ইয়ার হোসেন ঘরে ঢুকে বললে–বসে আছেন? আমায় আর দু-শো টাকা দিতে হবে– দরকার রয়েছে।
সুশীল জামাতুল্লার মুখের দিকে চাইলে অতি অল্পক্ষণের জন্যে। জামাতুল্লা চোখের ইঙ্গিতে তাকে বলে দিলে ইয়ার হোসেনকে যেন সে প্রত্যাখ্যান না করে।
কত টাকা বললেন মি. হোসেন?
দু-শো কী আড়াইশো—
বেশ, নেবেন। সেদিন নিয়েছেন এক-শো—
ইয়ার হোসেন যেন খানিকটা উদ্ধত সুরে বললে–নিয়েছি তো কী হবে? তোড়জোড় করতেই সব টাকা যাচ্ছে–
জাহাজের কী হল? চার্টার করবেন?
জাহাজ চার্টার করবার টাকা কোথায়? কিন্তু আচ্ছা, একটা কথা বলি। আপনারা সে বিহ্মমুনির দেশে যেতে চাইছেন কেন? টাকা-কড়ি হীরে-জহরত সেখানে সত্যি আছে?
কী করে বলি সাহেব! তবে, তোমার কাছে লুকোব না। খুব বড়ো রত্নভান্ডার সেখানে লুকোনো আছে এই আমাদের বিশ্বাস। ওই মণির ওপর আঁক-জোঁক আছে–ওটাই তার হদিশ–অন্তত নটরাজন তাই বলেছিল।
আমি চেষ্টা করে দেখব–কিন্তু আমার ভাগ ঠিক তিন ভাগের এক ভাগ চাই। ফাঁকি দেবার চেষ্টা করলেই বিপদ ঘটবে। এই হাতে অনেক মানুষ খুন করেছি, সে-কথা কে না জানে? মানুষ মারাও যা, আমার কাছে পাখি মারাও তা।
সুশীলের গা যেন শিউরে উঠল। কাজের খাতিরে এমন নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোকের সঙ্গে আজ তাকে মিশতে হচ্ছে–ভাগ্য কী জানি কোন পথ তাকে নির্দেশ করছে! মুখে বললে–না সাহেব, তুমি নিশ্চিন্ত থাকো–ফাঁকে তুমি পড়বে না।
ইয়ার হোসেন বললে–একটা গল্প বলি শোনো তবে। একবার আমার জাহাজে ছ সাতজন মাল্লা মদ খেয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে। তাদের দলে একজন সর্দার ছিল, সে এসে আমায় জানালে, এই এই শর্তে আমি রাজি না হলে তারা আমার হাত-পা বাঁধবে–মেরে ফেলতেও পারে। আমি ওদের সান্ত্বনা দিয়ে শর্তে সই করে দিলাম। তারপর ইঞ্জিন রুমের বড়ো কর্মচারীকে ডেকে বললাম–জাহাজে কয়লা দিয়েই স্টিম বন্ধ করে ফার্নেসের মুখ খুলে রাখবে।
ইঞ্জিনিয়ার বিস্মিতভাবে আমার মুখের দিকে চেয়ে বললে–কেন কাপ্তেন সাহেব–এ তো বড়ো বিপজ্জনক ব্যাপার–সেই ভীষণ উত্তাপে ফার্নেসের মুখ খুলে রাখব?
সে বেচারি আমার মতলব কিছু বুঝলে না। আমি সেই বিদ্রোহী সর্দারকে আর তার চারজন অনুচরকে বললাম ফার্নেসে কয়লা দিতে। এদিকে ইঞ্জিন-রুমে টেলিগ্রাফে ইঞ্জিনিয়ারকে পুরোদমে স্টিম দিতে বলেই ওরা ঘরে ঢুকবার সঙ্গেসঙ্গে পুলি ঘুরিয়ে জাহাজ প্রায় পঁচিশ ডিগ্রি কোণ করে স্টারবোর্ডের দিকে কাত করে ফেললাম। টাল সামলাতে না পেরে ওরা হঠাৎ গিয়ে পড়ল খোলা ফার্নেসের মুখে। লোক ঠিক করা ছিল, তক্ষুনি তারা ওদের ফার্নেসের আগুনে ধাক্কা মেরে ঠেলে দিয়ে ফার্নেসের দরজা ঘটাং করে বন্ধ করে দিলে।
সনৎ ও সুশীল রুদ্ধনিশ্বাসে বললে–তারপর?
