সুশীল বললে–এর মানে কী জামাতুল্লা সাহেব?
বুঝলাম না বাবুজি। যদি যেতেই দেবে না, তবে সিঁড়ি গেঁথেছে কেন?
রাত হয়ে আসছে। ওরা দু-জনে টর্চ ফেলে চারিদিক ভালো করে দেখতে লাগল। হঠাৎ সুশীল চেঁচিয়ে উঠে বললে–দেখো, দেখো! দু-জনেই অবাক হয়ে দেখলে মাথার ওপরে পাথরের গায়ে ওদের পরিচিত সেই চিহ্ন খোদা–পদ্মরাগ মণির ওপর যে-চিহ্ন খোদা ছিল। ভারতীয় স্বস্তিক চিহ্ন, প্রত্যেক বাহুর কোণে এক-এক জানোয়ারের মূর্তি–সর্প, বাজপাখি, বাঘ ও কুমির।
এই সেই আঁক-জোঁক বাবুজি! কিন্তু এর মানে কী, সিঁড়ি বন্ধ করলে কেন, বুঝলেন কিছু?
দু-জনেই হতভম্ব হয়ে গেল। সুশীল সামনে পাথরখানাতে হাত দিলে, বেশ মসৃণ; মাপ নিয়ে চৌরশ করে কেটে কে তৈরি করে রেখেছে।
কিছুই বোঝা গেল না–অবশেষে হতাশ হয়ে ওরা গর্ত থেকে উঠে পড়ে তাঁবুতে ফিরে এল সনৎকে নিয়ে। সেখানে কাউকে কিছু বললে না। পরদিন দুপুর বেলা সুশীল একা জায়গাটায় গেল। আবার সুড়ঙ্গের মধ্যে নামলে। ওর মনে একথা বিশেষভাবে জেগে ছিল, লোকে এইটুকু গর্তে ঢুকবার জন্যে এরকম সিঁড়ি গাঁথে না। এ সুড়ঙ্গ নিশ্চয় আরও অনেক বড়ো। কিন্তু তবে দশ ধাপ নেমেই পাথর দিয়ে এমন শক্ত করে বোজানো কেন?
এ গোলমেলে ব্যাপারের কোনো মীমাংসা করা যায় না দেখা যাচ্ছে। সুশীল চারিদিকে চেয়ে দেখলে মাথার ওপরে পাথরের গায়ে সেই অদ্ভুত চিহ্নটি সুস্পষ্ট খোদাই করা আছে। এ চিহ্নই বা এখানে কেন? ভালো করে চেয়ে চিহ্নটি দেখতে দেখতে ওর চোখে পড়ল, যে পাথরের গায়ে চিহ্নটি খোদাই করা তার এক কোণের দিকে আর একটা কী খোদাই করা আছে। সুড়ঙ্গের মধ্যে অন্ধকার খুব না হলেও তেমন নয়। সুশীল টর্চ ফেলে ভালো করে দেখলে–চিহ্নটি আর কিছুই নয়, ঠিক যেন একটি বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ রাখবার সামান্য খোল। খোলের চারিপাশে দুটি লতার আকারের বলয় কিংবা অন্য কোনো অলংকার পরস্পর যুক্ত। সুশীল কী মনে ভেবে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের খোলে নিজের বুড়ো আঙুল দিয়ে চেপে দেখতে গেল।
সঙ্গেসঙ্গে সামনের পাথর যেন কলের দোরের মতো সরে একটা মানুষ যাবার মতো ফাঁক হয়ে গেল। সুশীল অবাক! এ যেন সেই আরব্য উপন্যাসের বর্ণিত আলিবাবার গুহা।
সে বিস্মিত হয়ে চেয়ে দেখলে, সিঁড়ির পর সিঁড়ি ধাপে ধাপে নেমে গিয়েছে। সুশীল সিঁড়ি দিয়ে নামবার আগে উঁকি মেরে চাইলে অন্ধকার সুড়ঙ্গপথে। বহু যুগ আবদ্ধ দূষিত বাতাসের বিষাক্ত নিশ্বাস যেন ওর চোখে-মুখে এসে লাগল। তখন কিন্তু সুশীলের মন আনন্দে কৌতূহলে চঞ্চল হয়ে উঠেছে, বসে ভাববার সময় নেই। ও তাড়াতাড়ি কয়েক ধাপ নেমে গেল।
