- বইয়ের নামঃ হীরামানিক জ্বলে
- লেখকের নামঃ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ গদ্যপদ্য
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. ছোট্ট গ্রাম সুন্দরপুর
হীরামানিক জ্বলে – কিশোর উপন্যাস – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
ছোট্ট গ্রাম সুন্দরপুর।
একটি নদীও আছে গ্রামের উত্তর প্রান্তে। মহকুমা থেকে বারো-তেরো মাইল, রেলস্টেশন থেকেও সাত-আট মাইল।
গ্রামের মুস্তাফি বংশ এক সময়ে সমৃদ্ধিশালী জমিদার ছিলেন, এখন তাঁদের অবস্থা আগের মতো না থাকলেও আশপাশের অনেকগুলি গ্রামের মধ্যে তাঁরাই এখনও পর্যন্ত বড়োলোক বলে গণ্য, যদিও ভাঙা পুজোর দালানে আগের মতো জাঁকজমকে এখন আর পুজো হয় না–প্রকান্ড বাড়ির যে মহলগুলোর ছাদ খসে পড়েছে গত বিশ-ত্রিশ বছরের মধ্যে, সেগুলো মেরামত করবার পয়সা জোটে না, বাড়ির মেয়েদের বিবাহ দিতে হয় কেরানি পাত্রদের সঙ্গে–অর্থের এতই অভাব।
সুশীল এই বংশের ছেলে। ম্যাট্রিক পাস করে বাড়ি বসে আছে–বড়ো বংশের ছেলে, তার পূর্বপুরুষদের মধ্যে কেউ কখনো চাকুরি করেননি, সুতরাং বাড়ি বসেই বাপের অন্ন ধ্বংস করুক, এই ছিল বাড়ির সকলেরই প্রচ্ছন্ন অভিপ্রায়।
সুশীল তাই করে আসছে অবশ্যি।
সুন্দরপুর গ্রামে ব্রাহ্মণ-কায়স্থের বাস খুব বেশি নেই–আগে অনেক ভদ্র গৃহস্থের বাস ছিল, তাদের সবাই এখন বিদেশে চাকুরি করে–বড়ো বড়ো বাড়ি জঙ্গলাবৃত হয়ে পড়ে আছে।
মুস্তাফিদের প্রকান্ড ভদ্রাসনের দক্ষিণে ও পূর্বে তাঁদের দৌহিত্র রায় বংশ বাস করে। পূর্বে যখন মুস্তাফিদের সমৃদ্ধির অবস্থা ছিল তখন বিদেশ থেকে কুলগৌরব-সম্পন্ন রায়দের আনিয়ে কন্যাদান করে জমি দিয়ে এখানেই বাস করিয়েছিলেন এঁরা।
কালের বিপর্যয়ে সেই রায় বংশের ছেলেরা এখন সুশিক্ষিত ও প্রায় সকলেই বিদেশে ভালো চাকুরি করে। নগদ টাকার মুখ দেখতে পায়–বাড়ি কেউ বড়ো একটা আসে না– যখন আসে তখন খুব বড়োমানুষি চাল দেখিয়ে যায়। পদে পদে মাতুল বংশের ওপর টেক্কা দিয়ে চলাই যেন তাদের দু-একমাস-স্থায়ী পল্লিবাসের সর্বপ্রধান লক্ষ্য।
আশ্বিন মাস। পুজোর বেশি দিন দেরি নেই।
অঘোর রায়ের বড়ো ছেলে অবনী সস্ত্রীক বাড়ি এসেছে। শোনা যাচ্ছে, দুর্গোৎসব না করলেও অবনী এবার ধুমধামে নাকি কালী পুজো করবে। অবনী সরকারি দপ্তরে ভালো চাকুরি করে। অবনীর বাবা অঘোর রায় ছেলের কাছেই বিদেশে থাকেন। তিনি এ-সময় বাড়ি আসেননি, তাঁর মেজো ছেলে অখিলের সঙ্গে পুরী গিয়েছেন। অখিল যেন কোথাকার সাবডেপুটি–পনেরো দিন ছুটি নিয়ে স্ত্রীপুত্র ও বৃদ্ধ পিতাকে নিয়ে বেড়াতে বার হয়েছে।
সুশীল অবনীদের বৈঠকখানায় বসে এদের চালবাজির কথা শুনছিল অনেকক্ষণ থেকে।
অবনী বললে–মামা, তোমাদের বড়ো শতরঞ্জি আছে?
