সভাভঙ্গ হইল, তবু মাণিকলাল গেল না। সকলেই চলিয়া গেল, মাণিকলাল গোপনে মহারাণাকে জানাইল, “মবারকের বখশিশের কথাটা এই সময়ে মহারাজকে স্মরণ করিয়া দিতে হয় |”
রাজসিংহ জিজ্ঞাসা করিলেন, “সে কি চায়?”
মা। বাদশাহের যে কন্যা আমাদিগের কাছে বন্দী আছে, তাহাকেই চায়।
রা। তাহাকে যদি বাদশাহের নিকট ফেরৎ না পাঠাই, তবে বোধ করি, সন্ধি হইবে না। আর স্ত্রীলোকের উপর কি প্রকারে আমি পীড়ন করিব?
মা। পীড়ন করিতে হইবে না। শাহজাদীর সঙ্গে মবারকের গত রাত্রে সাদী হইয়াছে।
রা। সেই কথা শাহজাদী বাদশাহকে বলিলেই বোধ হয়, সব গোল মিটিবে।
মা। এক রকম–কেন না, দুই জনেরই মাথা কাটা যাইবে।
রা। কেন?
মা। শাহজাদীদের শাহজাদা ভিন্ন বিবাহ নাই। এই শাহজাদী একজন ক্ষুদ্র সৈনিককে বিবাহ করিয়া দিল্লীর বাদশাহের কুলের কলঙ্ক করিয়াছে। বিশেষ বাদশাহের কুলের কলঙ্ক করিয়াছে। বিশেষ বাদশাহকে না জানাইয়া এ বিবাহ করিয়াছে, এজন্য তাহাকে দিল্লীর রঙমহালের প্রথানুসারে বিষ খাইতে হইবে। আর মবারক সাপের বিষে যখন মরেন নাই, তখন তাঁহাকে হাতীর পায়ে, কি শূলে যাইতে হইবে। যদি সে অপরাধও মার্জনা হয়, তবে তিনি মহারাজের যে উপকার করিয়াছেন, তাহার জন্য বাদশাহের কাছে শূলে যাইবার যোগ্য। জানিতে পারিলে বাদশাহ তাঁহাকে শূলে দিবে। তাহা ছাড়া তিনি বিমাননুমতিতে শাহজাদী বিবাহ করিয়াছেন, সে জন্যও শূলে যাইতে বাধ্য।
রাজসিংহ। আমি ইহার কিছু প্রতিকার করিতে পারি কি?
মাণিক। ঔরঙ্গজেব, কন্যা-জামাতাকে মার্জনা না করিলে আপনি সন্ধি করিবেন না, এই নিয়ম করিতে পারেন।
রাজসিংহ বলিলেন, “তাহা আমি করিতে স্বীকৃত হইতেছি। উহাদের জন্য আমি একখানি পৃথক্ পত্র বাদশাহকে লিখিতেছি। তাহাও তুমি ঐ সঙ্গে লইয়া যাও। ঔরঙ্গজেব কন্যাকে মার্জনা করিতে পারেন। কিন্তু মবারককে মার্জনা করিতে তিনি আপাতত: স্বীকৃত হইলেও, তাহাকে যে তিনি নিষ্কৃতি দিবেন, এমন আমার ভরসা হয় না। যাই হউক, মবারক যদি ইহাতে সন্তুষ্ট হয়, তবে আমি ইহা করিতে প্রস্তুত আছি |”
এই বলিয়া রাজসিংহ একখানি পৃথক পত্র স্বহস্তে লিখিয়া মাণিকলালকে দিলেন। মাণিকলাল পত্র দুইখানি লইয়া সেই রাত্রিতে উদয়পুর চলিল।
উদয়পুরে গিয়া মাণিকলাল প্রথম নির্মলকুমারীকে এই সকল সংবাদ দিলেন। নির্মল সন্তুষ্ট হইল। সেও একখানি পত্র বাদশাহকে এই মর্মে লিখিল–
“শাহানশাহ!
