ডা. বসু বললে–দেখুন, সিলমোহরের ওপর এ চিহ্ন আমি নিজে কখনো দেখিনি–তবে এই ধরনের পাথরের ওপর সিলমোহর ওঁকারভাটে পাওয়া গিয়েছে। ফরাসি ইন্দোচীনের জঙ্গলের মধ্যে বহু পুরোনো নগরের ধ্বংসস্তূপে। এর সময় নির্দিষ্ট হয়েছে মোটামুটি খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দী। আমাদের মিউজিয়ামেও আছে–কাল যাবেন, দেখাব। কিন্তু আপনার এটা আরও পুরোনো, আমি একে নির্ভয়ে নবম শতাব্দীতে ফেলে দিতে পারি–কিংবা তারও আগে।
সুশীল বললে–আপনার তাই মনে হয়?
নিশ্চয়ই। নইলে বলতাম না। আর সেই জন্যেই আপনাকে জিজ্ঞেস করছি আপনাদের পূর্বপুরুষে এটা পেলেন কী করে? এ হল সমুদ্রপারের জিনিস। বাংলা দেশের পাড়াগাঁয়ের আম গাছের ছায়ায় শান্ত ও নিরীহ জিনিস নিয়ে কারবার–কিন্তু এ সিলমোহরের পেছনে রয়েছে অজানা সমুদ্রে পাড়ি দেওয়ার দুর্দান্ত সাহস, দুর্জয় বিক্রম, যুদ্ধ, রক্তপাত–ভারতবাসী যেদিন সমুদ্রের ওপারে বিদেশে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল, সেইসব দিনের ইতিহাস এ সিলমোহরের সঙ্গে জড়ানো। তাই বলছি, এটা আপনারা পেলেন কী করে?
.
ওখান থেকে বেরিয়ে আসবার সময়ে সুশীলের মনে টাকার স্বপ্ন ছিল না।
ছিল যে সুদূরের, দুঃসাহসিক অভিযানের স্বপ্ন–জামাতুল্লা খালাসির অত বড়ো পদ্মরাগ মণিখানার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক ছিল না।
সে এমন এক দিনের স্বপ্ন–যা প্রত্যেক ভারতবাসীর আত্মসম্মানকে জাগ্রত করে, তরুণদের প্রাণে নতুন আশা, উৎসাহ ও আনন্দের সংবাদ আনে বয়ে–
তবু তা সুশীলের মনে যে ছবি জাগালে তা আদৌ স্পষ্ট নয়–সবই আবছায়া, সবই ধোঁয়া ধোঁয়া। সুশীল ইতিহাসের ছাত্র নয়। ডা. বসুর শেষ কথা ক-টির সঙ্গে যেন এক অদ্ভুত বৈজ্ঞানিক শক্তি মেশানো ছিল–তার চোখের সামনে প্রাচীনকালের সুদীর্ঘ অলিন্দ বেয়ে তলোয়ার হাতে বর্মে চর্মে সুসজ্জিত বীরের দল সারি সারি চলেছে, মৃত্যুকে তারা ভয় করে না–অজানা সমুদ্রপথে তাদের বিজয় অভিযান নব উপনিবেশের ইতিহাস সৃষ্টি করে ভাবীকালের অসহায় ও অকর্মণ্য সন্তানদের শিরায় শিরায় নতুন রক্তের আলোড়ন এনে দেয়।
কোথায় সে পড়ে আছে পাড়াগাঁয়ে, পুরোনো জমিদার-ঘরের বিলাসপুষ্ট আয়েসি ছেলেটি সেজে–তাদেরই পূর্বপুরুষ একদিন যে অসি হাতে সপ্ত সমুদ্রে পাড়ি জমিয়েছিল–তাদেরই স্বজাতি, স্বদেশবাসী–আর সে থাকবে দিব্যি আরামে তাকিয়া ঠেস দিয়ে শুয়ে, তেলে জলে, দাদখানি চালের ভাত আর মাছের ঝোলে কোনোরকমে পৈতৃক বাঙালি প্রাণটুকু বজায় রেখে চলবে টায় টায়।
চিরকাল হয়তো এমনি কেটে যাবে তার।
প্রজা ঠেঙিয়ে খাজনা আদায় করে, পুরোনো চন্ডীমন্ডপে বসে তামাক টেনে আর পালপার্বণে গ্রাম্য লোকজনের পাতে দই মোণ্ডা দিয়ে হাততালি অর্জন করবার প্রাণপণ চেষ্টায় মশগুল হয়ে।
তারপর আছে মামলা, মোকদ্দমার তদারক করতে কোর্টে ছুটোছুটি–ডিক্রি, নালিশ, কিস্তিবন্দি, সইমোহরের নকল, সমন জারি–উঃ! ভাবলে তার গা কেমন করে। প্রাচীন ধনী বংশের লাল খেরো-বাঁধানো রোকড় ও খতিয়ানের চাপে সে নিজের যৌবন ও জীবনকে একদম পিষে মেরে ফেলে শেষের দিকে যখন মহকুমার হাসপাতালে একটি মাত্র রোগী থাকবার স্থানের টাকা জেলাবোর্ডের হাতে দেবে স্বর্গীয় পিতৃদেবের স্মৃতি-রক্ষা কল্পে–তখন হয়তো সে পাবে রায়সাহেব বা রায়বাহাদুর খেতাব।
আর সঙ্গে সঙ্গে ভাববে, এই তো জীবনের পরম সার্থকতা সে পেয়ে গেছে।
না দেখবে দুনিয়া–না দেখবে জীবন, টুলিপরা বলদের মতো ঘানিগাছের চারিধারে ঘুরেই জীবন কাটাবে।
রাত্রে সে সনৎকে ডেকে বললে–সনৎ, তোর সাহস আছে?
