জামাতুল্লা বললে–আমি এক্ষুনি ফিরে আসছি লণ্ঠন নিয়ে বাবুজি। আপনি ওপরে উঠে বসুন, এ পাতালের মধ্যে একা থাকবেন না–
সুশীল বললে–না, তুমি যাও–আমি এখানেই থাকব। পকেটে একটুকরো মোমবাতি এনেছি–তাই জ্বালাব।
একটুকরো বাতি জ্বালিয়ে সুশীল ঘরটার মধ্যে বসে ভাবতে লাগল। বাইরে এত বড়ো রাজ্য যারা প্রতিষ্ঠা করেছিল, কোন জিনিস গোপন করবার জন্যে তারা এই পাতালপুরী তৈরি করেছিল, এত কষ্ট স্বীকার করে নর্তকীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করবার জন্যে নয় নিশ্চয়ই।
হঠাৎ নর্তকী পুতুলটার দিকে ওর দৃষ্টি পড়তে ও বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হয়ে গেল। কী ব্যাপার এটা?
এতক্ষণ মূর্তিটার যতখানি তার দিকে ছিল, সেটা যেন সামান্য একটু পাক খেয়ে খানিকটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
সুশীল চোখ মুছে আবার চাইলে।
হ্যাঁ, সত্যিই তাই। এই বাতিটার সামনে ছিল ওই পা-খানা–এখন পায়ের হাঁটুর পেছনের অংশ দেখা যায় কী করে? সে তো অতটুকু নড়েনি নিজে, যেখানে, সেখানেই বসে আছে।
সুশীলের ভয় হল। শ্মশানপুরীর ভূগর্ভস্থ কক্ষ, কত শতাব্দীর পুঞ্জীভূত দৈত্যদানোর দল জমা হয়ে আছে এসব জায়গায় কে বলতে পারে? কীসে মৃত্যু আর কীসে জীবন, এ বার্তা পোঁছে দেবার লোক নেই। সরে পড়াই ভালো।
এমন সময় ওপর থেকে লণ্ঠনের আলো এসে পড়ল, পায়ের শব্দ শোনা গেল। জামাতুল্লা লণ্ঠন নিয়ে ঘরের মধ্যে ওপর থেকে উঁকি মেরে বললে–বাবুজি, ঠিক আছেন?
তা আছি। ঘরের মধ্যে নামো জামাতুল্লা—
জামাতুল্লা ঘরের মেঝেতে নেমে ওর পাশে দাঁড়াল। সুশীল ওকে মূর্তির ব্যাপারটা দেখিয়ে বললে–এখন তুমি কী মনে কর?
কিছু বুঝতে পারছি নে বাবুজি-খুব তাজ্জব কথা!
তুমি থাকো এখানে–বোসো—
কিন্তু জামাতুল্লা দাঁড়াল না। দু-জনে এখানে বসে থাকলে ইয়ার হোসেনের দলের সন্দেহ ঘোরালোরকম হয়ে উঠবে, সে থাকতে পারবে না। জামাতুল্লা চলে যাবার পর সুশীল অনেকক্ষণ মূর্তিটার দিকে চেয়ে বসে রইল। মূর্তিটা এবার বেশ ঘুরে গিয়েছে, এ সম্বন্ধে আর কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। ওর আগের ভয়ের ভাবটা কেটে গিয়েছিল জামাতুল্লা লণ্ঠন নিয়ে আসার পর থেকে, এখন ভয়ের চেয়ে কৌতূহল বেশি!
খুব একটু একটু করে ঘুরছে, ঘূর্ণমান রঙ্গমঞ্চের মতোই, মূর্তির পদতলস্থ বিটঙ্কবেদিকা।
কেন? কী উদ্দেশ্য? অতীত শতাব্দীগুলি মূক হয়ে রইল, এর জবাব মেলে না। বেলা গড়িয়ে এল, সুশীলের হাতঘড়িতে বাজে পাঁচটা।
হঠাৎ সুশীল চেয়ে দেখলে আর একটি আশ্চর্য ব্যাপার।
নর্তকী-মূর্তির সরু সরু আঙুলগুলির মধ্যে একটা আঙুল একটি মুদ্রা রচনা করার দরুন অন্য সব আঙুল থেকে পৃথক এবং একদিকে কী যেন নির্দেশ করবার ভঙ্গিতে ছিল। এবার যেন আঙুলের ছায়া পড়েছে দেওয়ালের এক বিশেষ স্থানে।
এমন ভঙ্গিতে পড়েছে যেন মনে হয় মূর্তিটি তর্জনী-অঙ্গুলির দ্বারা ভিত্তিগাত্রের একটি স্থান নির্দেশ করছে।
তখনি একটা কথা মনে হল সুশীলের। লণ্ঠনের আলোর দ্বারা এ ছায়া তৈরি হয়েছে, না কোনো গুপ্ত ছিদ্রপথে দিবালোক প্রবেশ করেছে ঘরের মধ্যে?
