সুশীল ও সনৎ একযোগে সবিস্ময়ে বলে উঠল–কীরকম!
এখন বলব না, আপনারা ভয় পেয়ে যাবেন। সিঙ্গাপুর ভয়ানক জায়গা–এখানে দিনদুপুরে মানুষের বুকে ছুরি বসায়–পরে শুনবেন।
সিঙ্গাপুরে যেদিকে বড়ো ডক তৈরি হয়েছে, ওর কাছে অনেক দূর পর্যন্ত সামরিক ঘাঁটি। সাধারণ লোককে সেসব রাস্তা দিয়ে যেতে দেওয়া হয় না। জামাতুল্লাকে পথপ্রদর্শকরূপে নিয়ে দু-জনে সেই দিকে বেড়াতে বেরোলো। সমুদ্রের নীল দিগন্ত-প্রসারী রূপ এখান থেকে যেমন দেখায়, এমন আর কোথাও থেকে নয়। দুপুরের কাছাকাছি সময়টা প্রখর রৌদ্রকিরণে সমুদ্র জল ইস্পাতের ছুরির মতো ঝকঝক করছে। দু-খানা মানোয়ারি জাহাজ বন্দর থেকে দূরে দাঁড়িয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে।
একজন চীনেম্যান এসে ওদের পিজিন ইংলিশে বললে–টি, স্যার, টি?
নো টি।
নো টি স্যার? মাই হাউস হিয়ার স্যার, ভেরি গুড হোম-মেড টি স্যার!
সনৎ বললে–চলো দাদা, চলো জামাতুল্লা, একটু চা খেয়ে আসি।
সবাই মিলে রাস্তা থেকে একটু দূরে একটা চীনা বাঁশঝাড়ের আড়ালে একটা অ্যাসবেস্টস এর ঢেউ-খেলানো পাত দিয়ে ছাওয়া ছোট্ট বাড়িতে এল। বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, বাঁশের টেবিল পাতা আছে বারান্দায়। তিনজনে সেখানে বসে দূরে সমুদ্রের দৃশ্য দেখছে–এমন সময় চীনেম্যানটি চা নিয়ে এল। ওরা চা খাচ্ছে, সে লোকটা আবার কিছু কেক নিয়ে এসে ওদের সামনে রাখলে। ওদের বললে–তোমরা কোথায় যাবে?
সুশীল বললে–বেড়াতে এসেছি।
কোথা থেকে?
কলকাতা থেকে।
ভেরি গুড। চমৎকার জায়গা সিঙ্গাপুর।–এখান থেকে আর কোথাও যাবে নাকি?
না, আর কোথাও যাব না।
ভালো কিউরিও কিনবে?
কী জিনিস?
এসো না ঘরের মধ্যে।
ওরা তিনজনে ঘরের মধ্যে ঢুকল। বুদ্ধের মূর্তি, মালা, ড্রাগনের মূর্তি, পোর্সিলেনের পেটমোটা চীনে ম্যাণ্ডারিনের মূর্তি ইত্যাদি সাধারণ শৌখিন জিনিস আলমারিতে সাজানো– ওরা হাতে করে দেখছে, এমন সময়ে সনৎ একটা জিনিস হাতে নিয়ে অস্ফুট স্বরে চিৎকার করে উঠল–
দাদা দেখো!
সুশীল ও জামাতুল্লা দু-জনেই চেয়ে দেখলে, একখানা জেড পাথরে তৈরি ছুরির গায়ে কী আঁক-জোঁক কাটা। ভালো করে দু-জনেই দেখলে অবিকল সেই আঁক-জোঁক, নটরাজনের পদ্মরাগ মণির গায়ে যে আঁক-জোঁক ছিল।
ওরা সবাই অবাক হয়ে গেল।
সুশীল বললে–এ ছুরিখানার দাম কত?
দু-ডলার, মিস্টার।
এ ছুরি তুমি কোথায় পেলে?
দেখি ছুরিখানা? ও, এ আমি একজন মালয়ের কাছে কিনেছিলাম।
এখানেই?
হ্যাঁ, একজন মাল্লা ছিল সে।
কোথা থেকে সে ছুরিখানা পেয়েছিল তা কিছু বলেনি?
