সে-কথা আর এখন ভেবে লাভ কী বল। ওদের নিয়েই কাজ করতে হবে যখন। ইয়ার হোসেনকে বলি কথাটা।
ইয়ার হোসেন সব শুনে জামাতুল্লাকে ডেকে বললে–কোনো সন্দেহ নেই তোমার? এই দ্বীপ ঠিক?
ঠিক।
আমরা নেমে কিন্তু জাঙ্ক ছেড়ে দেব–ঠিক করে দেখো এখনও।
সুশীল ও জামাতুল্লা আশ্চর্য হয়ে বললে–জাঙ্ক ছেড়ে দেবেন কেন?
আমি ওদের অন্য এক গল্প বলেছি। আমি বলেছি জঙ্গলে মাঠের ইজারা নিয়েছি ডাচ গভর্নমেন্টের কাছে–এখানে আমরা এখন থাকব কিছুদিন। ওদের বলতে চাই নে–চীনেরা লোক বড়ো ভালো না
দুপুরের পর জালি বোটে জিনিসপত্র ও দুটি ছোটো ছোটো তাঁবু সমেত ওদের সকলকে অদূরবর্তী দ্বীপের শিলাবৃত তীরভূমিতে নামিয়ে জাঙ্কের সারেং তার ভাড়া চুকিয়ে নিয়ে চলে গেল।
সুশীল ইয়ার হোসেনকে বললে–ডাচ ইস্ট ইণ্ডিজের দ্বীপ তো এটা? ডাচ গভর্নমেন্টের কোনো অনুমতি নেওয়া উচিত ছিল কিন্তু–
সেসব বড়ো হাঙ্গামা। ডাচ গভর্নমেন্টের কাছে কৈফিয়ত দিতে দিতে জান যাবে তাহলে; কেন যাচ্ছি আমরা–ও দ্বীপে কতদিন আমরা থাকব! হয়তো আমাদের সঙ্গে পুলিশ পাহারা থাকত–সব মাটি হত।
জামাতুল্লা দ্বীপের মাটিতে নেমে কেমন যেন স্বপ্নমুগ্ধের মতো চারিদিকে চেয়ে দেখতে লাগল। এতকাল পরে সে যে এখানে আসবে তা মেটেবুরুজের মাল্লাপাড়ার হোটেলে সানকিতে ভাত খেতে বসে কখনো কি ভেবেছিল? সে ভেবেছিল তার দুঃসাহসের জীবন শেষ হয়ে গিয়েছে। সেই বিহ্মমুনির দ্বীপ আবার!
সুশীল ভাবছিল, কী অদ্ভুত যোগাযোগ! বাংলা দেশের পাড়াগাঁয়ের জমিদারের ছেলে সে চিরকাল বসেই খাবে পায়ের ওপর পা দিয়ে, নির্বিঘ্নে জমিজমার খাজনা শোধ, দুপুরে লম্বা ঘুম দেবে, বিকেলে দুপুরে মাছ ধরবে, সন্ধ্যায় বৈঠকখানায় পৈতৃক তাকিয়া হেলান দিয়ে তাস দাবা খেলবে, রাত্রে পিঠে-পায়েস খেয়ে আবার ঘুম দেবে–এই সনাতন জীবনযাত্রা-প্রণালীর কোনো ব্যতিক্রম হয়নি তার পিতৃপিতামহের বেলায়–তার বেলাতেও সে-ধারা অক্ষুণ্ণই থাকত, দৈবক্রমে সেদিন গড়ের মাঠে জামাতুল্লা খালাসি তার কাছে ম্যাচিস চাইতে না আসত। কত সামান্য ঘটনা থেকে জীবনের কত বৃহৎ ও গুরুতর পরিবর্তন শুরু হয়।
সুশীল ও সনৎ দ্বীপের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। এ ধরনের ঘন বনানী এ পর্যন্ত তারা কোথাও দেখেনি–রীতিমতো ট্রপিক্যাল অরণ্য যাকে বলে, তা এতদিন সুশীল ছবিতেই দেখে এসেছে এবং ইংরেজি ভ্রমণের বইয়ে তার বর্ণনাই পড়ে এসেছে–এতকাল পরে তা সে দেখল। জলের ধার থেকেই অপরিচিত গাছপালার নিবিড় বন আরম্ভ হয়েছে–বনস্পতি মাতার বড়ো বড়ো গাছের গায়ে অর্কিডের ফুলগুলি সুগন্ধে প্রভাতের বাতাস