বুড়ীর পুত্রের নাম খিজির সেখ। সে তসবির আঁকিত। দিল্লীতে তাহার দোকান। মার কাছে দুই দিন থাকিয়া, সে দিল্লী গেল। দিল্লীতে তাহার এক বিবি ছিল। সেই দোকানেই থাকিত। বিবির নাম ফতেমা। খিজির, মার কাছে রূপনগরের কথা যাহা শুনিয়াছিল, তাহা সমস্তই ফতেমার কাছে বলিল। সমস্ত কথা বলিয়া, খিজির ফতেমাকে বলিল যে, “তুমি এখনই দরিয়া বিবির কাছে যাও। এই সংবাদ বেগম সাহেবাকে বেচিয়া আসিতে বলিও। কিছু পাওয়া যাইবে |”
দরিয়া বিবি পাশের বাড়ীতেই বাস করে। ঘরের পিছন দিয়া যাওয়া যায়। অতএব ফতেমা বিবি, বেপরদা না হইয়াও, দরিয়া বিবির গৃহে গিয়া উপস্থিত হইলেন।
খিজির বা ফতেমার বিশেষ পরিচয় দিবার প্রয়োজন হয় নাই। কিন্তু দরিয়া বিবির বিশেষ পরিচয় চাহি। দরিয়া বিবির আসল নাম, দরীর-উন্নিসা কি এমনই একটা কিছু, কিন্তু সে নাম ধরিয়া কেহ ডাকিত না–দরিয়া বিবি বলিয়াই ডাকিত। তার বাপ মা ছিল না, কেবল জ্যেষ্ঠা ভগিনী আর একটা বুড়ী ফুফু, কি খালা, কি এমনই একটা কি ছিল। বাড়ীতে পুরুষমানুষ কেহ বাস করিত না। দরিয়া বিবির বয়েস সতের বৎসরের বেশী নহে–তাহাতে আবার কিছু খর্ব্বাকার, পনের বছরের বেশী দেখাইত না। দরিয়া বিবি বড় সুন্দরী, ফুটন্ত ফুলের মত, সর্বদা প্রফুল্ল।
দরিয়া বিবির ভগিনী অতি উত্তম সুরমা ও আতর প্রস্তুত করিতে পারিত। তাহাই বিক্রয় করিয়া তাহাদের দিনপাত হইত। আপনারা এক্কা বা দোলা করিয়া বড়মানুষের বাড়ী গিয়া বেচিয়া আসিত। দু:খী মানুষ, রাত্রি হইলে পদব্রজেও যাইত। বাদশাহের অন্ত:পুরে কাহারও যাইবার অধিকার ছিল না–বাহিরের স্ত্রীলোকেরও না–কিন্তু দরিয়া বিবির সেখানে যাইবারও উপায় ছিল। তাহা পরে বলিতেছি।
ফতেমা আসিয়া দরিয়া বিবিকে চঞ্চলকুমারীর সংবাদ বলিল, এবং বলিয়া দিল, ঐ সংবাদ বিক্রয় করিয়া অর্থ আনিতে হইবে।
দরিয়া বিবি বলিল, “রঙমহালের ভিতর প্রবেশ করিতে হইবে–পরওয়ানাখানা কোথায়?”
ফতেমা বলিল, “তোমারই কাছে আছে |” দরিয়া বিবি তখন পেটারা খুলিয়া একখানা কাগজ বাহির করিল। তাহা উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিয়া বলিল, “এইখানা বটে!”
দরিয়া বিবি তখন কিছু সুরমা লইয়া ও পরওয়ানা লইয়া বাহির হইল।
রাজসিংহ – ২.১
দ্বিতীয় খণ্ড
নন্দনে নরক
প্রথম পরিচ্ছেদ : অদৃষ্টগণনা
জ্যোৎস্নালোকে, শ্বেতসৈকত-পুলিন-মধ্যবাহিনী নীলসলিলা যমুনার উপকূলে নগরীগণপ্রধানা মহানগরী দিল্লী, প্রদীপ্ত মণিখণ্ডবৎ জ্বলিতেছে–সহস্র সহস্র মর্মরাদিপ্রস্তরনির্মিত মিনার গম্বুজ বুরুজ ঊর্ধ্বে উত্থিত হইয়া চন্দ্রালোকের রশ্মিরাশি প্রতিফলিত করিতেছে। অতিদূরে কুতবমিনারের বৃহচ্চূড়া, ধূমময় উচ্চস্তম্ভবৎ দেখা যাইতেছিল, নিকটে জুম্মা মসজিদের চারি মিনার নীলকাশ ভেদ করিয়া চন্দ্রলোকে উঠিয়াছে । রাজপথে রাজপথে পন্যবীথিকা ; বিপণিতে শত শত দীপমালা, পুষ্পবিক্রেতার পুষ্পরাশির গন্ধ, নাগরিকজনপরিহিত পুষ্পরাজির গন্ধ, আতর-গোলাবের সুগন্ধ, গৃহে গৃহে সঙ্গীতধ্বনি, বহুজাতীয় বাদ্যের নিক্কণ, নাগরীগণের কখন উচ্চ, কখন মধুর