ইয়ার হোসেন তাকে ধমক দিয়ে কী বলতে যাচ্ছে, এমন সময় একটি সুন্দর পাখি এসে সামনের বন্য রবারের গাছের ডাল থেকে মন্দিরের ভাঙা পাথরের কার্নিশে বসল। সবাই হাঁ করে চেয়ে রইল পাখিটার দিকে। কী সুন্দর! দীর্ঘ পুচ্ছ ঝুলে পড়েছে কার্নিশ থেকে প্রায় এক হাত–ময়ুরের পুচ্ছের মতো। হলদে ও সাদা আঁখি পালকের গায়ে–পিঠের পালকগুলো ঈষৎ বেগুনি!
ইয়ার হোসেন বললে–টিকাটুরা, যাকে সাহেব লোক বলে বার্ড অব প্যারাডাইজ–খুব সুলক্ষণ।
সনৎ বললে–বাঃ কী চমৎকার! এই সেই বিখ্যাত বার্ড অব প্যারাডাইজ! কত পড়েছি ছেলেবেলায় এদের কথা
সুশীল বললে–সুলক্ষণ কুলক্ষণ দু-রকমই দেখছি। কুমির নিলে একজনকে, আবার বার্ড অব প্যারাডাইজ দেখা গেল একটা সুলক্ষণ–
মন্দিরের বিভিন্ন কুঠরি। প্রত্যেক কুঠরির দেওয়ালে সারবন্দি খোদাই কাজ। সুশীল একখানা পাথরের ইট মনোযোগের সঙ্গে দেখলে। একজন ভারতবর্ষীয় হিন্দু রাজা সিংহাসনে উপবিষ্ট, তাঁর পাশে বোধহয় গ্রহবিপ্র পাঁজি পড়ছেন। সামনে একসার লোক মাথা নীচু করে যেন রাজাকে অভিবাদন করছে। রাজার এক হাতে একটা কী পাখি–হয় পোষা শুক, নয়তো শিকরে বাজ।
ভারত! ভারত! কত মিষ্টি নাম, কী প্রাচীন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অমূল্য ভান্ডার। তার নিজের দেশের মানুষ একদিন কম্পাস-ব্যারোমিটারহীন যুগে সপ্ত সমুদ্রে পাড়ি দিয়ে এখানে এসে হিন্দুধর্মের নিদর্শন রেখে গিয়েছিল, তাদের হাতে-গড়া এই কীর্তির ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে গর্বে ও আনন্দে সুশীলের বুক দুলে উঠল। বীর তারা, দুর্বল হাতে অসি ও বর্শা ধরেনি, ধনুকে জ্যা রোপণ করেনি–সমুদ্র পাড়ি দিয়েছে–এই অজ্ঞাত বিপদসংকুল মহাসাগর হিন্দুধর্মের জয়ধ্বজা উড়িয়ে দিগবিজয় করে নটরাজ শিবের পাষাণ-দেউল তুলেছে সপ্তসমুদ্র পারে।
পরবর্তী যুগের যারা স্মৃতিশাস্ত্রের বুলি আউড়ে টোলের ভিটেয় বাঁশবনের অন্ধকারে বসে বলে গিয়েছিল–সমুদ্রে যেও না, গেলে জাতটি একেবারে যাবে, হিন্দুত্ব একেবারে লোপ পাবে,তারা ছিল গৌরবময় যুগের বীর পূর্বপুরুষের অযোগ্য বংশধর, তাদের স্নায়ু দুর্বল, মন দুর্বল, দৃষ্টি ক্ষীণ, কল্পনা স্থবির।
তারা হিন্দু নয়–হিন্দুর কঙ্কাল।
দু-দিন ধরে ওরা বনের মধ্যে কত প্রাচীন দেওয়াল, ধ্বংসস্তূপ, দরজা, খিলান ইত্যাদি দেখে বেড়ালো। জ্যোৎস্না রাত্রি, গভীর রাত্রে যখন ওরাংওটাংয়ের ডাকে চারপাশের ঘন জঙ্গল মুখরিত হয়ে ওঠে, অজ্ঞাত নিশাচর পক্ষীর কুস্বর শোনা যায়, বন্য রবারের ডালপালায় বাদুড় ঝটাপটি করে, তখন এই প্রাচীন হিন্দু নগরীর ধ্বংসস্তূপে বসে সুশীল যেন মুহূর্তে কোন মায়ালোকে নীত হয়–অতীত শতাব্দীর হিন্দু সভ্যতার মায়ালোক–দিগবিজয়ী বীর সমুদ্রগুপ্ত কবি ও বীণ-বাজিয়ে যে মহাযুগের প্রতীক, হুনবিজেতা মহারথ স্কন্দগুপ্তের কোদন্ড টঙ্কারে যে যুগের আকাশ সন্ত্রস্ত।
সুশীল স্বপ্ন দেখে! সনৎকে বলে–বুঝলি সনৎ, জামাতুল্লাকে যথেষ্ট ধন্যবাদ যে ও আমাদের এনেছে এখানে। এসব না দেখলে ভারতবর্ষের গৌরব কিছু বুঝতাম না!
