পাছে রাত হয়ে যায় ফিরতে। বনের মধ্যে আলো থাকলে অনেক ভালো।
এত ছবি এঁকে কী হয় বাবু?
ভালো লাগে।
আসল ব্যাপারের কী? জামাতুল্লা আমাদের ফাঁকি দিয়েছে। আমি ওকে মজা দেখিয়ে দেব! আমরা সকলেই চেষ্টা করছি! ব্যস্ত হবেন না মি. হোসেন–
আমি আর পাঁচদিন দেখব। তারপর এখান থেকে চলে যাব–কিন্তু যাবার আগে জামাতুল্লাকে দেখিয়ে যাব সে কার সঙ্গে জুয়েচুরি করতে এসেছিল!
জামাতুল্লার কী দোষ? আপনি বরং আমাকে দোষ দিতে পারেন—
আরে আপনি তো ছবি-আঁকিয়ে পুরুষ মানুষ। এসব কাজ আপনার না।
সুশীল রাত্রে চুপি চুপি জামাতুল্লাদের নর্তকী পুতুলের ঘটনা সব বললে। ওদের দুজনকেই যেতে হবে, নতুবা ছিপি উঠবে না।
জামাতুল্লা বললে–কিন্তু আমাদের দুজনের একসঙ্গে যাওয়া সম্ভব নয় বাবুজি।
কেন?
জানেন না,–এর মধ্যে নানারকম ষড়যন্ত্র চলছে। ওরা আপনাদের চেয়ে আমাকেই দোষ দেবে বেশি। আপনাকে ওরা নিরীহ, গোবেচারি বলে ভাবে–
সেটা অন্যায়।
আপনারা ভালো মানুষ, আমার হাতের পুতুল–পুতুল যেমন নাচায়, তেমনি আপনারা আমার হাতে—
শেষের কথাটা শুনে সুশীলের আবার মনে পড়ল নর্তকীমূর্তির কথা। কাল হয়তো বেরোনো যাবে না, ইয়ার হোসেনের কড়া নজরবন্দির দরুন। আজই রাত্রে অন্য দল ঘুমোলে সেখানে গেলে ক্ষতি কী?
সনৎকে বললে–সনৎ, তৈরি হও। আজ রাত্রে হয় আমাদের জীবন, নয়তো আমাদের মরণ। পাতালপুরীর রহস্য আজ ভেদ করতেই হবে। আজ আঁধার রাত্রে চুপি চুপি বেরোবে আমার সঙ্গে–দিনের আলোয় সব ফাঁস হয়ে যাবে।
জামাতুল্লা বললে–কেউ টের না পায় বাবুজি, জুতো হাতে করে সব যাবেন কিন্তু।
আহারাদির পর্ব মিটে গেল। দাবানল জ্বলে উঠেছে আজ ওদের মনে, বনের সাময়িক দাবানলকেও ছাপিয়ে তার শিখা সমস্ত মনের আকাশ ব্যেপে বেড়ে উঠল।
দুটো রাইফেল, একটা রিভলবার, একটা শাবল, একটা গাঁতি, খনিকটা দড়ি, চার-পাঁচটা মোমবাতি, কিছু খাবার জল, এক শিশি টিংচার আইডিন, খানকতক মোটা রুটি–তিনজনের মধ্যে এগুলি ভাগ করে নিয়ে রাত একটার পরে ওরা অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে তাঁবু থেকে বেরোলো।
ইয়ার হোসেনের একজন মালয় অনুচর উলটো মুখে দাঁড়িয়ে বলো রামদাও হাতে পাহারা দিচ্ছে। অন্ধকারে এরা বুক ঘেঁষে চলে এল… সে লোকটা টের পেলে না।
সনৎ বললে–আমি সে পুতুলটা একবার দেখব–
অদ্ভুত রাত্রি! বনের মাথায় মাথায় অগণিত তারা, বহুকালের সুপ্ত নগরীর রহস্যে নিশীথ রাত্রি অন্ধকার যেন থমথম করছে, সমস্ত ধ্বংসস্তূপটি যেন মুহূর্তে শহর হয়ে উঠতে পারে– ওর অগণিত নর-নারী নিয়ে। লতাপাতা, ঝোঁপঝাঁপ, মহীরুহের দল খাড়া হয়ে সেই পরম মুহূর্তের প্রতীক্ষায় যেন নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে।