একখানা দালানজোড়া শতরঞ্জি তো ছিল জানি–কিন্তু সেটা ছিঁড়ে গিয়েছে জায়গায় জায়গায়।
ছেঁড়া শতরঞ্জি আমার চলবে না। তাহলে কলকাতায় লোক পাঠিয়ে ভালো একখানি বড়ো শতরঞ্জি কিনে আনি, বন্ধুবান্ধব পাঁচজনে আসবে, তাদের সামনে বার করার উপযুক্ত হওয়া চাই তো! বড়ো আলো আছে?
বাতির ঝাড় ছিল, এক-এক থাকে কাঁচ খুলে গিয়েছে–তাতে চলে তো নিও।
তোমাদের তাতেই কাজ চলে?
কেন চলবে না? দেখায় খুব ভালো। তা ছাড়া দুর্গোৎসবের কাজ দিনমানেই বেশি–রাত্রে আরতি হয়ে গেলেই আলোর কাজ তো মিটে গেল।
আমায় ডে-লাইটের ব্যবস্থা করতে হবে দেখছি। কালী পুজোর রাতে আলোর ব্যবস্থা একটু ভালোরকম থাকা দরকার। ইলেকট্রিক আলোয় বারো মাস বাস করা অভ্যেস, সত্যি পাড়াগাঁয়ে এসে এমন অসুবিধে হয়!
বৃদ্ধ সত্যনারায়ণ গাঙ্গুলি তাঁর ছোটো ছেলের একটা চাকুরির জন্যে অবনীর কাছে ক-দিন ধরে হাঁটাহাঁটি করে একটু–অবশ্যি খুব সামান্যই একটু–ভরসা পেয়েছিলেন, তিনি অমনি বলে উঠলেন–তা অসুবিধে হবে না? বলি তোমরা বাবাজি কীরকম জায়গায় থাক, কী ধরনে থাক–তা আমার জানা আছে তো! গঙ্গাচানের যোগে কলকাতা গেলেই তোমাদের ওখানে গিয়ে উঠি, আর সে কী যত্ন। ওঃ, ইলেকটিরি আলো না হলে কি বাবাজি তোমাদের চলে।
সুশীল কলকাতায় দু-একবার মাত্র গিয়েছে,–আধুনিক সভ্যতার যুগের নতুন জিনিসই তার অপরিচিত–শিক্ষিত ও শহুরেবাবু অবনীর সঙ্গে ভয়ে ভয়ে তাকে কথা বলতে হয়।
তবুও সে বললে–ডে-লাইটের চেয়ে কিন্তু ঝাড় লণ্ঠন দেখায় ভালো—
অবনী হেসে গড়িয়ে পড়ে আর-কী!
ওহে যে যুগে জমিদারপুত্রেরা নিষ্কর্মা বসে থাকত আর হাতিতে চড়ে জরদগবের মতো ঘুরে বেড়াত–ওসব চাল ছিল সেকালের। মডার্ন যুগে ওসব অচল, বুঝলে মামা? এ হল প্রগতির যুগ–হ্যাঁতির বদলে এসেছে ইলেকট্রিক লাইট–সেকালকে আঁকড়ে বসে থাকলে চলবে?
বনেদি পুরোনো আমলের চালচলনে আবাল্য অভ্যস্ত সুশীল। বয়সে যুবক হলেও প্রাচীনের ভক্ত।
সে বললে–কেন, হাতি চড়াটা কী খারাপ দেখলে?
রামো:! জবড়জং ব্যাপার! হাতির মতো মোটা জানোয়ারের ওপর বসে-থাকা পেটমোটা নাদুস-নুদুস–
সত্যনারায়ণ গাঙ্গুলি বললেন–গোবর-গণেশ–
জমিদারের ছেলেরই শোভা পায়, কিন্তু কাজে যারা ব্যস্ত, সময় যাদের হাতে কম, দিনে যাদের ত্রিশ মাইল চক্কর দিয়ে বেড়াতে হয় নিজের কাজে বা অফিসের কাজে তাদের পক্ষে দরকার মোটর বাইক বা মোটর কার। স্মার্ট যারা–তাদের উপযুক্ত যানই হচ্ছে–