বসে বসে চিরকাল বাপের ভাত খাব?
তোমাদের বংশে কেউ কখনো অন্য কাজ করেনি, তাই বলছি। হঠাৎ এ মতিবুদ্ধি ঘটল কেন তোমার?
সেসব বলব পরে। আপাতত একটা হিল্লে করে দাও তো।
ওর মধ্যে কঠিন আর কী? যেদিন ইচ্ছে এসো, বাবার কাছে নিয়ে যাব।
মাস খানেক ধরে সুশীল ওদের আড়তে বেরোতে লাগল, কিন্তু ক্রমশ সে দেখলে, ভুসি মাল চালানির কাজের সঙ্গে তার অন্তরের যোগাযোগ নেই। তার বাবা ছেলেকে আড়তে যোগ দিতে বাধা দেননি, বরং বলেছিল ব্যাবসার কাজে যদি কিছু টাকা দরকার হয়, তাও তিনি দেবেন।
একদিন তিনি জিজ্ঞেস করলেন–আড়তের কাজ কীরকম হচ্ছে?
সুশীল বললে–ও ভালো লাগে না, তার চেয়ে বরং ডাক্তারি পড়ি।
তোমার ইচ্ছে। তাহলে কলকাতায় গিয়ে দেখে-শুনে এসো।
কলকাতায় এসে সুশীল দেখলে, ডাক্তারি স্কুলে ভরতি হবার সময় এখন নয়। ওদের বছর আরম্ভ হয় জুলাই মাসে–তার এখনও তিন চার মাস দেরি। সুশীলের এক মামা খিদিরপুরে বাসা করে থাকতেন, তাঁর বাসাতেই সুশীল এসে উঠেছিল–তাঁরই পরামর্শে সে দু-একটা অফিসে কাজের চেষ্টা করতে লাগল।
দিন-পনেরো অনেক অফিসে ঘোরাফেরা করেও সে কোথাও কোনো কাজের সুবিধে করতে পারলে না–এদিকে টাকা এল ফুরিয়ে। মামার বাসায় খাবার খরচ লাগত না অবশ্য, কিন্তু হাতখরচের জন্যে রোজ একটি টাকা দরকার। বাবার কাছে সে চাইবে না–নগদ টাকার সেখানে বড়ো টানাটানি, সে জানে। একটা কিছু না করে এবার বাড়ি ফিরবার ইচ্ছে নেই তার। অথচ করাই বা যায় কী? সন্ধ্যার দিকে গড়ের মাঠে বসে রোজ ভাবে।
সুশীল সেদিন গড়ের মাঠের একটা নির্জন জায়গায় বসেছিল চুপ করে। বড্ড গরম পড়ে গিয়েছে–খিদিরপুরে তার মামার বাসাটিও ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েদের চিৎকার ও উপদ্রবে সদা সরগরম–সেখানে গিয়ে একটা ঘরে তিন-চারটি আট-দশ বছরের মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে একঘরে রাত কাটাতে হবে। সুশীলের ভালো লাগে না আদৌ। তাদের অবস্থা এখন খারাপ হতে পারে, কিন্তু দেশের বাড়িতে জায়গার কোনো অভাব নেই।
ওপরে নীচে বড়ো ঘর আছে–লম্বা লম্বা দালান, বারান্দা–পুকুরের ধারের দিকে বাইরের মহলে এত বড়ো একটা রোয়াক আছে যে, সেখানে অনায়াসে একটা যাত্রার আসর হতে পারে।
এমন সব জ্যোৎস্না রাতে কতদিন সে পুকুরের ধারে ওই রোয়াকটায় একা বসে কাটিয়েছে। পুকুরের ওপারে নারিকেল গাছের সারি, তার পেছনে রাধাগোবিন্দের মন্দিরের চুড়োটা, সামনের দিকে ওর ঠাকুরদাদার আমলের পুরোনো বৈঠকখানা। এ বৈঠকখানায় এখন আর কেউ বসে না–কাঠ ও বিচুলি, শুকনো তেঁতুল, ভুসি খুঁটে ইত্যাদি রাখা হয় বর্ষাকালে।
