সুশীল বললে–আমরা দৈর্ঘ্য অতিক্রম করেছি–প্রস্থ ধরে চলেছি। বুঝেছেন মি. হোসেন।
এবার বুঝলাম। ওদিকে যে দল গিয়েছে তারা ওদিকের শেষ প্রান্তে পৌঁছে বন্দুক ছুড়ছে। অন্তত সাত মাইল দূর এখান থেকে।
পরদিন বেলা দশটার মধ্যে নগরীর সিংহদ্বার পাওয়া গেল। সেখানটাতে পরিখার ওপর পাথরের সেতু। এপারে সেতু রক্ষার জন্যে দুর্গ ছিল, বর্তমানে প্রকান্ড ভরা ঢিবি।
সকলে ব্যস্ত হয়ে সেতু পার হয়ে সিংহদ্বার লক্ষ করে অল্প কিছুদূর অগ্রসর হয়েই থেমে গেল।
সিংহদ্বারের খিলান ভেঙে পড়ত–যদি বট-জাতীয় কয়েকটি বৃক্ষের শিকড় আষ্টেপৃষ্ঠে তাকে না জড়িয়ে ধরে রাখত। সিংহদ্বারের দু-পাশে অদ্ভুত দুই প্রস্তরমূর্তি–নাগরাজ বাসুকি ফণা তুলে আছে সামনে, পেছনে তিনমুখবিশিষ্ট কোনো দেবতার মূর্তি। সূর্যের আলো ওপরের বটবৃক্ষের নিবিড় ডালপালা ভেদ করে মূর্তি দু-টির গায়ে বাঁকাভাবে এসে পড়েছে।
গম্ভীর শোভা। সুশীল শুধু নয়, দলের সকলেই দাঁড়িয়ে মুগ্ধ নেত্রে চেয়ে রইল এই কারুকার্যময় সিংহদ্বার ও প্রাচীন যুগের শিল্পীর হাতের এই ভাস্কর্যের পানে।
সুশীল হাতজোড় করে প্রণাম করলে মূর্তি দু-টির উদ্দেশ্যে। সে পুরাতত্ত্ব বা দেবমূর্তি সম্বন্ধে অভিজ্ঞ না হলেও আন্দাজ করলে এ দুটি তিনমুখবিশিষ্ট শিবমূর্তি।
সুলু সমুদ্রের এই জনহীন অরণ্যাবৃত দ্বীপে প্রাচীন ভারতের শক্তি ও তেজ একদিন এই দেবমূর্তিকে স্থাপিত করেছিল। আজ ভারত অধঃপতিত,–দাসত্বের শৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত। হে দেব, তোমার যে ভক্তগণ তোমাকে এখানে বাহুবলে প্রতিষ্ঠিত করেছিল তারা আজ নেই– তাদের অযোগ্য বংশধরকে তুমি সেই শৌর্য ও সাহস ভিক্ষা দাও, তাদের বীরপুরুষদের বংশধর করে দাও, হে রুদ্রভৈরব!
ইয়ার হোসেন পর্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েছিল। এই বিরাট ভাস্কর্যের সম্মুখে দাঁড়িয়ে সে বললে–যদি আমার দিন আসে, এই মূর্তি সিঙ্গাপুরের মিউজিয়ামে দান করবার ইচ্ছে রইল–
সুশীল বললে–তা কখনো করবেন না মি. হোসেন, যেখানকার দেবতা সেইখানেই তাঁকে শান্তিতে থাকতে দিন। অমঙ্গলকে ডেকে আনবেন না।
সিংহদ্বার অতিক্রম করে ওরা নগরীর মধ্যে ঢুকল। কিন্তু অল্প কিছুদূর গিয়েই দেখলে, এত দুর্ভেদ্য জঙ্গল যে দশ হাত এগিয়ে যাবার উপায় নেই বন না কাটলে। সিংহদ্বারের সামনেই নিশ্চয় প্রাচীন নগরের রাজপথ ছিল, কিন্তু বর্তমানে সে রাজপথের ওপরই তিন-চার-শো বছরের পুরোনো বট-জাতীয় বৃক্ষ, বন্য রবার, বন্য ডুমুর গাছ! এইসব বড়ো গাছের নীচে আগাছা ও কাঁটালতার জঙ্গল। ওরাংওটাংও এই জঙ্গল ভেদ করে অগ্রসর হতে পারে না– মানুষ কোন ছার।
ইয়ার হোসেনের হুকুমে মালয় অনুচরেরা বোলো দিয়ে জঙ্গল কেটে কোনোরকমে একটু সঁড়িপথ বার করতে করতে সোজা চলল।
সুশীল বললে–এ জঙ্গল তো দেখছি নগরের বাইরে যেমন ছিল এখানেও তেমনি। কেবল এটা পাঁচিলের মধ্যে এই যা তফাত। কে একজন চেঁচিয়ে উঠল–দেখুন! দেখুন!
