এই জন্যেই তো বলি, রইস আদমির বুদ্ধি আর আমাদের বুদ্ধি! আপনি যা বলবেন বাবুজি।
অনেক রাত হয়েছিল। জামাতুল্লার বিশ্রামের বন্দোবস্ত করে দিয়ে সুশীল নিজে শোবার জন্যে চলে গেল বটে–কিন্তু তার সারারাত ঘুম এল না চোখে। এবার কী ক্ষণে সে বাড়ি থেকে বার হয়েছিল! সাগরপারের যাত্রী হয়ে যদি সেই অজানা দ্বীপে অরণ্যের মধ্যে প্রাচীন যুগের হিন্দু-কীর্তি শুধু চোখের দেখা দেখে আসতে পারে–তবেই সে জীবন সার্থক বিবেচনা করবে। চম্পারাজ্যের মতো সেখানেও আর এক হিন্দু উপনিবেশ ছিল নিশ্চয়ই মহাকালের চক্রনেমির আবর্তনে অরণ্য গ্রাস করেছে সে নগরী–তবুও ভারতের সন্তান সে প্রাচীন যুগের সেই পুণ্যভূমির পবিত্র ধূলি স্পর্শ করে সে ধন্য হতে চায়।
অর্থের জন্যে সে যাচ্ছে না।
পরদিন সকালে উঠে সুশীল জামাতুল্লাকে চা ও খাবার খেতে দিয়ে তার সঙ্গে গল্প করতে বসেছে–এমন সময় কাগজওয়ালা খবরের কাগজ দিয়ে গেল; সুশীল কাগজ খুলে সংবাদগুলোর ওপর সাধারণভাবে চোখ বুলোতে গিয়ে হঠাৎ উত্তেজিত সুরে বলে উঠল– জামাতুল্লা, আরে, তোমাদের মেটেবুরুজে খুন! …
জামাতুল্লা চা খেতে খেতে চমকে উঠে বললে–কোথায় বাবু, কোথায়?
দু-নম্বর মফিজুল সর্দারের লেন, একটা কুঠুরিতে নূর মহম্মদ নামে একটা লোককে গলা কাটা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে–
সুশীল কাগজ থেকে মুখ তুলে দেখলে জামাতুল্লা তালপাতার মতো কাঁপছে–অতি কষ্টে সে সুশীলকে জিজ্ঞেস করলে–কী নাম লোকটির বাবুজি?
নূর মহম্মদ–
জামাতুল্লা চা ফেলে উঠে এসে সুশীলের হাত ধরে বললে–আপনি আমার সবচেয়ে বড়ো দোস্ত–কাল এখানে রেখে আপনি আমার জান বাঁচিয়েছেন! নূর মোহম্মদ আমার ঘরেই থাকে। এক বিছানাতে দু-জনে শুই–কাল আমি থাকলে আমাকেই মারত, আমি ভেবে ভুল করে ও বেচারিকে খুন করে গিয়েছে–
সুশীল বলে–তুমি এখুনি বাড়ি যাও–সেই জিনিসটা–
বাবু, সে আমি অন্য জায়গায় রেখেছি–সেখান থেকে কেউ সেটা বের করতে পারবে না।
সুশীল স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললে–তবুও একবার যাও—
সেটা নিয়ে বাবুজি আপনাদের বাড়িতে রেখে দিন আপনি–মেহেরবানি করে যদি রেখে দেন!
নিশ্চয়ই রাখব। তুমি একা যেও না–চলো আমিও সঙ্গে যাচ্ছি। আমার ভাই সনৎকে সঙ্গে নেব।
পাথরখানা এনেই সুশীল কয়েকদিনের মধ্যে তার আর-একখানা ছাঁচ করিয়ে নিয়ে সেখানা ব্যাংকে জমা দিয়ে এল। ওসব জিনিস সঙ্গে রাখলেই যত গোলমাল।
কিন্তু ব্যাংকে রাখবার কয়েকদিন পরেও ঘটে গেল এক বিপদ।
সুশীল তখন হাজার দুই টাকার ব্যবস্থা একরকম করে ফেলেছে। তার কাকাই টাকাটা তাকে দেবেন–তবে সে বলেছে ব্যাবসার জন্যেই ওটা দরকার–বিদেশে যাওয়ার কথা শুনলে কেউ উৎসাহ দিত না। ওর সঙ্গে পৃথিবীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত যেতে রাজি, সনৎ একথা জানিয়েছে।
সুশীল বৌবাজার দিয়ে গিয়ে জামাতুল্লাকে ট্রামে দিয়ে এল। ট্রাম পরবর্তী থামবার জায়গায় যাবার পূর্বেই ট্রামে এক শোরগোল উঠল।
জামাতুল্লা ট্রামের বেঞ্চিতে বসবার সঙ্গে সঙ্গেই পাশের একজন লোক নেমে গেল– নেমে যাবার সময় একবার যেন তার হাতখানা জামাতুল্লার পিঠের দিকে ঠেকল..অন্তত জামাতুল্লার তাই মনে হল। পরক্ষণেই জামাতুল্লা রক্তাক্ত দেহে চিৎপাত ট্রামের মেঝেতে!