তারপর? তারপর দু-দিন পরে কতকগুলি আধপোড়া হাড় পোড়া কয়লার ছাইয়ের সঙ্গে ফার্নেস-সাফ-করা কুলি সমুদ্রের জলে ফেলে দিলে। মিউটিনি শেষ হয়ে গেল।
কেউ টের পেলে না?
সবগুলো বদমাইশ যখন ও পথে গেল–তখন বাকিগুলি আপনা আপনিই চুপ করে গেল। ভালোমানুষির দিন চলে গিয়েছে জানবেন। নিষ্ঠুর হতে হবে, নির্মম হতে হবে–তবে মানুষের অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে পারবেন।
সুশীল বুঝল না এমন নিরীহ ভালোমানুষটির আড়ালে কী করে এমন দৃঢ় ও নির্মম চরিত্র লুকোনো থাকতে পারে।
আর একটা কথা–অস্ত্রশস্ত্র কেমন আছে আপনাদের?
কিছু না, একটি করে অটোম্যাটিক আছে দু-জনের–তার কার্টিজ নেই।
রাইফেল নেই?
ভারত থেকে রাইফেল কেনা? মি. হোসেন, এবার আপনি হাসালেন।
ইয়ার হোসেন দ্বিরুক্তি না করে বেরিয়ে চলে গেল এবং কিছুক্ষণ পরে একটা বড়ো রিভলবার নিয়ে এসে সুশীলের হাতে দিয়ে বললে–পছন্দ হয়?
ওঃ, এ তো চমৎকার জিনিস।
এই কিনব তিনটি তিনজনের, আর একটা পুরোনো মেশিনগান—
মেশিনগান কী হবে!
অনেক দরকার আছে।
সুশীল ও সনৎ দু-জনেই দেখলে সে অনেকরকম জানে-শোনে। জাহাজ চালানোর যন্ত্রাদি কিনবার সময়–তার যে কিছু কিছু বিজ্ঞানের জ্ঞানও আছে–এ পরিচয়ও পাওয়া গেল। চালচলনে, ধরনধারণে–সে সর্বদাই মনে করিয়ে দেয় যে সে সাধারণ নয়।
সুশীল জামাতুল্লাকে বললে–তুমি বলেছিলে দু-শো টাকা হলেই হবে–তো এখন দেখছি পাঁচশো টাকাই মি. হোসেন নিয়ে নিলে নানা ছুতো করে; হাতে কিন্তু এক পয়সাও রইল না–
কোনো ভয় নেই বাবুজি, আমি যখন আছি। ও তেমন লোক নয়।
লোক নয় কীরকম? ভয়ানক লোক, আমরা বুঝেছি। ও দরকার মনে করলে তোমার মতো পুরোনো বন্ধুর গলা কাটতে এতটুকু দ্বিধা করবে না।
বাবুজি দেখছি ভয় পেয়ে গিয়েছেন।
তা একটু পেতে হয়েছে। টাকাটা ও মেরে দেবে না তো? তুমি হুশিয়ার হয়ে থাকবে ওর পেছনে।
বাবুজি আমি হাজার পেছনে থেকেও কিছু করতে পারব না–ও যদি ইচ্ছে করে তবে সিঙ্গাপুর থেকে আজই পালিয়ে যেতে পারে–কেউ পাত্তাই পাবে না। ইয়ার হোসেন ছাঁচটার কথা জিজ্ঞেস করছিল–
তুমি কী বললে?
বললাম, বাবুর কাছে আছে।
মতলব কী?
না বাবু খারাপ কিছু নয়–ও একবার দেখতে চায়।
ওঃ, ভাগ্যিস আসল পদ্মরাগখানা ব্যাংকে জমা দিয়ে এসেছিলাম কলকাতায়! নইলে সেই পাথর নিয়ে কলকাতাতেই খুন হয়ে গেল মেটেবুরুজে! এখানে আনলে সে-পাথর আমরা হাতে রাখতে পারতাম না!
জামাতুল্লা গলার স্বর নীচু করে বললে–বাবুজি, এখানেও লোক পেছন নিয়েছে।