ইয়ার হোসেনকে বলি?
কিন্তু ওই হলদেমুখো চীনাটাকে কিছু বলবেন না, বাবুজি। ওটাকে আমার ঠিক বিশ্বাস হয় না–আপনি বলুন হোসেন সাহেবকে–
যদি ও-ই সেই ডুবো পাহাড়টা হয়, তবে তো ওখান থেকে জমি দেখা যাবে, আর সেই সাদা পাথরের পাহাড়টা—
সে হল তিন রশি চার রশি তফাতে বাবুজি–চাঁদনি রাতে সাদা পাথরের পাহাড় অত দূর থেকে ভালো দেখা যাবে না। সকাল হোক—
চীনা সারেং চিৎকার করে উঠল–হ্যাঁল সামলাবে না গল্প করে সময় কাটাবে–ডুবো পাহাড় সামনে, সে খেয়াল আছে?
জামাতুল্লা বিরক্ত হয়ে বললে–আঃ, হলদেমুখো ভূতটা বড় জ্বালালে দেখছি–দাঁড়ান বাবুজি–আপনি হোসেন সাহেবকে বলুন, আমি দেখি ওদিকে কী বলে–
সুশীল হাসতে হাসতে বললে–তুমি যাই বল, ও কিন্তু খুব পাকা জাহাজি–এসব অঞ্চল দেখছি ওর নখদর্পণে–ওস্তাদ জাহাজি–এ বিষয়ে ভুল নেই—
কিছু পরে চীনা সারেং তার নাবিকগিরির সুদক্ষতার এমন একটি প্রমাণ দিলে যাতে জামাতুল্লাকে পর্যন্ত তারিফ করতে হল। জামাতুল্লার হাল পরিচালনায় জাঙ্ক যখন ডুবো পাহাড়ের একদিক দিয়ে যাবার চেষ্টা করছে তখন চীনা সারেং হুকুম দিলে–সামনে এগোও–পাশ কাটাবার চেষ্টা করছ কেন?
সামনে এগিয়ে ধাক্কা খাবে নাকি?
এই বিদ্যে নিয়ে মাঝিগিরি করতে এসেছ সুলু সি-তে? নিজের দেশে নদী খালে ডোঙা চালাও গে যাও গিয়ে! ওই পাহাড়ের দু-পাশের ভীষণ চাপা স্রোতের মুখে পড়ে জাঙ্ক পাহাড়ের গায়ে সজোরে ধাক্কা মারবে–সে খেয়াল আছে? তোমার হালের সাধ্যি হবে না সে স্রোতের বেগ সামলানো–দেখছ না জল কীরকম ঘুরছে?
জামাতুল্লা তখনও ইতস্তত করছে দেখে চীনা সারেং হেঁকে বললে–জামাতুল্লা এবার সবাইকে মারবে স্যার–ওকে বুঝিয়ে বলুন, একবার ওর হাত থেকে ভগবান বাঁচিয়ে দিয়েছেন–এবার বোধ হয় আর রক্ষে হয় না–
সুশীল আর ইয়ার হোসেন জামাতুল্লাকে বললে–ও যা বলছে তাই করো না জামাতুল্লা–
ও কী বলছে তা আপনারা খেয়াল করছেন না? ও বলছে ওই ডুবো পাহাড়ের দিকে সোজাসুজি হাল চালাতে–মরব তো তাহলে–
চীনা সারেং জামাতুল্লার কথা শুনতে পেয়ে বললে–চালিয়ে দেখোই না কী করি। মরণের অত ভয় করলে মাল্লাগিরি করা চলে না সাহেব–
জামাতুল্লা চোখ পাকিয়ে বললে–হুঁশিয়ার! আমি আর যাই হই–মরণের ভয় করি তা তুমি বলতে পারবে না, হলদেমুখো বাঁদর—
সুশীল ধমক দিয়ে বললে–ও কী হচ্ছে জামাতুল্লা? এ সময়ে ঝগড়া-বিবাদ করে লাভ কী? সারেং যা বলছে তাই করো—
জামাতুল্লা হাতের চাকা ঘোরাতেই জাঙ্ক পাহাড়ের একেবারে বিশ গজের মধ্যে এসে পড়ল –ঠিক একেবারে সামনা-সামনি–সবাই দুরুদুরু বক্ষে চেয়ে আছে, সামনে নিশ্চিত মৃত্যুর ঘাঁটি, এ থেকে কী করে চীনা জাঙ্ক বাঁচবে কেউ বুঝছে না–দেখতে দেখতে বিশ গজের ব্যবধান ঘুচে গেল–দশ গজে
