ইয়ার হোসেন বললে–সেখানে থাকি মানে কী বুঝিয়ে বলো। দ্বীপে, না সমুদ্র?
না সাহেব, দ্বীপে তো নয়–আমরা যাচ্ছিলাম এক দ্বীপ থেকে আর এক দ্বীপে। মাঝ দরিয়ায় এ কান্ড ঘটে। তারপর সৌরাবায়া থেকে জাহাজ এসে আমাদের উদ্ধার করে।
কতদিন পরে উদ্ধার করে?
আট-দশ দিন কী ওইরকম।
সুশীল বললে–আগে বলেছিলে সাতদিন।
বাবু, ঠিক মনে নেই। অনেক দিনের কথা। সাত থেকে দশ দিনের মধ্যে। সেই সময় সমুদ্রের বিষাক্ত কাঁকড়া খেয়ে সব কলেরা হয়ে মারা গেল–বাকি ছিলাম কাপ্তান আর আমি। দ্বীপ ছিল নিকটেই–যেখানে ডুবো পাহাড়ে আমাদের জাহাজ ধাক্কা খেয়েছিল, সেখান থেকে ডাঙা নজরে পড়ে। জাহাজের রশির দু-রশি কী তিন রশি তফাতে। দ্বীপ দেখলে আমি চিনতে পারব–তার ধারে একটা পাহাড়, পাহাড়ের গা বেয়ে একটা ঝরনা পড়েছে সমুদ্রে। বড়ো বড়ো পাথর পড়ে আছে, পাথরগুলি সাদা রঙের।
সুশীল হেসে বললে–তোমার সেই বিহ্মমুনির দ্বীপ?
জামাতুল্লা গম্ভীর মুখে বললে–হাসবেন না বাবুজি। এসব কাজে নেমে এ দেশের সব দেবতাকে মানতে হবে। না মানলে বিপদ হতে কতক্ষণ? আমি খুব ভালো করেই তা জানি।
ইয়ার হোসেন বললে–বুঝলাম, ও সব এখন রাখো। সাঙ্গাপান থেকে কোন দিকে যেতে হবে, কত দূরে? একটা আন্দাজ দাও–একটা নটিক্যাল চার্ট করে নেওয়া যাক।
আমরা সাঙ্গাপান থেকেই রওয়ানা হয়ে যাই পূর্ব-দক্ষিণ কোণে–আন্দাজ দু-শো মাইল– সেখান থেকে পূর্বে উত্তর-পূর্ব কোণে যাই আন্দাজ পঞ্চাশ মাইল। এইখানে সেই ডুবো পাহাড়ের জায়গাটা–যতদুর আমার মনে হচ্ছে–
ইয়ার হোসেন অসহিষ্ণুভাবে বললে–যতদূর মনে হলে তো হবে না! আমাদের সে দিকে যেতে হবে যে। সুলু সমুদ্রের সর্বত্র তো ঘুরে বেড়াতে পারা যাবে না। আচ্ছা তুমি সে দ্বীপ কতদূর থেকে চিনতে পারবে? নেমে, না জাহাজে বসে?
জাহাজে বসে চিনতে পারব ওই সাদা পাথরের পাহাড় আর ঝরনা দেখে।
কত সাদা পাথরের পাহাড় থাকে–
না সাহেব, তা নয়। সে পাথরের পাহাড়ের গড়ন অন্য রকম। দেখলেই চিনব।
ইয়ার হোসেন আর সুশীল দু-জনে মিলে মোটামুটি ম্যাপ এঁকে নিয়ে সেদিন রাত্রে আর একবার মিলিয়ে নিলে জামাতুল্লার বর্ণনার সঙ্গে। চীনা জাঙ্ক ভাড়া করা হল। দু-মাসের মতো চাল, আটা, চা, চিনি বোঝাই করে নেওয়া হল জাঙ্কে–আর রইল বিয়ারের কাঠের বাক্সভরতি অস্ত্রশস্ত্র ও মেশিনগান।
ইয়ার হোসেন প্রস্তাব করলে–এখানে বিলম্ব করা উচিত নয়। আজ রাত্রেই যাওয়া যাক–শত্রু লাগতে পারে–
জামাতুল্লা বললে–সেকথা ঠিক। কিন্তু রাত্রে হারবার-মাস্টার জাহাজ কী নৌকো ছাড়তে দেবে না, পোর্ট পুলিশে ধরবে। এসব জায়গায় এই নিয়ম। বোম্বেটে ডাকাতের আড্ডা কিনা সুলু সি! কড়া নিয়ম সব।
তবে?