হাসি, অলঙ্কার শিঞ্জিত,-এই সমস্ত একত্রিত হইয়া, নরকে নন্দনকাননের ছায়ার ন্যায় অদ্ভুত প্রকার মোহ জন্মাইতেছে। ফুলের ছড়াছড়ি, আতর-গোলাবের ছড়াছড়ি,-নর্তকীর নূপুরনিক্কণ, গায়িকার কণ্ঠে সপ্তসুরের আরোহণ অবরোহণ, বাদ্যের ঘটা, কমনীয়কামিনীকরতলকলিত তালের চট-চটা; মদ্যের প্রবাহ, বিলোল কটাক্ষবহ্নি প্রবাহ; খিচুড়ি পোলাওয়ের রাশি রাশি; বিকট, কপট, মধুর, চতুর, চতুর্বিধ হাসি; পথে পথে অশ্বের পদধ্বনি, দোলার বাহকের বীভৎস ধ্বনি, হস্তীর গালঘণ্টার ধ্বনি, এক্কার ঝনঝনি–শকটের ঘ্যানঘ্যানানি।
নগরের মধ্যে বড় গুলজার চাঁদনী চৌক। সেখানে রাজপুত বা তুর্কী অশ্বারূঢ় হইয়া স্থানে স্থানে পাহারা দিতেছে। জগতে যাহা কিছু মূল্যবান্, তাহা দোকান সকলে থরে থরে সাজান আছে। কোথাও নর্তকী রাস্তায় লোক জমাইয়া, সারঙ্গের সুরে নাচিতেছে, গায়িতেছে ; কোথাও বাজিকর বাজি করিতেছে, প্রত্যেকের নিকট শত শত দর্শক ঘেরিয়া দাঁড়াইয়া দর্শন করিতেছে। সকলের অপেক্ষা জনতা “জ্যোতিষী” দিগের কাছে। মোগল বাদশাহদিগের সময়ে জ্যোতির্বিদগণের যেরূপ আদর ছিল, এমন বোধ হয়, আর কখনও হয় নাই। হিন্দু মুসলমানে তাঁহাদের তুল্য আদর করিতেন। মোগল বাদশাহেরা জ্যোতিষ শাস্ত্রের অতিশয় বশীভূত ছিলেন; তাঁহাদিগের গণনা না জানিয়া অনেক সময়ে অতি গুরুতর কার্যে প্রবৃত্ত হইতেন না। যে সকল ঘটনা এই গ্রন্থে বর্ণিত হইয়াছে, তাহার কিছু পরে ঔরঙ্গজেবের কনিষ্ঠ পুত্র আকব্বর রাজবিদ্রোহী হইয়াছিলেন। পঞ্চাশ হাজার রাজপুত সেনা তাঁহার সহায় ছিল; ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে অল্প সেনাই ছিল, কিন্তু জ্যোতির্বিদের গণনার উপর নির্ভর করিয়া আকব্বর সৈন্যযাত্রায় বিলম্ব করিলেন, ইতিমধ্যে ঔরঙ্গজেব কৌশল করিয়া তাঁহার চেষ্টা নিষ্ফল করিলেন।
দিল্লীর চাঁদনী-চৌকে, জ্যোতিষিগণ রাজপথে আসন পাতিয়া, পুথি পাঁজি লইয়া, মাথায় উষ্ণীষ বাঁধিয়া বসিয়া আছেন–শত শত স্ত্রীপুরুষ, আপন আপন অদৃষ্ট গণাইবার জন্য তাঁহাদের কাছে গিয়া বসিয়া আছে; পরদানশীন বিবিরাও মুড়িসুড়ি দিয়া যাইতে সঙ্কোচ করেন নাই। একজন জ্যোতিষীর আসনের চারি পাশে বড় জনতা। তাহার বাহিরে একজন অবগুণ্ঠনবতী যুবতী ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। জ্যোতিষীর কাছে যাইবার ইচ্ছা, কিন্তু সাহস করিয়া জনতা ঠেলিয়া প্রবেশ করিতে পারিতেছে না–ইতস্তত: দেখিতেছে। এমন সময়ে সেই স্থান দিয়া, একজন অশ্বারোহী পুরুষ যাইতেছিল।
অশ্বারোহী যুবা পুরুষ। দেখিয়া আহেলে-বিলায়ত মোগল বলিয়া বোধ হয়। তিনি অত্যন্ত সুশ্রী, মোগলের ভিতরও এরূপ সুশ্রী পুরুষ দুর্লভ। তাঁহার বেশভূষার অতিশয় পারিপাট্য। দেখিয়া একজন বিশেষ সম্ভ্রান্ত লোক বলিয়া বোধ হয়। অশ্বও সম্ভ্রান্তবংশীয়।
জনতার জন্য অশ্বারোহী অতি মন্দভাবে অশ্বচালনা করিতেছিলেন। যে যুবতী ইতস্তত: নিরীক্ষণ করিতেছিল, সে তাঁহাকে দেখিতে পাইল। দেখিয়াই, নিকটে আসিয়া ঘোড়ার লাগাম ধরিয়া থামাইল। বলিল, “খাঁ সাহেব–মবারক সাহেব–মবারক!”
