খুব সাবধান জামাতুল্লা, আমাদের প্রাণের দাম এক কানাকড়িও না–যদি একথা কোনোরকমে প্রকাশ হয় যে আমরা ওই আঁক-জোক-পড়া পাথরের ছাঁচ বা সেই নগর খুঁজতে বেরিয়েছি।
ঠিক বাবুজি। সে-কথা আমারও মনে হয়েছে। এই সিঙ্গাপুর ভয়ানক জায়গা–এখানে পথে পথে রাত্রের অন্ধকারে খুন হয়। ভারি সাবধানে থাকতে হবে আমাদের। ইয়ার হোসেনকে সাবধান করে দিতে হবে। মুশকিল হয়েছে লোকটা মাতাল, মদ খেয়ে কোনো কথা প্রকাশ করে না ফেলে। চলে, যাওয়া যাক।
তিনজনে সতর্ক দৃষ্টিতে চারিদিকে চেয়ে দেখতে দেখতে বাসার দিকে রওনা হল।
পরদিন ইয়ার হোসেন এসে ওদের বাসায় খুব সকালেই উপস্থিত হল। সনৎ তখন উঠেছিল। চায়ের জন্যে স্টোভ ধরিয়েছে–ইয়ার হোসেনকে দেখে বললে–আসুন মি. হোসেন, ঠিক সময়েই এসেছেন–চা তৈরি।
ইয়ার হোসেন রুক্ষ প্রকৃতির লোক। বলে উঠল–চা খাবার জন্যে ঠিক আসিনি। আরো দু-শো টাকা চাই।
হঠাৎ সনৎ-এর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল–আরও দু-শো! তাহলে তো আমাদের হাতে রইল না কিছু।
তা আমি কী জানি? এ কাজে এসেছেন যখন তখন পয়সার জন্যে হঠলে চলবে না। নয়তো বলুন ছেড়ে দিই।
না না, দাঁড়ান আমি দাদা ও জামাতুল্লাকে ডাকি।
সুশীল শুনে বললে–তাই তো, ব্যাপার কী? চলো, দেখি ব্যাপার কী।
ইয়ার হোসেন বাইরে বসে আছে। সুশীল গিয়ে বললে–গুড মর্নিং মি. হোসেন। কী মনে করে এত সকালে?
সব ঠিক। আজ রাত্রে রওনা হতে হবে। সব বন্দোবস্ত ঠিক হয়ে গিয়েছে।
সনৎ ও সুশীল একসঙ্গে বলে উঠল–কীরকম?
ইয়ার হোসেন গম্ভীর মুখে বললে–সব ঠিক। তার আগে সেই ছাঁচখানা একবার দেখি– এখুনি। আর দু-শো টাকা–এখুনি।
সুশীলের ইঙ্গিতে সনৎ বাক্স খুলে প্যারিস-প্লাস্টারের ছাঁচ ওর হাতে দিলে। ইয়ার হোসেন ছাঁচখানা উলটে-পালটে দেখে-শুনে বললে–নাও। এসব বুজরুকি অন্য কিছুই না। কিছুই হবে না হয়তো।–টাকা?
সুশীল বললে–টাকা রয়েছে জামাতুল্লার কাছে। সে আসুক।
কোথায় সে?
তা তো জানিনে। সকালে বেড়াতে বেরিয়েছে।
আচ্ছা, আমি বসি।
এখন কী ঠিক করলেন বলুন মি. হোসেন।
এখান থেকে ডাচ স্টিমার বো ছাড়ছে আজ রাত দশটায়। আমাদের নামতে হবে সাঙ্গাপান বন্দরে–সুলু সমুদ্রের ধারে। সাঙ্গাপান মশলার বড়ো আড়ত–সেখান থেকে চীনে জাঙ্ক ভাড়া করে যাব।
এসব অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে ডাচ স্টিমারে উঠতে দেবে? মেশিনগান কিনেছেন নাকি?
সব ঠিক আছে। আপনি শুধু দেখুন ইয়ার হোসেন কী করতে পারে।
আরও এক ঘণ্টা কেটে গেল। জামাতুল্লা আর ফেরে না। সুশীল ও সনৎ উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ল। কাল বিকেলের সেই চীনাম্যানের কথা বার বার মনে পড়ছিল ওদের। কথাটা ইয়ার হোসেনকে বলা ঠিক হবে না হয়তো–ভেবেই ওরা বললে না। কিন্তু জামাতুল্লা সব জেনে শুনে একা বেরোল কোথায়?