আর বুঝি জাঙ্ক রক্ষা হয় না–মতলব কী চীনাটার?… সবাই বিস্ফারিত চক্ষে চেয়ে আছে বুকের ভিতর চেঁকির পাড় পড়ছে সবারই–হঠাৎ সারেং ক্ষিপ্রহস্তে প্রকান্ড একটা জাহাজি কাছি সুকৌশলে সামনের দিকে অব্যর্থ লক্ষ্যে ছুঁড়ে দিয়ে বললে–ডাইনে হাল মারো–
সঙ্গেসঙ্গে একটা আশ্চর্য কান্ড ঘটে গেল যা ইয়ার হোসেন ও জামাতুল্লা তাদের জাহাজি মাল্লা-জীবনের অভিজ্ঞতায় কখনো দেখেনি। জাহাজ ডান দিকে ঘুরে পাহাড়ের গুঁড়িটা পেরিয়ে যেতেই সারেং-এর কাছি গিয়ে পাহাড়ের সরু অংশটা জড়িয়ে ধরল এবং পেছন দিক দিয়ে ঘড় ঘড় করে নোঙর পড়ার শব্দে সবাই বুঝল বড়ো সি-অ্যাঙ্কর অর্থাৎ সমুদ্রের মধ্যে ফেলার বড়ো নোঙর তার সুদৃঢ় আঁকশির মুখ দিয়ে সমুদ্রের তলায় পাথর ও মাটি আঁকড়ে ধরলেই জাহাজের অগ্রগতি বাধাপ্রাপ্ত হবে।
বোঁ করে অতবড়ো জাঙ্কখানা ডিঙি নৌকোর মতো ঘুরে গেল আর পরক্ষণেই স্থির, অচল হয়ে দাঁড়িয়ে গেল পাহাড় থেকে তিন-চার গজের মধ্যে। জাঙ্ক আর পাহাড়ের মধ্যে কেবল একফালি সরু সাগর–জল, একটা বড়ো হাঙর তার মধ্যে কষ্টে সাঁতার দিতে পারে।
ইয়ার হোসেন বলে উঠল–সাবাস সারেং।
সুশীল ও সনৎ নিশ্বাস ফেলে বললে–খুব বাঁচিয়েছে বটে—
জামাতুল্লা চুপ করে রইল।
চীনা সারেং হলদে দাঁত বার করে হাসতে হাসতে বললে–বিদেশি লোক এখানে জাহাজ চালাতে পারে না, স্যার! জামাতুল্লা মাল্লাগিরি যা জানে, তা খাটে চাটগাঁয়ের বন্দরে–এসব সে জায়গা নয়–এখানে জাহাজ চালাতে হলে পেটে বিদ্যে চাই অনেকখানি–
ইয়ার হোসেন বললে–এখন কী করা যাবে বল। জাহাজ তো আটকে গেল।
সারেং ওদের অভয় দিয়ে বললে–জাঙ্ক আটকায়নি। জোয়ার এলেই সকালে জাঙ্ক ছাড়া নিরাপদ।
সকলে দুরুদুরু বক্ষে সকালের প্রতীক্ষায় রইল। সুশীল আর জামাতুল্লা ভালো করে ঘুমোতেই পারলে না। খুব ভোরে উঠে জামাতুল্লাকে বিছানা থেকে উঠিয়ে সুশীল বললে– এসো, চেয়ে দেখো–চলো বাইরে–
জামাতুল্লা বাইরে এসে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বললে–ওই সেই সাদা পাহাড় আর সেই দ্বীপ! আমি কাল রাত্রেই বুঝেছিলাম বাবুজি, কাউকে বলিনি–
কেন?
কী জানি বাবুজি, চীনা সারেংটাকে আর এই হোসেন সাহেবকে আমার তেমন যেন বিশ্বাস হয় না, খোদার দিব্যি বলছি ওদের সামনে মুখ খোলে না আমার। হোসেন সাহেব আস্ত গুণ্ডালোক, বাধ্য হয়ে ওর সাহায্য নিতে হয়েছে, কিন্তু সিঙ্গাপুরে ওর নাম শুনে সবাই ভয় পায়।