কেন দাদা?
আমি যদি বিদেশে বেরোই, আমার সঙ্গে যাবি?
এখুনি–যদি নিয়ে যাও!
অনেক দূরে হলেও?
যেখানে বল।
বাড়ির জন্যে মন কেমন করবে না?
আমি পুরুষ মানুষ না দাদা? ও কথাই ওঠে না!
আমি এমনি জিজ্ঞেস করছি
পরদিন সে ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরিতে বসে পড়ল পুরোনো দিনের বৃহত্তর ভারতের ইতিহাস। যেসব কথা সে জানত না, কোনোদিন শোনেনি–ডা. বসুর কথায় তার ইচ্ছে গেল সেগুলো জানবার ও পড়বার।
বিজয়সিংহের সিংহল বিজয়ের কাহিনি, চম্পা রাজ্যের কথা–সুদূর সমুদ্রপারের ভারতীয় উপনিবেশ চম্পা। ভারতবাসী অসির তীক্ষাগ্রভাগ দিয়ে যে দেশের মাটি পাথরের গায়ে নাগরাজ বাসুকী, শিব-পার্বতী ও বিষ্ণুমূর্তি অমর করে রেখেছে।
জামাতুল্লা খালাসিকে সে এক-শো বার ধন্যবাদ জানালো ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরিতে বসে পড়তে পড়তে।
সে তো এক পাড়াগাঁয়ে অলস জীবনযাপন করছিল—
কোনোদিন এসব কথা সে জানতেও পারত না–এত বড়ো ছবি তার মনে কোনোদিন জাগতও না–যদি দৈবক্রমে জামাতুল্লা খালাসি সেদিন তার পাশে এসে বসে দেশলাই না চাইত।
তুচ্ছ এক পয়সার দেশলাই।
পড়ার টেবিলে বসে বসেই সুশীলের হাসি পেল কথাটা ভেবে।
ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি থেকে বার হয়েই জামাতুল্লা খালাসির সঙ্গে দেখা করতে গেল।
মাঠের মধ্যে নির্দিষ্ট জায়গাটিতে বসে আছে। সুশীলকে দেখে সে বললে–আসুন বাবু, কাল রাতে এক কান্ড হয়ে গেছে! আপনার সঙ্গে দেখা করব বলে–
সুশীল বাধা দিয়ে বললে–কী–কী?
জামাতুল্লা বললে–সে এক আজগুবি কান্ড বাবু—
কীরকম ব্যাপার?
আপনার সেই বন্ধুর বাড়ি থেকে পাথরখানা নিয়ে কাল ফিরছি বাবু, মেটেবুরুজের কাছে ছোটোমোল্লাখালি বলে যে বস্তি ওই বস্তির কাছে আমার এক দোস্ত থাকে। ভাবলাম, চা খেয়ে যাই। সেখানে একেবারে মানুষ নেই–ফাঁকা মাঠ, সিকিমাইল দূরে ছোটোমোল্লাখালি বস্তি। হঠাৎ বাবু আমার মনে হল আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে, কে যেন আমার গলা দু-হাত দিয়ে চেপে ধরে আমায় মেরে ফেলবার চেষ্টা করছে–আমি তো চেঁচিয়ে উঠে তাকে জড়িয়ে ধরতে গেলাম–কিন্তু পড়ে গেলাম চিৎপাত হয়ে মাঠের মধ্যে–পেছনে সে-সময় পায়ের শব্দ শুনলাম যেন–