আবার সিঁড়ি বেঁকে গিয়েছে কিছুদূর গিয়ে। এবার আর সামনে পাথর নেই, সিঁড়ি এঁকে বেঁকে নেমে চলেছে। সুশীল একবার ভাবলে তার আর যাওয়া উচিত নয়। কতদূর সিঁড়ি নেমেছে এই ভীষণ অন্ধকূপের মধ্যে কে জানে? কিন্তু কৌতূহল সংবরণ করা ওর পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ল। ও আরও অনেকখানি নীচে নেমে গিয়ে দেখলে এক জায়গায় সিঁড়ি হঠাৎ শেষ হয়ে গেল। টর্চ জ্বেলে নীচের দিকে ঘুরিয়ে দেখলে, কোনো দিকে কিছুই নেই–পাথর বাঁধানো চাতাল বা মেঝের মতো তলাটা সব শেষ, আর কিছু নেই। ইংরেজিতে যাকে বলে dead end ও সেখানে পৌঁছে গিয়েছে। সুশীল হতভম্ব হয়ে গেল।
যারা এ সিঁড়ি গেঁথেছিল তারা কী জন্যে এত সতর্কতার সঙ্গে এত কষ্ট করে সিঁড়ি গেঁথেছিল যদি সে সিঁড়ি কোথাও না পৌঁছে দেয়।
চাতালের দৈর্ঘ্য হাত-তিনেক, প্রস্থ হাত আড়াই। খুব একখানা বড়ো পাথরের দ্বারা যেন সমস্ত মেঝে বা চাতালটা বাঁধানো। তন্ন-তন্ন করে খুঁজে চাতালের কোথাও কিছু পাওয়া গেল না। সুশীল বাধ্য হয়ে বোকা বনে উঠে চলে এসে জামাতুল্লা ও সনৎকে সব বললে, ওরা পরদিন লুকিয়ে তিনজনে সেখানে গেল, সিঁড়ি দিয়ে নামলে। সামনে সেই চাতাল। সিঁড়ির শেষ।
জামাতুল্লা বললে–এ কী তামাশা আছে বাবুজি–আমি তো বেকুব বনে গেলাম!
তিন জনে মিলে নানা ভাবে পাথরটা দেখলে, এখানে টিপলে ওখানে চাপ দিলে– হিমালয় পর্বতের মতোই অনড়। কোথাও কোনো চিহ্ন নেই পাথরের গায়ে। মিনিট কুড়ি কেটে গেল। মিনিট কুড়ি সেই অন্ধকার ভূগর্ভে কাটানো বিপজ্জনকও বটে, অস্বস্তিকরও বটে।
সুশীল বললে–ওঠো সবাই, আর না এখানে।
হঠাৎ জামাতুল্লা বলে উঠল–বাবুজি, একটা কথা আমার মনে এসেছে!
দু-জনেই বলে উঠল–কী? কী?
গাঁতি দিয়ে এই পাথরখানা খুঁড়ে তুলে দেখলে হয়। কী বলেন?
তখন ওরাও ভাবলে এই সামান্য কথাটা। যে কথা, সেই কাজ। জামাতুল্লা লুকিয়ে তাঁবু থেকে গাঁতি নিয়ে এল। পাথর খুঁড়ে শাবলের চাড় দিয়ে তুলে ফেলে যা দেখলে তাতে ওরা যেমন আশ্চর্য হল তেমনি উত্তেজিত হয়ে উঠল। আবার সিঁড়ির ধাপ। কিন্তু দশ ধাপ নেমে গিয়ে সিঁড়ি বেঁকে গেল–আবার সামনে চৌরশ পাথর দিয়ে সুড়ঙ্গ বোজানো। মাথার ওপরকার পাথরে পূর্ববৎ চিহ্ন পাওয়া গেল। বুড়ো আঙুল দিয়ে টিপে আবার সে পাথর ফাঁক হল। আবার সিঁড়ি। কিন্তু কিছুদূর নেমে আবার পাথর-বাঁধানো চাতাল–আবার সেই dead end, নির্দেশহীন শূন্য।
অমানুষিক পরিশ্রম। আবার পাথর তুলে ফেলা হল–আবার সিঁড়ি। সুশীল বললে, যারা এ গোলকধাঁধা করেছিল, তারা খানিকদূর গিয়ে একবার একখানা পাথর সোজা করে পথ বুজিয়েছে, তার পরেরটা সিঁড়ির মতো পেতে বুজিয়েছে–এই এদের কৌশল, বেশ বোঝা যাচ্ছে। জামাতুল্লা ওদের সতর্ক করে দিলে–বললে–বাবুজি, অনেকটা নীচে নেমে এসেছি। খারাপ গ্যাস থাকতে পারে, দমবন্ধ হয়ে মারা যেতে পারি সবাই। তাঁবুতেও সন্দেহ করবে। চলুন আজ ফিরি।