একদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে বন কাটতে কাটতে মোটে মাইল তিনেক এগিয়ে যেতে সক্ষম হল।
সন্ধ্যার দিকে ইয়ার হোসেন বললে–এখানে আজ তাঁবু ফেলা যাক।
কিন্তু তাঁবু ফেলবে কোথায়? সুশীল চারিদিকে চেয়ে দেখলে ভয়ানক ঘন জঙ্গলের মধ্যে বড়ো বড়ো দোলানো লতার তলায় ভিজে স্যাঁৎসেঁতে মাটির ওপর রাত্রে বাস করতে হবে। আজ সারাদিনের অভিজ্ঞতায় এরা দেখেছে এখানকার জঙ্গলে তিনরকম জীব যেখানে সেখানে বাস করে–যে তিনটিই মানুষের শত্রু। প্রথম, বড়ো বড়ো রক্ত-শোষক জোঁক; দ্বিতীয়, বিষধর সর্প; তৃতীয়, মৌমাছি। এই তিনটি শত্রুর কোনোটাই কম নয়–যেকোনোটার আক্রমণ মানুষের জীবন বিপন্ন হবার পক্ষে যথেষ্ট।
কোনো রকমে তাঁবু খাটানো হল।
ঘুমের মধ্যে কখন ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল–ট্রপিক্যাল অরণ্যের এ অঞ্চলে বৃষ্টি লেগেই আছে, এমন দিন নেই যে বৃষ্টি হয় না। ঘুমের মধ্যে সুশীল দেখলে তাঁবুর ফাঁক দিয়ে কখন বৃষ্টির জলের ধারা গড়িয়ে এসে ওদের বিছানা ভিজিয়ে দিয়েছে। বাইরে বৃষ্টির বিরাম নেই।
হঠাৎ চারিদিক কাঁপিয়ে কোথায় এক গুরুগম্ভীর নিনাদ শোনা গেল–সমস্ত অরণ্য যেন কেঁপে উঠল।
সনৎ চমকে উঠে বললে–কে ডাকে দাদা?
অন্য তাঁবু থেকে ইয়ার হোসেন বলে উঠল–ও কীসের ডাক?
কেউ কিছু জানে না। না জামাতুল্লা না ইয়ার হোসেন–কেবল ইয়ার হোসেনের জনৈক অনুচর বললে–ওটা বুনো হাতির ডাক স্যার।
আর একজন অনুচর প্রতিবাদ করে বললে–ওটা গন্ডারের ডাক।
কিছুমাত্র মীমাংসা হল না এবং আবার সেই ডাক, সঙ্গেসঙ্গে অন্য এক জানোয়ারের ভীষণ গর্জন। সেটা শুনে অবশ্য সকলেই বুঝতে পারলে–বাঘের গর্জন।
এরই ফাঁকে আবার বন-মোরগও ডেকে উঠল। সময়ে এক-পাল বন্য কুকুরের ডাকও।
সনৎ বললে–ও দাদা, এ যে ঘুমোতে দেয় না দেখছি—
সুশীল উত্তর দিলে–কানে আঙুল দিয়ে থাকো—
ইয়ার হোসেন বললে–রাইফেল নিয়ে বসে থাকতে হবে–কেউ ঘুমিও না–
এটা নিতান্ত প্রথম দিন বলে এদের ভয় ছিল বেশি, দু-একদিনের মধ্যে জন্তুজানোয়ারের আওয়াজ গা-সওয়া হয়ে গেল। নিবিড় ট্রপিক্যাল জঙ্গলের মধ্যে প্রতি রাত্রেই নানা বন্য জানোয়ারের বিচিত্র আওয়াজ–আওয়াজ যা করে, তাঁবুর আশে-পাশেই করে–কিন্তু তাঁবুর লোককে আক্রমণ করে না।
সুশীল দু-দিন ঘুমোতে পারেনি–কিন্তু তিন রাত্রির পরে সে বেশ স্বচ্ছন্দে ঘুমোতে পারলে।
জঙ্গলের কূল-কিনারা নেই–ওরা পাঁচদিন ধরে জঙ্গলের মধ্যে ঘুরেও কোনো কিছুই দেখতে পেলে না সেখানে–ওই বন আর বন।
সূর্যের আলো না দেখে সুশীল তো হাঁপিয়ে উঠল। এ জঙ্গলে সূর্যের আলো আদৌ পড়ে না।
