সুশীল ব্যস্ত হয়ে বললে–পাথরখানা আছে তো?
শুনুন বাবু, তারপর। আমি এমন কান্ড কখনো দেখিনি। চিৎপাত হয়ে পড়ে আর জ্ঞান নেই। যখন জ্ঞান হল তখন দেখি আমার চারিপাশে দু-তিন জন লোক দাঁড়িয়ে, তারা কেউ পানি এনে আমার চোখে-মুখে দিচ্ছে, কেউ গামছা নেড়ে বাতাস করছে। আমার দোস্ত-এর নাম বলতে তারা আমায় ছোটোমোল্লাখালি নিয়ে গেল তার বাড়িতে। সেখানে গিয়ে যখন আমার হুঁশ বেশ ভালো ফিরে এল, আমি পকেটে হাত দিয়ে দেখি পাথরখানা নেই।
বল কী? নেই! গেল সেখানা!
শুনুন বাবু আজগুবি কান্ড! পাথর নেই দেখে তো আমি আবার অজ্ঞান হয়ে গেলাম। দোস্তের বাড়ি তো শোরগোল পড়ে গেল। কত লোক দেখতে এল–আমার দোস্ত কতবার মুখে-চোখে পানি দিয়ে ডাক্তার ডেকে আমায় চাঙ্গা করলে। আমি সেই রাত্রেই বাড়ি চলে গেলাম–
তারপর?
বাবু আপনি বলুন একটা কথা। আমি কাল আপনার দোস্তের কাছে দেখাতে গিয়েছিলাম কী নিয়ে? যে ছাঁচ তৈরি হয়েছিল তাই নিয়ে–না আসল পাথরখানা নিয়ে? আপনার ওই যে দোস্ত খুব এলেমদার লোক, তার কাছে?
ও, ডা. বসুর কাছে তুমি তো আসল পাথরখানা নিয়ে গেছলে। ছাঁচখানা নিয়ে যাইনি ঠিক তো? কিন্তু বাবু বাড়ি ফিরে দেখি আসল পাথরখানা পকেটে রয়েছে, ছাঁচখানা নেই।
সুশীল হো-হো করে হেসে বললে–এ কোনো আজগুবি কান্ড হল না জামাতুল্লা। তুমি দু-খানাই নিয়ে গেছলে। যে তোমার গলা টিপেছিল সে ছাঁচখানাকে ভুল করে নিয়ে গেছে– আসলখানা তোমার পকেটেই রয়ে গিয়েছিল। কোন পকেটে কোনটা রেখেছিলে মনে আছে?
বাবু আমি ছাঁচটা নিয়েই যাইনি–
আমি বলছি শোনো। তুমি ভুলে দুটোই নিয়ে গেছলে। কিন্তু এ থেকে আমাদের সাবধান হতে হবে। কেউ আমাদের পাথরের খবর পেয়েছে–কলকাতা গুণ্ডা বদমাইশের জায়গা আমরা ক-দিন ধরে এখানে পাথরের কথা বলেছি, তত সাবধান হইনি। এখানেও শুনতে পারে, সেদিন ডা. বসুর ওখানে দুটো আরদালি দাঁড়িয়ে ছিল–আমার সন্দেহ হয় তাদের মধ্যে কেউ শুনতে পারে। যাক, ভালোই হয়েছে যে আসলখানা চুরি যায়নি! আজ তোমার সঙ্গে নেই তো সেখানা?
না বাবু। আমি কি আর তেমনি উজবুক?
লোক লেগেছে আমাদের পেছনে। খুব সাবধানে চলাফেরা করবে।
জামাতুল্লা হেসে বললে–বাবু, লোক লেগে আমায় হঠাৎ কিছু করতে পারবে না। সারাঙ্গুনিয়া ঘুরে বেড়িয়েছি–কত বদমাইশ লোকের সঙ্গে কতবার কারবার করেছি। এই হাতদুটো যে দেখছেন–এ দুটো ঠিক থাকলে এর সামনে কেউ এগোতে পারবে না জানবেন খোদার দোওয়ায়।
সুশীল একবার চারদিকে চেয়ে দেখলে–কোনোদিকে কোনো লোক নেই। সঙ্গীকে চুপিচুপি বললে–এসব কথা এখন নয়। তুমি আমার সঙ্গে যেতে পারবে?
