একটা শিখ রেস্টুরেন্টে ওরা গিয়ে বসল। মাংস, কাটলেট, চা, টোস্ট ইত্যাদি আনিয়ে খাওয়া শুরু করেছে, এমন সময় একজন ইউরোপীয় পোশাক পরা মালয় এসে ওদের টেবিলে বসে বিনীতভাবে বললে–সে কি তাদের সঙ্গে বসে খেতে পারে?
সুশীল বললে–হ্যাঁ, নিশ্চয়।
সে আর কোনো কথা না বলে খাবার আনিয়ে নিঃশব্দে কিছুক্ষণ বসে খেতে লাগল। তারপর আবার ওদের দিকে চেয়ে বললে–আপনারা ভারতীয়?
সুশীল ভদ্রভাবে উত্তর দিলে–হ্যাঁ।
এখানে এসেছেন বেড়াতে, না?
হ্যাঁ।
কেমন লাগছে সিঙ্গাপুর?
বেশ জায়গা।
এখান থেকে দেশে ফিরছেন বোধ হয়?
তাই ইচ্ছে আছে।
আপনারা তিনজনে বুঝি এসেছেন?
না, আমরা এখানে এক হোটেলে থাকি–আলাপ হয়ে গিয়েছে।
বেশ, বেশ।
আপনারা কোন হোটেল উঠেছেন জানতে পারি কি? আমাদের একজন ভারতীয় বন্ধুর একটা ভালো হোটেল আছে, সেখানে খাবার-পত্র সস্তা। ঘরদোরও ভালো। যদি আপনাদের দরকার হয়–
সনৎ হঠাৎ বলে উঠল–না, ধন্যবাদ। আমরা আজই চলে যাচ্ছি।
সুশীল টেবিলের তলা দিয়ে সনৎকে এক রামচিমটি কাটলে। মালয় লোকটার চোখে-মুখে একটা কৌতূহলের ভাব জাগল। সেটা গোপন করে সে বললে–ও! আজই যাবেন?
কিন্তু ভারতের জাহাজ তো আজ ছাড়বে না?
সুশীল বললে–না, আমরা রেলে উঠে যাচ্ছি কুয়ালালামপুর।
ও, কুয়ালালামপুর? দেখে আসুন, বেশ শহর।
আরও কিছুক্ষণ পরে লোকটা বিল চুকিয়ে দিয়ে চলে গেল।
সুশীল রাগের সঙ্গে সনৎ-এর দিকে চেয়ে বললে–ছি ছি এত নির্বোধ তুমি? ও-কথা কেন বলতে গেলে?
সনৎ অপ্রতিভ মুখে বললে–আমি ভাবলাম ওতেই আপদ বিদেয় হয়ে যাবে। অত জিগগেস করার ওর দরকার কী? আমরা যদি-বা যাই, তোর তাতে কীরে বাপু?
তা নয়। কে, কী মতলব নিয়ে কথা বলে, দরকার কী ওদের সঙ্গে সব কথা বলার?
জামাতুল্লা বললে–ঠিক কথা বলেছেন বাবুজি।
সন্ধ্যার কিছু আগে ওরা রেস্টুরেন্ট থেকে বার হয়ে রাস্তায় নেমে দু-একটা জিনিস কেনবার জন্যে বাজারের দিকে চলেছে–এমন সময় জামাতুল্লা নীচু গলায় চুপিচুপি বললে–ওই দেখুন সেই লোকটা!
সুশীল ও সনৎ চেয়ে দেখলে, সেই মালয় লোকটা একটা দোকানে কী একটা জিনিস কিনছে। ওদের দিকে পিছন ফিরে।
সুশীল বললে–চলো আমরা এখান থেকে চলে যাই–মোড়ের দোকানে জিনিস কিনি গে।
জিনিস কিনতে একটু রাত হয়ে গেল। ওরা বড়ো রাস্তা বেয়ে অনেকটা এসে ওদের হোটেল যে গলিটার মধ্যে সে-গলিটাতে ঢুকতে যাবে, এমন সময় কী একটা ভারি জিনিস সুশীলের ঠিক বাঁ-হাতের দেয়ালে জোরে এসে লেগে ঠিকরে পড়ল সামনে রাস্তার ওপরে।
ওরা চমকে উঠল। জামাতুল্লা পথের ওপর থেকে জিনিসটা কুড়িয়ে নিয়ে বললে– সর্বনাশ!