মবারক–অশ্বারোহীর ঐ নাম–জিজ্ঞাসা করিল, “কে তুমি?”
যুবতী বলিল, “ইয়া আল্লা! আর কি চিনিতেও পার না?”
মবারক বলিল, “দরিয়া?”
দরিয়া বলিল, “জী |”
ম। তুমি এখানে কেন?
দ। কেন, আমি ত সকল জায়গায় যাই। তোমার ত নিষেধ নাই। তুমি বারণ কর কি?
ম। আমি কেন বারণ করিব? তুমি আমার কে?
তার পর মৃদুতর স্বরে মবারক বলিল, “কিছু চাই কি?”
দরিয়া কাণে আঙ্গুল দিয়া বলিল, “তোবা! তোমার টাকা আমার হারাম! আমরা আতর সুর্মা করিতে জানি |”
ম। তবে আমাকে পাকড়া করিলে কেন?
দ। নাম, তবে বলিব।
মবারক ঘোড়া হইতে নামিল। বলিল, “এখন বল |”
দরিয়া বলিল, “এই ভিড়ের ভিতর একজন জ্যোতিষী বসিয়া আছেন। ইনি নূতন
আসিয়াছেন। ইঁহার মত জ্যোতির্বিদ কখন নাকি আসে নাই। ইঁহার কাছে তোমাকে তোমার কেস্মৎ গণাইতে হইবে |”
ম। আমার কেস্মৎ জানিয়া তোমার কি হইবে? তোমার গণাও।
দ। আমার কেস্মৎ আমি জানিতে চাহি না। না গণাইয়াই তাহা জানিতে পারিয়াছি। তোমার কেস্মৎ জানাই আমার দরকার।
এই বলিয়া দরিয়া, মবারকের হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া যাইবার উপক্রম করিল। মবারক বলিল, “আমার ঘোড়া ধরে কে?”
গোটাকতক ছেলে রাজপথে দাঁড়াইয়া লাড্ডু খাইতেছিল। মবারক বলিল, “তোমরা কেহ এক লহমা আমার ঘোড়াটা ধরিয়া রাখ। আমি আসিয়া, তোমাদের আরও লাড্ডু দিব |”
এই বলিবামাত্র দুই তিনটা ছেলে আসিয়া ঘোড়া ধরিল। একটা প্রায় নগ্ন–সে ঘোড়ার উপর চড়িয়া বসিল। মবারক তাহাতে মারিতে গেলেন। কিন্তু তাহার প্রয়োজন হইল না–ঘোড়া একবার পিছনের পা উঁচু করিয়া তাহাকে ফেলিয়া দিল। তাহাকে ভূমিশয্যাগত দেখিয়া, অপর বালকেরা তাহার হাতের লাড্ডু কাড়িয়া লইয়া ভোজন করিল। তখন মবারক নিশ্চিন্ত হইয়া অদৃষ্ট গণাইতে গেলেন।
মবারককে দেখিয়া অপর লোক সকল পথ ছাড়িয়া দিল। দরিয়া বিবি তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে গেল। জ্যোতিষীর কাছে মবারক হাত পাতিয়া দিলেন। জ্যোতিষী অনেক দেখিয়া শুনিয়া বলিল, “আপনি গিয়া বিবাহ করুন |” পশ্চাৎ হইতে, ভিড়ের ভিতর লুকাইয়া দরিয়া বিবি বলিল, “করিয়াছে |”
জ্যোতিষী বলিল, “কে ও কথা বলিল?”
মবারক বলিলেন, “ও একটা পাগলী। আপনি বলিতে পারেন, আমার কি রকম বিবাহ হইবে?”
জ্যোতিষী বলিল, “আপনি কোন রাজপুত্রীকে বিবাহ করুন |”
মবারক বলিল, “তাহা হইলে কি হইবে?”
জ্যোতিষী করিল, “তাহা হইলে, আপনার খুব পদবৃদ্ধি হইবে |”
ভিড়ের ভিতর হইতে দরিয়া বিবি বলিল, “আর মৃত্যু |”
জ্যোতিষী উত্তর বলিল, “কে ও?”
ম। সেই পাগলী।
জ্যোতিষী। পাগলী নয়। ও বোধ হয় মনুষ্য নয়। আমি আর আপনার হাত দেখিব না।
মবারক কিছু বুঝিতে পারিলেন না। জ্যোতিষীকে কিছু দিয়া, ভিড়ের ভিতর দরিয়ার অন্বেষণ করিলেন। কিছুতেই আর তাহাকে দেখিতে পাইলেন না। তখন কিছু বিষণ্ণভাবে, অশ্বে আরোহণপূর্বক, দুর্গাভিমুখে চলিলেন। বলা বাহুল্য, বালকেরা কিছু লাড্ডু পাইল।
রাজসিংহ – ২.২
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : জেব উন্নিসা