না মিস্টার। তবে ছুরিখানা সে ভয়ে পড়ে বিক্রি করে। সে বলেছিল দু-দু-বার সে প্রাণে মরতে মরতে বেঁচে যায়, এ ছুরিখানার জন্যে। তার পেছনে লোক লেগেছিল। লুকিয়ে আমার কাছে বিক্রি করে। কেউ জানে না যে এখানা আমার কাছে আছে।
আমরা এখানা নেব।
ওখানা বিক্রি হবে না।
আমরা তিন ডলার দেব।
নিয়ে বিপদে পড়বে তোমরা। ও নিও না।
তোমার দোকানের জিনিস বিক্রি করতে আপত্তি কী?
আমি আমার খরিদ্দারকে বিপদে ফেলতে চাইনে। শোনা মিস্টার, আমি জানি ও ছুরি তুমি কেন নিতে চাইছ। ওই আঁক-জোঁকগুলোর জন্যে–ঠিক কিনা? প্রাচীনকাল থেকে এ দেশে অনেকে জানে ওই আঁকগুলো কোথাকার এক গুপ্ত নগর আর তার ধনভান্ডারের হদিশ। সকলে জানে না বটে, তবে পুরোনো লোক কেউ কেউ জানে। অনেক পুরোনো জেড পাথরের আংটিতে ওই আঁক-জোঁক আমি দেখেছি। ও নিয়ে একটা গুপ্ত সম্প্রদায় আছে। সম্প্রদায়ের বাইরে আর কারো কাছে এই আঁক-জোঁকওয়ালা আংটি কী ছুরি কী কিরিচ দেখলে তারা তার পেছনে লেগে গুপ্তহত্যা পর্যন্ত করে ফেলে–তবে তাদের আসল উদ্দেশ্য থাকে, জিনিসটাকে হস্তগত করা।
কেন?
পাছে অন্য কেউ ওই আঁক-জোঁকের হদিশ পেয়ে সেই প্রাচীন নগর আর তার গুপ্ত ধনভান্ডার আবিষ্কার করে ফেলে। ওরা নিজেরা যখন বের করতে পারলে না–তখন আর কাউকে ওরা খোঁজ করতেও দেবে না। ও চিহ্নের জিনিস কাছে রাখা মানে প্রাণ হাতে করে বেড়ানো। কিন্তু আমার মনে হয় কী জান, মিস্টার? ওরকম নগর কোথাও নেই। ও একটা মিথ্যা প্রবাদের মতো এ অঞ্চলে প্রচলিত আছে। কেউ দেখেছে এ পর্যন্ত বলতে পার? কেউ বলতে পারে সে দেখেছে? কেউ সন্ধান দিতে পারে? ও একটা ভুয়ো গল্প।
চা খেয়ে বাইরে এসে তিনজনে সমুদ্রের দিকে চলল।
চীনেম্যানটি পিছন থেকে ডেকে বলল–ওদিকে যেও না মিস্টার, সামরিক সীমানা– যাওয়া নিষেধ। সমুদ্রের ধারে এদিকে বসবার জায়গা নেই।
একটু নির্জন স্থানে গিয়ে সুশীল বললে–জামাতুল্লা, শুনলে সব কথা? এখনও কি তোমার মনে হয় সে নগর আছে কোথাও? আমরা আলেয়ার পেছনে ছুটছি নে? নটরাজনের গল্প ভুয়ো নয়?
জামাতুল্লা বললে–তবে পদ্মরাগ মণি এল কোথা থেকে?
আমি তোমায় বলছি নটরাজনের কাহিনি আগাগোড়া বানানো গল্প। পদ্মরাগ মণিখানা সে কোনোপ্রকার অসৎ উপায়ে হস্তগত করে–যার ওপরে প্রাচীন ও প্রচলিত প্রথানুযায়ী ওই চিহ্নটি-আঁকা ছিল। এ ছাড়া ওর কোনো মানে নেই।
জামাতুল্লার মুখ-চোখের ভাব হঠাৎ যেন বদলে গেল–কত বৎসর পূর্বের এক স্বপ্নভরা দিন, এক আতঙ্কভরা কৃষ্ণা রজনীর স্মৃতি তার মুখের রেখায়, চোখের দৃষ্টিতে। সে বললে– কিন্তু বাবুজি, নটরাজন হয়তো দেখেনি, আমি তা দেখেছি। ভীষণ বনের মধ্যে অন্ধকার রাত কাটিয়েছি। আমি কারো কথা শুনিনে।