বাঁদীর অসংখ্য কুর্ণিশ। হুজুর যাহা আজ্ঞা করিয়াছিলেন, বাঁদী তাহা সম্পন্ন করিয়াছে। এক্ষণে হুজুরের সম্মতি পাইলেই হয়। আমার শেষ ভিক্ষাটা স্মরণ রাখিবেন। সন্ধি করিবেন |”
সে পত্রও নির্মল মাণিকলালকে দিল। তার পর নির্মল জেব-উন্নিসাকে সকল কথা জানাইল, তিনিও তাহাতে সন্তুষ্ট হইলেন। এ দিকে মাণিকলাল মবারককে সকল কথা জানাইলেন। মবারক কিছু বলিল না। মাণিকলাল তাহাকে সতর্ক করিবার জন্য বলিল, “সাহেব! বাদশাহের নিকট ফিরিয়া গেলে, তিনি যে যথার্থ মার্জনা করিবেন, এমন ভরসা আমি করিব না।
মবারক বলিল, “নাই করুন |”
পরদিন প্রাতে মাণিকলাল, নির্মলকুমারীর পায়রা চাহিয়া লইয়া গিয়া, পত্রগুলি কাটিয়া ছোট করিয়া তাহার পায়ে বাঁধিয়া দিল। পায়রা ছাড়িয়া দিবামাত্র সে আকাশে উঠিল। পায়ের ভরে বড় পীড়িত। তথাপি কোন মতে উড়িয়া যেখানে ঔরঙ্গজেব ঊর্ধ্বমুখে আকাশ নিরীক্ষণ করিতেছিলেন, সেইখানে বাদশাহের কাছে পত্র পৌঁছাইয়া দিল।
রাজসিংহ – ৮.১০
দশম পরিচ্ছেদ : অগ্নিনির্বাণকালে উদিপুরী ভস্ম
কপোত শীঘ্রই ঔরঙ্গজেবের উত্তর লইয়া আসিল। রাজসিংহ যাহা যাহা চাহিয়াছিলেন, ঔরঙ্গজেব সকলেতেই সম্মত হইলেন। কেবল একটা গোলযোগ করিলেন, লিখিলেন, “চঞ্চলকুমারীকে দিতে হইবে |” রাজসিংহ বলিলেন, “তদপেক্ষা আপনাকে ঐখানে সসৈন্যে কবর দেওয়া আমার মনোমত |” কাজেই ঔরঙ্গজেবকে সে বাসনা ছাড়িতে হইল। তিনি সন্ধিতে সম্মত হইয়া মুনশীর দ্বারা সেই মর্মে সন্ধিপত্র লেখাইয়া আপনার পাঞ্জা অঙ্কিত করিয়া, স্বহস্তে তাহাতে “মঞ্জুর” লিখিয়া দিলেন। জেব-উন্নিসা ও মবারক সম্বন্ধে একখানি পৃথক পত্রে তাঁহাদিগকে মার্জনা করিতে স্বীকৃত হইলেন, কিন্তু একটি সর্ত এই করিলেন যে, এ বিবাহের কথা কাহারও সাক্ষাতে কখন প্রকাশ করিবে না। সেই সঙ্গে ইহাও স্বীকার করিলেন যে, কন্যা যাহাতে স্বামিসন্দর্শনে বঞ্চিত না হয়েন, সে উপায়ও বাদশাহ করিবেন।
রাজসিংহ সন্ধিপত্র পাইয়া, মোগল সেনা মুক্তি দিবার আজ্ঞা প্রচার করিলেন। রাজপুতেরা হাতী লাগাইয়া গাছ সকল টানিয়া বাহির করিল। মোগলেরা হঠাৎ আহার্য্য কোথায় পাইবে এই জন্য রাজসিংহ দয়া করিয়া বহুতর হাতীর পিঠে বোঝাই দিয়া, অনেক আহার্য্য বস্তু উপঢৌকন প্রেরণ করিলেন এবং শেষে উদিপুরী, জেব-উন্নিসা ও মবারককে তাঁহার নিকট পাঠাইয়া দিবার জন্য উদয়পুরে আদেশ পাঠাইলেন। তখন নির্মল , চঞ্চলকে ইঙ্গিত করিয়া কাণে কাণে বলিল, “বেগম, তোমার দাসীপনা করিল কৈ?” এই বলিয়া নির্মল উদিপুরীকে বলিল, “আমি যে নিমন্ত্রণ করিতে দিল্লী গিয়াছিলাম, সে নিমন্ত্রণ রক্ষা করিলেন না?”
