদের অবর্তমানে ওরা ঘরে ঢোকেনি এই রক্ষে—
সনৎ অবাক হয়ে বললে–কী করে জানলে দাদা?
দেখবে? এই দ্যাখো। তাঁবুর দোরে সাদা বালি ছড়ানো, যে-কেউ এলে পায়ের দাগ পড়ত। তা পড়েনি।
ওরা যে যার বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
* * * *
সুশীলকে কে বললে–আমার সঙ্গে আয়।
গভীর অন্ধকারের মধ্যে এক দীর্ঘাকৃতি পুরুষের পিছু পিছু ও গভীর বনের কতদূর চলল। ইয়ার হোসেনের মালয় ভৃত্যগণ ঘোর তন্দ্রাভিভূত, ঊষার আলোকের ক্ষীণ আভাসও দেখা যায় না পূর্বদিগন্তে। বৃক্ষলতা স্তব্ধ, স্বপ্নঘোরে আচ্ছন্ন। সারি সারি প্রাসাদ এক দিকে, অন্য দিকে প্রশস্ত দীর্ঘিকার টলটলে নির্মল জলরাশির বুকে পদ্ম ফুল ফুটে আছে। সেই গভীর বনে, গভীর অন্ধকারের মধ্যে দেউলে দেউলে ত্রিমূর্তি মহাদেবের পূজা হচ্ছে। সুগন্ধ দীপবর্তিকার আলোকে মন্দিরাভ্যন্তর আলোকিত। প্রাসাদের বাতায়ন বলভিতে শুকসারী তন্দ্রামগ্ন।
সুশীল বললে–আমায় কোথা নিয়ে যাবেন?
সে কথা বলব না। ভয় পাবি—
তবুও শুনি, বলুন–
বহুদিনের বহু ধ্বংস, অভিশাপ, মৃত্যুর দীর্ঘশ্বাসে এ পুরীর বাতাস বিষাক্ত, এখানে প্রবেশ করবার দুঃসাহসের প্রশংসা করি। কিন্তু এর মূল্য দিতে হবে।
কী?
একজনের প্রাণ। সমুদ্রমেখলা এ দ্বীপের বহু শতাব্দীর গুপ্ত কথা ঘন বন ঢেকে রেখেছিল। ভারত মহাসমুদ্র স্বয়ং এর প্রহরী, দেখতে পাও না?
আজ্ঞে, তা দেখছি বটে।
তবে সে-রহস্য ভেদ করতে এসেছ কেন?
আপনি তো জানেন সব।
সম্রাটের ঐশ্বর্য গুপ্ত আছে এর মধ্যে। কিন্তু সে পাবে না। যে অদৃশ্য আত্মারা তা পাহারা দিচ্ছে, তারা অত্যন্ত সতর্ক, অত্যন্ত হিংসুক। কাউকে তারা নিতে দেবে না। তবে তুমি ভারতবর্ষের সন্তান, তোমাকে একেবারে বঞ্চিত করব না আমি–রহস্য নিয়ে যাও, অর্থ পাবে না। যা পাবে তা সামান্য। তারই জন্যে প্রাণ দিতে হবে।
আপনি বিহ্মমুনি?
মুখ! আমি এই নগরীর অধিদেবতা। ধ্বংসস্তূপ পাহারা দিচ্ছি শতাব্দীর পর শতাব্দী। অনেকদিন পরে তুমি ভারতবর্ষ থেকে এসেছ–আটশো বছর আগে তোমাদের সাহসী পূর্বপুরুষরা অস্ত্র হাতে এখানে এসে রাজ্যস্থাপন করেন। দুর্বল হাতে তাঁরা খড়গ ধরতেন না। তোমরা সে-দেশ থেকেই এসেছ কি? দেখলে চেনা যায় না কেন?
সেটা আমাদের অদৃষ্টের দোষ, আমাদের ভাগ্যলিপি।
তারপরেই সব অন্ধকার। সুশীল সেই অদৃষ্টপূর্ব পুরুষের সঙ্গে সেই সূচিভেদ্য অন্ধকারের মধ্যে কোথায় যেন চলেছে..চলেছে…মাথার ওপর কৃষ্ণা নিশীথিনীর জ্বলজ্বলে নক্ষত্ৰভরা আকাশ।
পুরুষটি বললেন–সাহস আছে? তুমি ভারতবর্ষের সন্তান—
নিশ্চয়ই দেব।
নগরী বহুদিন মৃতা, কিন্তু বহু যুগের পুরাতন কৃষ্ণাগুরুর ধূপগন্ধে আমোদিত অরণ্যতরুর ছায়ায় ছায়ায় অজানা পথযাত্রার যেন শেষ নেই।
বিশাল পুরী, প্রেতপুরীর সমান নিস্তব্ধ। রাজপ্রাসাদের বিস্তৃত কক্ষে, দামি নীলাংশুকের আস্তরণে ঢাকা স্বর্ণ-পর্যঙ্ক কোন অপরিচিতের অভ্যর্থনার জন্য প্রস্তুত। সুশীলের বুক গুরুগুরু করে উঠল, গৃহের রত্নপ্রস্তরের ভিত্তিতে যেন অমঙ্গলের লেখা। ভবনদর্পণে প্রতিফলিত হয়ে উঠবে এখনি যেন কোন বিভীষণা অপদেবীর বিকট মূর্তি!
পুরুষ বললেন–ওই শোনো–
সুশীল চমকে উঠল। যেন কোন নারীকন্ঠের শোকার্ত চিৎকারে নিশীথ নগরীর নিস্তব্ধতা ভেঙে গেল। সে-নারীর কণ্ঠস্বরকে সে চেনে। অত্যন্ত পরিচিত কণ্ঠস্বর! খুব নিকট আত্মীয়ার বিলাপধ্বনি। সুশীলের বুক কেঁপে উঠল। ঠিক সেইসময় বাইরে থেকে কে ডাকলে–বাবুজি–বাবুজি–
তার ঘুম ভেঙে গেল। বিছানা ঘামে ভেসে গিয়েছে। জামাতুল্লা বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে ডাকছে। দিনের আলো ফুটছে তাঁবুর বাইরে।