বেলা প্রায় দশটা। এমন সময় জামাতুল্লা ঘর্মাক্ত কলেবরে এসে হাজির হল। ওর মুখের চেহারা দেখে তিনজনেই একসঙ্গে বললে–কী হল তোমার?
জামাতুল্লা ক্ষীণ হাসি হেসে বললে–কিছুই না।
কিন্তু তোমার চেহারা দেখে–
এই রোদে—
সুশীল বললে–জামাতুল্লা, মি. হোসেন আরও দু-শো টাকা চান।
ও! তা দিন বাবু। এই নিন চাবি।
উনি বলছেন আজ রাত্রে আমাদের রওনা হতে হবে।
জামাতুল্লা সে-কথায় কোনো উত্তর না দিয়ে বললে–টাকাটা দিয়ে দিন ওঁকে আগে।
টাকা নিয়ে ইয়ার হোসেন বিদায় নেবার পর-মুহূর্তেই জামাতুল্লা নিম্নসুরে বললে-বড়ো বেঁচে গিয়েচি! ডকের পাশে যে গলি আছে ওখানে দু-জন মালয় গুণ্ডা আমাকে আক্রমণ করেছিল। দু-জন দু-দিক থেকে কিরিচ হাতে। ভুড়ি ফাঁসিয়ে দিত আর-একটু হলে। আমি প্রাণপণে ছুটে বেঁচেছি। তোমরা অত ছুটতে পারতে না, মারা পড়তে ওদের হাতে। কালকের সেই চীনেম্যানের কথাই ঠিক। আমরা খুব বিপন্ন এখানে। বাড়ি থেকে কোথাও বেরিও না। ইয়ার হোসেনকে কিছু বোলো না।
সনৎ ও সুশীল রুদ্ধনিশ্বাসে ওর কথা শুনছিল। কথা শেষ হলে সনৎ তাকে চা ও টোস্ট খেতে দিয়ে বললে–কিছু বলিনি আমরা। ও আজই যেতে বলছে–শুনেছ তো?
যাতে হয় আজই আমাদের পালাতে হবে। এখন প্রাণ নিয়ে জাহাজে উঠতে পারলে বাঁচি!
বল কী জামাতুল্লা? এত ভয় নেই। চীনেম্যানটার বাজে গল্পটা দেখছি তোমার মনে বড়ো দাগ কেটে দিয়েছে।
বাবুজি, মেটেবুরুজের মাঠে খুনের কথাটা ভেবে দেখুন। সে পাথরখানার জন্যে নয়– আঁক-জোঁকের জন্যে। এখন আমার তাই মনে হচ্ছে। অসাবধান হবেন না আজ দিনমানটা। জাহাজে উঠলে কতকটা বিপদ কাটে বটে।
সেদিন বিকেলে ইয়ার হোসেনের লোক আবার এল। একটা সিলমোহর করা চিঠি সুশীলের হাতে দিয়ে বললে–এর উত্তর এখুনি চাই। সুশীল চিঠিখানা পড়ে দেখলে, আজ কীভাবে, কোথা থেকে রওনা হতে হবে, সেই ব্যবস্থা চিঠিতে লেখা। ইয়ার হোসেন অন্য পথ দিয়ে যাবে। ওদের যেন চেনে না, এভাবে। জাহাজে না উঠে এদের তিনজনের সঙ্গে সে কথাবার্তা বলবে না।
সুশীল চিঠির উত্তর দিয়ে দিলে। জামাতুল্লা বললে–আমাদের জিনিসপত্র যদি কিনতে হয়, এই সময় কিনে নিয়ে আসি–চলুন।
ওরা বেরিয়ে এল বাসা থেকে। ভিক্টোরিয়া স্ট্রিটের বড়ো বাজারে জিনিসপত্র কিনবে এই ওদের ইচ্ছে। জামাতুল্লা বললে–বাবু, কিছু ভালো জিনিস খেয়ে নেওয়া যাক। জানেন, কোনো অজানা রাস্তায় অনেক দূর যেতে হলে, ভালো খেয়ে নিতে হয়। অনেকদিন হয়তো ভালো খাবার অদৃষ্টে জুটবে না।