সকলে সবিস্ময়ে চেয়ে দেখল, সামনে প্রকান্ড একটা মন্দিরের চূড়া লতাঝোঁপের আবরণ থেকে অনেক উঁচুতে মাথা বের করে দাঁড়িয়ে আছে। মন্দিরের কাছে যাবার কোনো উপায় নেই–অনেক দূর থেকে বড়ো-বড়ো দেওয়াল ভাঙা পাথর ছড়িয়ে জঙ্গলাবৃত হয়ে পড়ে আছে অন্তত দেড়-শো হাত পর্যন্ত।
ওরা ডিঙিয়ে লাফিয়ে কোনোরকমে মন্দিরের সামনে বড়ো চত্বরের কাছে এল–কিন্তু সামনেই গোপুরমের মতো উঁচু পাইলন টাওয়ার। তার সুবিশাল পাথরের খিলান ফেটে চৌচির হয়ে সিংহদ্বারের মতোই আষ্টেপৃষ্ঠে বড়ো বড়ো শেকড় আর লতার বাঁধনে আজ কত যুগ যুগ ধরে ঝুলছে–তার ঠিকানা কারো কাছে নেই। গোপুরম ছাড়িয়ে মন্দিরের দেওয়াল, বিকটাকার দৈত্যের মুখের মতো সারি সারি অনেকগুলি মুখ দেওয়ালের গায়ে বেরিয়ে আছে–সুশীল আঙুল দিয়ে ওদের দেখিয়ে বললে–দেখো কী চমৎকার কাজ! হয় পাথরের কড়ি নয়তো পয়োনালি, যাকে ইংরেজিতে বলে গর্গয়েল। অর্থাৎ বিকট জানোয়ারের মুখ বসানো নালি।
সকলেই অবাক হয়ে সেই কল্পনাসৃষ্ট ভীষণ মুখগুলোর দিকে চেয়ে রইল। সুন্দরকে গড়ে তোলে সেও যেমন কৌশলী শিল্পী, ভীষণকে যে রূপ দেয়, সে শিল্পীও ঠিক তত বড়ো। সুশীলের মনে পড়ল আনাতোল ফ্রাঁসের সেই গল্প, শয়তানকে এমন বিকট করে আঁকলে শিল্পী যে, রাতের অন্ধকারে শয়তান এসে শিল্পীকে জাগিয়ে জিজ্ঞেস করলে–তুমি আমাকে এর আগে কোথায় দেখেছিলে যে অমন করে এঁকেছ? শিল্পী বললে–আপনি কে?
শয়তান বললে–আমি লুসিফার। যাকে তোমরা বল শয়তান। ও নামটায় আমার ভয়ানক আপত্তি তা জান? তুমি কী বিশী করে এঁকেছ আমায়! আমি কি অত খারাপ দেখতে? দেখো না আমার দিকে চেয়ে!
শিল্পী দেখলে শয়তানের মূর্তি দেখতে বেশ সুন্দর, তবে মুখশ্রী ঈষৎ বিষণ্ণ। ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বললে–আমায় মাপ করুন, আমি এর আগে দেখিনি আপনাকে। আমি স্বীকার করছি আমার ভুল হয়েছে। আমি ভুল শুধরে নেব–
শয়তান হাসতে হাসতে বললে–তাই শুধরে নাও গে যাও–নইলে তোমার কান মলে দেব–
৩. মন্দিরের প্রাঙ্গণে
যাক। ওরা সবাই খিলানের তলা দিয়ে অগ্রসর হয়ে মন্দিরের মধ্যেকার প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়াল। শুধু ভীষণ কাঁটাগাছ আর বেত, যা থেকে মলঙ্কা বেতের ছড়ি হয়।
সনৎ ছেলেমানুষ, ভালো বেত দেখে বলে উঠল–দাদা, একটা বেত কাটব?