ওরা দু-জনে নীচু হয়ে জিনিসটা দেখতে গেল–কিন্তু জামাতুল্লা বললে–বাবুজি, ছুটে আসুন, এখানে আর দাঁড়াবেন না বলছি!
দু-জনে জামাতুল্লার পিছনে পিছনে দ্রুতপদে চলতে চলতে বললে–কী, কী হয়েছে? কী জিনিস ওটা?
মিনিট পাঁচ-ছয় ছুটবার পর নির্জন গলিটার শেষ প্রান্তে ওদের হোটেলটা দেখা গেল। জামাতুল্লা হাই ছেড়ে বললে–যাক খুব বেঁচে যাওয়া গিয়েছে! এখানা মালয় দেশের ছুঁড়ে মারা ছুরি! ওরা দশ-বিশ গজ তফাত থেকে এই ছুরি ছুঁড়ে লোকের গলা দু-খানা করে কেটে দিতে পারে। আমাদের তাগ করেই ছুরিখানা ছুঁড়েছিল–কিন্তু অন্ধকারে ঠিক লাগেনি। ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলে, যে ছুঁড়েছে তার আর-একখানা ছুরি ছুঁড়তেই বা কতক্ষণ?
সনৎ সেই ভারি ছোরাখানা হাতে করে বললে–ওঃ, এ গলায় লাগলে পাঁঠা কাটার মতো মুন্ডু কেটে ছিটকে পড়ত! কানের পাশ দিয়ে তির গিয়েছে!
সুশীল বললে–এ সেই গুপ্ত সম্প্রদায়ের লোকের কাজ। আমাদের পেছনে লোক লেগেছে।
জামাতুল্লা বললে–লোক লেগেছে, তবে আমাদের বাসাটা এখনও বার করতে পারেনি। আমি বলিনি যে এখানে আমরা বিপন্ন। আমার না বলবার কারণ আছে।
রাতে ডাচ স্টিমার বেন্দা ছাড়ল। ইয়ার হোসেন বড়ো বড়ো কেরোসিন কাঠের প্যাকবাক্স ওঠালে গোটাকতক জাহাজে–তাদের বাইরে বিলিতি বিয়ার মদের বিজ্ঞাপন মারা। ওঠাবার সময় অবশ্যি কোনো হাঙ্গামা হল না–কিন্তু সুশীল ও সনৎ-এর ভয় তাতে একেবারে দূর হয়নি। সিঙ্গাপুরের বন্দর ও প্রকান্ড নৌঘাঁটি ধীরে ধীরে দিকচক্রবালে মিলিয়ে গেল–অকূল জলরাশি আলোকোৎক্ষেপী ঢেউয়ে রহস্যময় হয়ে উঠেছে।
চারদিনের দিন সকালে জাহাজ এসে সাঙ্গাপান পৌঁছোলো। এখানে এসে ওরা নেমে একটা চীনা হোটেলে আশ্রয় নিলে।
সাঙ্গাপান মশলার খুব বড়ো আড়ত, কতগুলি নদী এসে সমুদ্রে পড়ছে, নদীর সেই মোহনাতেই বন্দর অবস্থিত–যেমন আমাদের দেশের চট্টগ্রাম।
ইয়ার হোসেন বাংলা জানে না, উর্দু বা হিন্দুস্থানীও ভুলে গিয়েছে–ও জামাতুল্লার সঙ্গে কথা বলে পিজিন ইংলিশে ও মালয় ভাষায়। বললে–জামাতুল্লা, এবার তুমি তোমার সেই দ্বীপে নিয়ে যেতে পারবে তো?
পারব বলে মনে হচ্ছে। তবে এখনও ঠিক জানি নে–
সুশীল বললে–শুনুন মি. হোসেন। যখন আমার সঙ্গে জামাতুল্লার দেখা হয় গ্রামে, ও বলেছিল ডাচ ইস্ট ইণ্ডিজের একটা দ্বীপে এর জাহাজ নারকেলের ছোবড়া ও কুচি বোঝাই করতে গিয়ে ডুবো পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ভেঙে যায়। কেমন, তাই তো জামাতুল্লা? রাস্তার কথাটা একবার ভালো করে ঝালিয়ে নেওয়া দরকার।
ঠিক বাবুজি—
তারপর বলে যাও—
তারপর আমরা সাতদিন সেইখানে থাকি।