লোকজন হইহই–পুলিশ! পুলিশ! সবাই মিলে ওকে ধরাধরি করে নামিয়ে ফেললে।
শেষে দেখা গেল ওর বিশেষ কিছু লাগেনি এবারও। একখানা ধারালো ছুরি দিয়ে বোধ হয় আততায়ী কোমরের থলে কাটতে চেষ্টা করেছিল। ছুরিখানা দৈবাৎ তলপেটের পাশের দিকে লেগে খানিকটা অগভীর রেখা সৃষ্টি করে লম্বালম্বিভাবে কেটে গিয়েছে।
এই ঘটনার ঠিক সাতদিন পরে সুশীল, সনৎ ও জামাতুল্লা তিনজনে একখানা রেঙ্গুনগামী জাহাজে চড়ে বসল–আপাতত সিঙ্গাপুর এবং সেখান থেকে ব্যাটেভিয়া যাবে এই হল উদ্দেশ্য ওঁদের।
মাস দুই পরের কথা। সকাল বেলা।
সুশীল সিঙ্গাপুরের ভারতীয় পাড়ায় একটি ছোটো শিখ হোটেলের একটা ঘরে বসে সনৎকে বলছিল–আমরা এখানে এসে ভালো করলাম কী মন্দ করলাম এখনও বুঝিনি সনৎ। জামাতুল্লার বোম্বেটে বন্ধু তো দেখা যাচ্ছে অত্যন্ত ধূর্ত প্রকৃতির লোক–ও হাসতে হাসতে মানুষ খুন করতে পারে। ওকে কি খুব বিশ্বাস করা উচিত হল?
বিশ্বাস না করেই বা উপায় কী দাদা? ও ছাড়া সুলু সমুদ্রে জাহাজ চালাবে কে? তবে আমার মনে হয় যখন আমাদের কাছে এমন কোনো মূল্যবান জিনিস নেই–তখন সে অনর্থক মানুষ খুনের দায়িত্ব ঘাড়ে নিতে যাবে কেন?
এমন সময় বাইরে পায়ের শব্দ শোনা গেল। জামাতুল্লা তার বোম্বেটে বন্ধু মি. ইয়ার হোসেনকে নিয়ে ঘরে ঢুকল। ইয়ার হোসেন ভিক্টোরিয়া স্ট্রিটে একটা চুল-ছাঁটা দোকান করে ভাড়াটে চীনে নাপিত দিয়ে চুল ছাঁটায়-রোজগার মন্দ হয় না। বিয়াল্লিশ-তেতাল্লিশ বছর বয়স হবে, রোগা চেহারা–চোখের দৃষ্টিতে অত্যন্ত ভালোমানুষ ও নিরীহ ধরনের বলে মনে হয়–পরনে সাহেবি পোশাক। লোকটা ভারতীয় নয়, মালয়ও নয়–কোন দেশের লোক তা কখনো বলেনি। তবে তার কথাবার্তা থেকে মনে হয় ভারতের ওপর টানটা তার বেশি। কথাবার্তা বলে ইংরেজিতে, নয়তো মালয় ভাষায়। তার ভাঙা ইংরেজি জামাতুল্লা বেশ বোঝে।
এ ধরনের লোকের সঙ্গে কখনো সুশীল বা সনৎ-এর পরিচয় ঘটেনি ইতিপূর্বে। বাইরে মোটামুটি ভদ্রলোক, এমনকী বেশ নিরীহ প্রকৃতির প্রৌঢ় ভদ্রলোক–কিন্তু ভেতরে ভেতরে ইয়ার হোসেন দুর্দান্ত দস্যু। মুহূর্তের মনোমালিন্যের ফলে যারা বন্ধুর বুকে অতর্কিতে তীক্ষ্ণধার কিরিচ বসিয়ে দিতে এতটুকু দ্বিধা করে না–এ সেই-জাতীয় লোক।