সনৎ একথায় সায় দেয়। টাকার চেয়ে এর দাম বেশি।
ইয়ার হোসেন কিন্তু এসব বোঝে না। সে দিন দিন উগ্র হয়ে উঠেছে। এই নগরীর ধ্বংসস্তূপে প্রায় দশদিন কাটল। অথচ ধনভান্ডারের নামগন্ধও নেই, সন্ধানই মেলে না। জামাতুল্লাকে একদিন স্পষ্ট শাসালে–যদি টাকাকড়ির সন্ধান না মেলে তো তাকে এই জঙ্গলে টেনে আনবার মজা সে টের পাইয়ে দেবে।
জামাতুল্লা সুশীলকে গোপনে বললে–বাবুজি, ইয়ার হোসেন বদমাইস গুণ্ডা–ও না কী গোলমাল বাধায়।
সুশীল ও সনৎ সর্বদা সজাগ হয়ে থাকে রাত্রে, কখন কী হয় বলা যায় না। ইয়ার হোসেনের সশস্ত্র অনুচরের দল দিন-দিন অসংযত হয়ে উঠছে।
একদিন জামাতুল্লা, বনের মধ্যে খুঁজতে খুঁজতে এক জায়গায় একটি বড়ো পাথরের থাম আবিষ্কার করলে। থামের মাথায় ভারতীয় পদ্ধতি অনুসারে পদ্ম তৈরি করা হয়েছে। সুশীলকে ডেকে নিয়ে গেল জামাতুল্লা, সুশীল এসব দেখে খুশি হল। সুশীল ও সনৎ দু-জনে গভীর বনের মধ্যে ঢুকে থামটা দেখতে গেল।
সেখানে গিয়েই সুশীল দেখলে থামটার সামনে আড়ভাবে পড়ে প্রকান্ড একটা পাথরের চাঙড়–যেন একখানা চৌরশ করা শানের মাঝে। সুশীল ক্যামেরা এনেছে থামটার ফোটো নেবে বলে, পাথরটা সরিয়ে না দিলে পদ্মটির ছবি নেওয়া সম্ভব না।
জামাতুল্লা বললে–পাথরখানা ধরাধরি করে এসো সরাই।
সরাতে গিয়ে পাথরখানা যেই কাত অবস্থা থেকে সোজা হয়ে পড়ল, অমনি সনৎ চিৎকার করে বললে–দেখো, দেখো–
সকলে সবিস্ময়ে দেখলে, যেখানে পাথরটা ছিল, সেখানে একটা সুড়ঙ্গ যেন মাটির নীচে নেমে গিয়েছে। জামাতুল্লা ও সুশীল সুড়ঙ্গের ধারে গিয়ে উঁকি মেরে দেখলে, সুড়ঙ্গটা হঠাৎ বেঁকে গিয়েছে, প্রথমটা সেজন্য মনে হয় গর্তটা নিতান্তই অগভীর।
সুশীল বললে–আমি নামব–
জামাতুল্লা বললে–তা কখনো করতে যাবেন না, বিপদে পড়বেন। কী আছে গর্তের মধ্যে কে জানে!
সুশীল বললে–নেমে দেখতেই হবে। আমি এখানে থাকি, তোমরা গিয়ে তাঁবু থেকে মোটা দড়ি হাত-চল্লিশ, টর্চ আর রিভলবার নিয়ে এসো। ইয়ার হোসেনকে কিছু বোলো না।
সব আনা হল। সুশীল জামাতুল্লা দু-জনে সুড়ঙ্গের মধ্যে নামলে। খানিক দূর নামলে ওরা। পাথরে বাঁধানো সিঁড়ি, পনেরো-ষোলো ধাপ নেমেই কিন্তু দু-জনে হতাশ হল দেখে, সামনে আর রাস্তা নেই। সিঁড়ি গিয়ে শেষ হয়েছে, একটা গাঁথা দেওয়ালের সামনে।