অন্ধকারে একটা সর-সর শব্দ হতে লাগল সামনের মাটিতে।
সকলে থমকে দাঁড়াল হঠাৎ। সনৎ ও সুশীল একসঙ্গে টর্চ টিপলে–প্রকান্ড একটা অজগর সাপ আস্তে আস্তে ওদের পাঁচ হাত তফাত দিয়ে চলে যাচ্ছে। সকলে পাথরের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে রইল, সাপটা বনের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। তারপর ওরা আবার চলল।
গহ্বরের মুখ ওরা লতাপাতা দিয়ে ঢেকে রেখে গিয়েছিল, তিনজনে মিলে সেগুলি সরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে লাগল।
সনৎ বললে–এ তো বড়ো আশ্চর্য ব্যাপার দেখছি–
কিন্তু পাতালপুরীর কক্ষের সে-নর্তকীমূর্তিটি দেখে ওর মুখে কথা সরল না। শিল্পীর অদ্ভুত শিল্পকৌশলের সামনে ও যেন হতভম্ব হয়ে গেল।
সুশীল বললে–শুধু এই মূর্তিটি কিউরিও হিসেবে বিক্রি করলে দশহাজার টাকায় যেকোনো বড়ো শহরের মিউজিয়াম কিনে নেবে–তবে, আমাদের দেশে নয়–ইউরোপে।
জামাতুল্লা বললে–ধরুন বাবুজি নাচনেওয়ালি পুতুলটা সবাই মিলে–পাক খাওয়াতে হবে একে বারকয়েক এখনও।
মিনিট দুই সবাই মিলে পাক দিয়ে মূর্তিটাকে ঘোরালো যেমন স্টপার ঘোরায় বোতলের মুখে। তারপর সবাই সন্তর্পণে মূর্তিটাকে ধরে উঠিয়ে নিলে। স্টপারের মতোই সেটা খুলে এল।
সঙ্গেসঙ্গে বিটঙ্কবেদির নীচের অংশে বার হয়ে পড়ল গোলাকার একটা পাথরের চৌবাচ্চা। সুশীল উঁকি মেরে দেখে বললে–টর্চ ধরো, খুব গভীর বলে মনে হচ্ছে—
টর্চ ধরে ওরা দেখলে চৌবাচ্চা অন্তত সাত ফুট গভীর। তার তলায় কী আছে ওপর থেকে ভালো দেখা যায় না।
সনৎ বললে–আমি লাফ দিয়ে পড়ব দাদা?
জামাতুল্লা বারণ করলে। এসব পুরোনো কূপের মধ্যে বিষধর সর্প প্রায়ই বাসা বাঁধে, যাওয়া সমীচিন হবে না।
দু-একটি পাথর ছুঁড়ে মেরে ওরা দেখলে, কোনো সাড়াশব্দ এল না আধো-অন্ধকার কূপের মধ্যে থেকে। তখন জামাতুল্লাই ধুপ করে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল ওর মধ্যে।
কিছুক্ষণ তার আর কোনো সাড়া নেই।
সুশীল ও সনৎ অধীর কৌতূহলের সঙ্গে বলে উঠল–কী–কী–কী দেখলে?
তবুও জামাতুল্লার মুখে কথা নেই। সে যেন কী হাতড়ে বেড়াচ্ছে চৌবাচ্চার তলায়। একটু অদ্ভুতভাবে হাতড়াচ্ছে–একবার সামনে যাচ্ছে, আবার পিছু হঠে আসছে।
সুশীল বললে–কী হল হে? পেলে কিছু দেখতে?
জামাতুল্লা বললে–বাবুজি, এর মধ্যে কিছু নেই—
কিছু নেই?
না বাবুজি। একেবারে ফাঁকা—
তবে তুমি ওর মধ্যে কী করছ জামাতুল্লা?
এর মধ্যে একটা মজার ব্যাপার আছে। নেমে এসে দেখুন—
সুশীল ও সনৎ সন্তর্পণে একে একে পাথরের চৌবাচ্চাটির মধ্যে লাফিয়ে পড়ল। জামাতুল্লা দেখালে–এই দেখুন বাবুজি, এই লাইন ধরে একেবার সামনে, একেবার পেছনে গিয়ে দেখুন–তা হলেই বুঝতে পারবেন—