মাতিয়েছে– মোটা মোটা লতা দুলছে এ গাছ থেকে ও গাছে। কত রঙের প্রজাপতি উড়ছে–সামনে সুনীল সমুদ্র প্রস্তরাকীর্ণ তীরভূমিতে এসে সজোরে ধাক্কা মারছে, একেবারে খোলা জলরাশি থইথই করছে দক্ষিণমেরু পর্যন্ত, একটা ব্রেকওয়াটার পর্যন্ত নেই কোথাও–যদি কেউ জলে পড়ে, তবে হাঙরের আহার্য হবে এ জানা কথা–এসব সমুদ্রে হাঙরের উপদ্রব অত্যন্ত বেশি সুশীল আগেই শুনেছে। বনের মধ্যে অনেক জায়গায় এখনও অন্ধকার কাটেনি–কারণ প্রভাতের রৌদ্র তার মধ্যে এখনও অনেক জায়গাতেই ঢোকেনি–দেখে বোধ হয়, দুপুরেও ঢোকে কিনা সন্দেহ।
ইয়ার হোসেন দেখে-শুনে বললে–এ যে ভীষণ জঙ্গল দেখছি–। জামাতুল্লা বললে– আগে যেমন দেখেছিলাম তার চেয়েও যেন জঙ্গল বেশি হয়েছে।
সুশীল জানতে চাইলে এ দ্বীপে লোক আছে কিনা। ইয়ার হোসেন বললে–ম্যাপে তো কিছু দেয় না–এ দ্বীপের কিছুই দেখিনে ম্যাপে–কী জামাতুল্লা, তুমি কী দেখেছিলে?
কোথাও কিছু নেই।
বেশ ভালো জান?
আমার যাওয়ার পথে অন্তত তো কিছু দেখিনি—
এখান থেকে তোমার সে নগর কতদূর হবে আন্দাজ?
তিন চার দিনের পথ।
এত কেন হবে? এ দ্বীপের প্রস্থ তো খুব বেশি হবার কথা নয়!
সুশীল বললে–কত বলে আন্দাজ করছেন, মি. হোসেন?
ত্রিশ মাইলের মধ্যে। তবে একটা কথা, এই জঙ্গল ঠেলে যাওয়ায় পথ এগোবে না বেশি। অনেক জায়গায় পথ কেটে নিয়ে তবে এগোতে হবে। তিন দিন লাগা বিচিত্র নয়।
সেদিন তাঁবু খাঁটিয়ে দুপুরে বিশ্রাম করে বিকেলের দিকে দ্বীপের মধ্যে ঢোকবার জন্যে ইয়ার হোসেন সবাইকে তৈরি হতে বললে। মালয় কুলি ওরা এনেছিল সাতজন, জিনিসপত্র বয়ে নিয়ে যাবার জন্যে–এরা সবাই ইয়ার হোসেনের হাতের লোক এবং মুসলমান ধর্মাবলম্বী। ওদের গতিক বড়ো সুবিধের বলে মনে হয়নি সুশীলের ও সনৎ-এর গোড়া থেকেই। দেখে মনে হয় সিঙ্গাপুরে এরা চুরি ডাকাতি ও রাহাজানি করে চালিয়ে এসেছে এতদিন। যেমন দুশমনের মতো চেহারা, তেমনি ধূর্ত দৃষ্টি এদের চোখে। ইয়ার হোসেনের কথায় এরা ওঠে বসে। জামাতুল্লা এদের বিশ্বাস করত না। কিন্তু উপায় কী, ইয়ার হোসেনকে যখন দলে নিতে হয়েছে, তখন এদের রাখতে হবে।
দু-দিন সমুদ্রের ধারে তাঁবু ফেলে থাকবার পরে সকলে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ল।
সুশীল-সনৎ এমন জঙ্গল কখনো দেখেনি। গাছপালা যে এত সবুজ, এত নিবিড়, এত অফুরন্ত হতে পারে–বাংলা দেশের ছেলে হয়েও এরা এ জিনিসটা এই প্রথম দেখলে। ভীষণ জঙ্গলের মধ্যে মাঝে মাঝে এক-একটা ছোটো নদী বা খাঁড়ি–তার দু-পাশে যেন গাছপালা ও বনঝোঁপের সবুজ পর্বত–কত ধরনের অর্কিড, কত ধরনের লতা, কত অদ্ভুত ও বিচিত্র ফুল।