কাল সকালে চলুন সাহেব—
ইয়ার হোসেন দ্বিধার সঙ্গে এ প্রস্তাবে মত দিলে। সুশীলকে ডেকে বললে–রাতের অন্ধকারে যাওয়া ভালো ছিল। দিনের আলোয় সকলের মনে কৌতূহল জাগিয়ে যাওয়া ভালো না। যাই হোক, উপায় কী?
সকাল আটটার পরে সাঙ্গাপান থেকে ওদের নৌকো ছাড়ল। মাত্র দেড় টনের চীনা জাঙ্ক –সমুদ্রে মোচার খোলার মতো। কিন্তু জামাতুল্লা বললে–জাঙ্ক হঠাৎ ডোবে না, এসব তুফানসংকুল সমুদ্রে পাড়ি দিতে চীনা জাঙ্ক-এর মতো জিনিস নেই।
জাহাজ ছেড়ে অনেক দূর এল, ক্রমে চারিধারে শুধু সমুদ্রের নীল জলরাশি।
জামাতুল্লা নাবিক ও কর্ণধার–কিন্তু যে বৃদ্ধ চীনাম্যান জাঙ্কের সারেং সেও দেখা গেল বেশ জাহাজ চালাতে জানে। দু-দিন জাহাজ চলবার পরে জামাতুল্লার সঙ্গে চীনা সারেং-এর ঝগড়া বেধে গেল।
ইয়ার হোসেন বললে–চেঁচামেচি কেন? কী হয়েছে?
চীনা সারেং বললে–জামাতুল্লা সাহেব জাহাজ চালাতে জানে না–কোথায় নিয়ে যাচ্ছে–
জামাতুল্লা বললে বিশ্বাস করবেন না ওর কথা! ও লোকটা একেবারে বাজে।
ইয়ার হোসেন ও সুশীল পরামর্শ করে জামাতুল্লার ওপরই কিন্তু জাহাজ চালানোর ভার দিলে। একদিন সন্ধ্যার সময়ে দূরে ডাঙা ও আলোর সারি দেখা গেল।
চীনা সারেং ছুটে গিয়ে বললে–ওহে, বড়ো যে জাহাজ চালাচ্ছ–ও ডাঙা আর আলো কোথাকার? এদিকে এত বড়ো ডাঙা কীসের?
জামাতুল্লাও একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল। চার্ট অনুসারে ওখানে আলো আর ডাঙা দেখবার কথা নয়। চীনা সারেং ইয়ার হোসেনকে আর সুশীলকে ডেকে বললে–ওকে বলতে বলুন স্যার, ও আলো আর ডাঙা কীসের?
জামাতুল্লাকে মাথা চুলকোতে দেখে চীনা সারেং বিজয়গর্বে বললে–আমি বলে দিচ্ছি স্যার –সাণ্ডা প্রণালীর মুখে পিয়েরপং বন্দরের আলো–তার মানে বুঝেছেন? আমরা আমাদের যাবার রাস্তা থেকে এক-শো মাইল পূর্ব-দক্ষিণে হঠে এসেছি–এইরকম করে জাহাজ চালালে দক্ষিণমেরুতে পৌঁছোতে আমাদের আর বেশি দেরি থাকবে না স্যার!
চীনা সারেং সেদিন থেকে হল কাপ্তেন।
সুশীল বললে–রাগ কোরো না জামাতুল্লা। তুমি অনেকদিন এ কাজ করোনি, ভুলে গিয়েছ। হে।
জামাতুল্লা বললে–তা নয় বাবুজি। আমি ভুলিনি জাহাজ চালানো। আমার চার্ট ঠিক ছিল, আমার মনে হয় কী গোলমাল হয়েছে বা চার্টে ভুল করে রেখেছে।
আরও তিনদিন পরে বিকেলের দিকে চীনা কাপ্তেন বললে–পারা নামছে স্যার, দড়িদড়া সামলে আর জিনিস সামলে আপনারা খোলের মধ্যে নেমে যান–ঝড় উঠবে।
তিন ঘণ্টার মধ্যে ভীষণ ঝড় এল পূর্ব-দক্ষিণ কোণ থেকে। দড়িদড়া ছিঁড়ে পাল উড়িয়ে নিয়ে যায়–জামাতুল্লা চিৎকার করে বললে–সব খোলের মধ্যে যান–ভয়ংকর ঢেউ উঠেছে—