আগে দেশে থাকতে সে দু-একখানা ভ্রমণের বইতে পড়েছিল যে মেক্সিকোতে, মালয়ে, আফ্রিকায় এমন ধরনের বন আছে, যেখানে কখনো সূর্যালোক প্রবেশ করে না। কথাটা আলংকারিকের অত্যুক্তি হিসেবেই সে ধরে নিয়েছিল, আজ সে সত্যই প্রত্যক্ষ করলে এমন বন, যা চিরঅন্ধকারে আচ্ছন্ন, পড়ন্ত বেলায় কেবল সুউচ্চ বনস্পতিরাজির শীর্ষদেশ অস্তমান সূর্যের রাঙা আলোয় রঞ্জিত হয় মাত্র। ক্কচিৎ নিবিড় লতাঝোঁপের ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো চাঁদের আলো সামান্য-মাত্র পড়ে, নতুবা সকল সময়েই গোধূলি দিনমানে। চিরগোধূলির জগৎ এটা যেন।
একদিন সনৎ পড়ে গেল বিপদে।
তাঁবু থেকে বন্দুক হাতে শিকার করতে বার হয়ে সে একটা গাছের ডালে এক ভীষণ অজগর সাপ দেখে সেটাকে গুলি করলে। সাপটা দুলতে দুলতে গাছের ডাল থেকে পাক ছাড়িয়ে ঝুপ করে একবোঝা মোটা দড়াদড়ির মতো নীচে পড়ে গেল।
সনৎ সেটার কাছে গিয়ে দেখলে অজগরের মাথাটা গুলির ঘায়ে একেবারে গুঁড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু তার ল্যাজটা হঠাৎ এসে সনৎ-এর পা দু-খানা জড়িয়ে ধরে শক্ত কাঠ হয়ে গেল। সরীসৃপের হিমশীতল স্পর্শ সনতের স্নায়ুগুলোকে যেন অবশ করে দিলে, নিজের পা দু-খানাকে সে আর মোটেই নাড়তে পারলে না–হাতদুটোকে যখন কষ্টে নাড়ালে তখন লোহার শেকলের মতো নাগপাশের শক্ত বাঁধনে তার পদদ্বয় গতিশক্তিহীন।
অজগর তো মরে কাঠ হয়ে গেল, কিন্তু সনৎ চেষ্টা করেও কিছুতেই নাগপাশ থেকে পা ছাড়াতে পারলে না। পা যেন ক্রমশ অবশ হয়ে আসছে, এমনকী সনৎ-এর মনে হল আর কিছুক্ষণ এ অবস্থায় থাকলে সে চিরদিনর মতো চলৎশক্তি হারাবে। এদিকে বিপদের ওপর বিপদ, বেলা ক্রমশ পড়ে আসছে–এরই মধ্যে গোধূলি গিয়ে যেন সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসছে বনে। কিছুক্ষণ পরে দিক ঠিক করে তাঁবুতে প্রত্যাবর্তন অসম্ভব হয়ে পড়বে। আরও কিছুক্ষণ কাটল, শেয়ালের দল বনের মধ্যে ডেকে উঠল–একটু পরেই বন্য হস্তীর বৃংহিত অরণ্যভূমি কাঁপিয়ে তুলবে, হায়েনার অট্টহাসিতে বুকের রক্ত শুকিয়ে দেবে।
সনৎ সবই বুঝছে–কিন্তু কোনো উপায় নেই। বন্দুকটার আওয়াজ করলে তাঁবুর লোকদের তার সন্ধান দেওয়া চলত বটে কিন্তু বন্দুকে গুলি নেই। শেষ দুটো টোটা অজগরের দিকে সে ছুঁড়েছে।
তিমিরময়ী রাত্রি নামল।
অসহায় অবস্থায় চুপ করে কাত হয়ে পড়ে থাকা ছাড়া তার কোনো উপায় নেই। প্রথমটা তার মনে খুব ভয় হল–কিন্তু মরীয়ার সাহসে সাহসী হয়ে শেষ পর্যন্ত সে চুপ করে শুয়েই রইল। মৃত অজগরটাকে অন্ধকারে আর দেখা যায় না কিন্তু তার হিমশীতল আলিঙ্গন প্রতিমুহূর্তে সনৎকে স্মরণ করিয়ে দিতে লাগল যে প্রাণের বদলে সে প্রাণই নিতে চায়।