মাঝে মাঝে সাপ বেরোয় এখানে।
সেবার ভাদ্র মাসে তালনবমীর ব্রতের বাহ্মণ ভোজন হচ্ছে পুজোর দালানে, হঠাৎ একটা চেঁচামেচি শোনা গেল পুকুরপাড়ের পুরোনো বৈঠকখানার দিক থেকে।
সবাই ছুটে গিয়ে দেখে, হরি চাকর বৈঠকখানার মধ্যে ঢুকেছিল বিচুলি পাড়বার জন্যে সেই সময় কী সাপে তাকে কামড়েছে।
হইহই হল। লোকজন এসে সারা বৈঠকখানার মালামাল বার করে সাপের খোঁজ করতে লাগল। কিছু গেল না দেখা। হরি চাকর বললে সে সাপ দেখেনি, বিচুলির মধ্যে থেকে তাকে কামড়েছে।
ওঝার জন্যে রানিনগরে খবর গেল। রানিনগরের সাপের ওঝা তিনটে জেলার মধ্যে বিখ্যাত–তারা এসে ঝাড়ফুঁক করে হরিকে সে-যাত্রা বাঁচালে। লোকজনে খুঁজে সাপও বের করলে–প্রকান্ড খয়ে-গোখরো। হরি যে বেঁচে গেল, তার পুনর্জন্ম বলতে হবে।
বাবু, ম্যাচিস আছে–ম্যাচিস?
সুশীল চমকে মাথা তুলে দেখলে, একটি কালোমতো লোক। অন্ধকারে ভালো দেখা গেল না। নিম্নশ্রেণির অশিক্ষিত অবাঙালি লোক বলেই সুশীলের ধারণা হল–কারণ তারাই সাধারণত দেশলাইকে ম্যাচিস বলে থাকে।
সুশীল ধূমপান করে না, সুতরাং সে দেশলাইও রাখে না। সে-কথা লোকটাকে বলতে সে চলেই যাচ্ছিল–কিন্তু খানিকটা গিয়ে আবার অন্ধকারের মধ্যে যেন কী ভেবে ফিরে এল।
সুশীলের একটু ভয় হল। লোকটিকে এবার সে ভালো করে দেখে নিয়েছে অস্পষ্ট অন্ধকারের মধ্যে। বেশ সবল, শক্ত-হাত-পা-ওয়ালা চেহারা–গুণ্ডা হওয়া বিচিত্র নয়। সুশীলের পকেটে বিশেষ কিছু নেই–টাকা-তিনেক মাত্র। সুশীল একটু সতর্ক হয়ে সরে বসল। লোকটা ওর কাছে এসে বিনীত সুরে বললে–বাবুজি, দু-আনা পয়সা হবে?
সুশীল বিনা বাক্যব্যয়ে একটা দু-আনি পকেট থেকে বের করে লোকটার হাতে দিলে। তাই নিয়ে যদি খুশি হয়, হোক না। এখন ও চলে গেলে যে হয়!
চলে যাওয়ার কোনো লক্ষণ কিন্তু লোকটার মধ্যে দেখা গেল না। সে সুশীলের কাছেই এসে সকৃতজ্ঞ সুরে বললে–বহুৎ মেহেরবানি আপনার বাবু! আমার আজ খাওয়ার কিছু ছিল না–এই পয়সা লিয়ে হুটেলে গিয়ে রোটি খাব। বাবুজির ঘর কুথায়?
ভালো বিপদ দেখা যাচ্ছে! পয়সা পেয়ে তবুও নড়ে না যে! নিশ্চয় আরও কিছু পাবার মতলব আছে ওর মনে মনে। সুশীল চারিদিকে একবার তাকিয়ে দেখলে, কাছাকাছি কেউ নেই। পকেটে টাকা তিনটে ছাড়া সোনার বোতামও আছে জামায়, হঠাৎ এখন মনে পড়ল।
ও উত্তর দিলে–কলকাতাতেই বাড়ি, বালিগঞ্জে। আমার কাকা পুলিশে কাজ করেন কিনা, এদিকে রোজ বেড়াতে আসেন মোটর নিয়ে। এতক্ষণে এলেন বলে, রেড রোডে মোটর রেখে এখানেই আসবেন। আমি এখানে থাকি রোজ, উনি জানেন।
বেশ বাবু, আপনাকে দেখেই বড়ো ঘরানা বলে মনে হয়।