কোথায় বাবুজি?
আমার বাসায়। সেখানে ঘরের মধ্যে বসে সব কথা হবে এখন।
জামাতুল্লাকে সঙ্গে নিয়ে সুশীল তাদের বাসায় এল। আসার পথে কোনো কিছু অঘটন ঘটেনি দেখে সুশীলের মন থেকে ভয় ও বিপদাশঙ্কা অনেকখানিই চলে গেল। জামাতুল্লাকে কিছু খেতে দিয়ে ও তার জন্যে বাইরের ঘরের কোণে বিছানা করে দিলে।
জামাতুল্লা বললে–বাবুজি, বিছানা কেন?
রাত্রে এখানে তোমায় রাখব। যেতে দেব না মেটেবুরুজে। সাবধানের মার নেই। খিদিরপুরের মাঠ থেকে মেটেবুরুজ পর্যন্ত জায়গা বড্ড নির্জন–গুণ্ডা বদমাইশদের আড্ডা। রাত্রে সে-পথে গেলে বিপদ আছে। তোমার যত সাহসই থাকুক–রাত্রে যাওয়া হবে না।
সুশীলের এ সতর্কতার জন্যে জামাতুল্লাকে চিরদিন কৃতজ্ঞ থাকতে হয়েছিল।
রাত্রে আহারাদির পরে সুশীল জামাতুল্লাকে বললে–আমার মতলব তোমাকে বলব বলেই তোমায় ডেকেছি। আমার মনে হয়েছে আমরা যে করেই হোক–চলো সেই বনের মধ্যে প্রাচীন নগরের সন্ধানে বেরোই। টাকাকড়ির সন্ধান আমি করছি নে–পাই ভালো, তা আমি একা নেব না–নটরাজনের স্ত্রীর শেষ দিনগুলো যাতে সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে কাটে তার ব্যবস্থা করব তা দিয়ে। তারপরে তুমি আছ, আমি আছি। ভগবানের আশীর্বাদে আমার ঘরে খাবার ভাবনা নেই।
জামাতুল্লা খালাসি ঘাড় নেড়ে বললে–সে আমি আগেই জানি বাবু–আপনি রইস আদমি –মানুষ দেখেই চিনতে পারি। নইলে আপনাকে এত বিশ্বাস করতাম না। বড়ো ঘরানা আপনারা, আপনাদের নজর হবে বড়ো।
তা ছাড়া কী জান জামাতুল্লা? এই বয়স হচ্ছে বিদেশ বেড়ানোর সময়। চিরকাল বাড়ি বসে থাকব যদি, তবে দুনিয়া দেখব কবে? … তোমার সাহস আছে আমায় সেখানে নিয়ে যাবার তো?
এ বাবুজি সাহসের কথা নয়। জাহাজ চালানো বিদ্যের কথা–কৌশলের কথা। সিঙ্গাপুরে আমার এক দোস্ত আছে তাকে খুঁজে বার করতে হবে। সে সুলু সি-তে জাহাজ চালিয়েছে অনেক দিন–আপনার কাছে ছিপাব না, বোম্বেটের কাজ করত সে। এখন বড্ড কড়া শাসন, ওলন্দাজ সরকার আর আমাদের ইংরেজ সরকারের। মানোয়ারি জাহাজ সর্বদা ঘুরছে। বোম্বেটে জাহাজ ধরতে পারলেই ধরে নিয়ে আসবে–আর গুলি করবে। সেজন্যে সে কাজ ছেড়ে দিয়ে দোকান করে বসে আছে সিঙ্গাপুরে। তাকে সঙ্গে নিতে হবে।
তাহলে কীরকম ব্যবস্থা করবে যাবার?
আপনি টাকা কত নিতে পারবেন বলুন।
শ-পাঁচেক। তার বেশি এক পয়সা নয়।
তাও নেবেন না। আপনি আমার দোস্ত–দু-শো নিয়ে চলুন। আমি পাথর বিক্রি করে ফেলি–সেই টাকায় চালাব।
সে টাকা তোমায় আমি নিতে দেব না জামাতুল্লা। নটরাজনের স্ত্রীকে বঞ্চিত করে সে-পাথর নিয়ে আমাদের ফল ভালো হবে না। নটরাজন স্বর্গ থেকে দেখবে আর অভিশাপ দেবে।