তা-ই বলে মনে হয়, লণ্ঠনের আলোর কৃত্রিম ছায়া ও নয়। ও লণ্ঠনের আলো কমিয়ে দিয়ে দেখলে–তখন অস্পষ্ট আলো-অন্ধকারের মধ্যেও তর্জনীর ছায়া ভিত্তিগাত্রে পড়ে একটা স্থান যেন নির্দেশ করছে।
অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে উঠে ও জায়গাটা দেখতে গেল।
দেওয়ালের সেই জায়গা একেবারে সমতল, চিহ্নহীন–চারিপাশের অংশের সঙ্গে পৃথক করে নেওয়ার মতো কিছুই নেই সেখানে। তবুও সে নিরাশ না হয়ে দেওয়ালের সেই জায়গাটাতে হাত বুলিয়ে দেখতে গেল।
হাত দেবার সঙ্গেসঙ্গে একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটল। ঠিক যেখানে আঙুলের অগ্রভাগ শেষ হয়েছে সেই স্থানের খানিকটা যেন বসে গেল–অর্থাৎ ঢুকে গেল ভেতরের দিকে। একটা শব্দ হল পেছনের দিকেও পেছন ফিরে চেয়ে দেখলে বিটঙ্কবেদিকার তলাটা যেন ঈষৎ ফাঁক হয়ে গিয়েছে।
ও ফিরে এসে ভালো করে লক্ষ করে দেখলে, গোলাকার বেদিকাটি তার নর্তকী-মূর্তিটাসুদ্ধ যেন একটা পাথরের ছিপি। বড়ো বোতলের মুখে যেমন কাঁচের স্টপার বা ছিপি থাকে, এ যেন পাষাণ-নির্মিত বিরাট এক স্টপার। কীসের চাড় লেগে স্টপারের মুখ ফাঁক হয়ে গিয়েছে।
ও নর্তকীমূর্তির পাদদেশে এবং গ্রীবায় দুই হাত দিয়ে মূর্তিটাকে একটু ঘুরিয়ে দেবার চেষ্টা করতেই সেটা সবসুদ্ধ বেশ আস্তে আস্তে ঘুরতে লাগল। কয়েকবার ঘোরবার পরে ক্রমেই তার তলার ফাঁক চওড়া হয়ে আসতে লাগল। কী কৌশলে প্রাচীন শিল্পী পাথরের উপরটাকে ঘূর্ণমান করে তৈরি করেছিল?
এই মূর্তিসুদ্ধ বেদিকা টেনে তোলা তার একার সাধ্যে কুলবে না। জামাতুল্লা ও সনৎ দু জনকেই আনতে হবে কোনো কৌশলে সঙ্গে করে, ইয়ার হোসেনের দলের অগোচরে।
সন্ধ্যার অন্ধকার নামবার বিলম্ব নেই। বহু দিন-রাত্রির ছায়া অতীতের এ নিস্তব্ধ কক্ষে জীবনের সুর ধ্বনিত করেনি, এখানে গভীর নিশীথ রাত্রির রহস্য হয়তো মানুষের পক্ষে খুব আনন্দদায়ক হবে না, মানুষের জগতের বাইরে এরা।
সুশীল লণ্ঠন হাতে উঠে এল আঁধার পাতালপুরীর কক্ষ থেকে। তাঁবুতে ঢোকবার পথে ইয়ার হোসেন বড়ো ছুরি দিয়ে পাখির মাংস ছাড়াচ্ছে। সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে বললে–কোথায় ছিলেন?
ছবি আঁকতে, মি. হোসেন।
লণ্ঠন কেন?