উদিপুরী বলিল, “তোমার জিব আমি টুকরা টুকরা করিয়া কাটিব। তোমাদের সাধ্য কি যে, আমাকে দিয়া তামাকু সাজাও? তোমাদের মত ক্ষুদ্র লোকের সাধ্য কি যে, বাদশাহের বেগম আটক রাখ? কেমন, এখন ছাড়িতে হইল ত? কিন্তু যে অপমান করিয়াছ, তাহার প্রতিফল দিব। উদয়পুরের চিহ্ন মাত্র রাখিব না |”
তখন চঞ্চলকুমারী স্থিরভাবে বলিলেন, “শুনিয়াছি, মহারাণা বাদশাহকে দয়া করিয়া তোমাদের ছাড়িয়া দিয়াছেন। আপনি তাঁহার জন্য একটা মিষ্টি কথা বলিতে জানেন না। অতএব আপনাকে ছাড়া হইবে না। আপনি বাঁদী মহলে গিয়া আমার জন্য তামাকু প্রস্তুত করিয়া আনুন |”
জেব-উন্নিসা বলিল, “সে কি মহারাণি! আপনি এত নির্দয়?”
চঞ্চলকুমারী বলিল, “আপনি যাইতে পারেন –কেহ বিঘ্ন করিবে না। ইহাকে আমি এক্ষণে যাইতে দিতেছি না |”
জেব-উন্নিসা অনেক অনুনয় করিল, শেষ উদিপুরীও কিছু বিনীত ভাব অবলম্বন করিল। কিন্তু চঞ্চলকুমারী বড় শক্ত। দয়া করিয়া কেবল এইটুকু বলিলেন, “আমার জন্য একবার তামাকু প্রস্তুত করুক, তবে যাইতে পারিবে |”
তখন উদিপুরী বলিল, “তামাকু প্রস্তুত করিতে আমি জানি না |”
চঞ্চলকুমারী বলিল, “বাঁদীরা দেখাইয়া দিবে |”
অগত্যা উদিপুরী স্বীকৃত হইল। বাঁদীরা দেখাইয়া দিল। উদিপুরী চঞ্চলকুমারীর জন্য তামাকু সাজিল।
তখন চঞ্চলকুমারী সেলাম করিয়া তাহাদের বিদায় করিলেন। বলিলেন, “এখানে যাহা যাহা ঘটিয়াছে, সমস্তই আপনি বাদশাহকে জানাইবেন, এবং তাঁহাকে স্মরণ করিয়া দিবেন যে, আমিই তসবিরে নাথি মারিয়া নাক ভাঙ্গিয়া দিয়াছিলাম। আরও বলিবেন, পুনশ্চ যদি তিনি কোন হিন্দুবালার অপমানের ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে আমি কেবল তসবিরে পদাঘাত করিয়া সন্তুষ্ট হইব না |”
তখন উদিপুরী নিদাঘের মেঘের মত সজলকান্তি হইয়া বিদায় লইল।
মহিষী, কন্যা ও খাদ্য পাইয়া ঔরঙ্গজেবের বেত্রাহত কুক্কুরের মত বদনে লাঙ্গুল নিহিত করিয়া রাজসিংহের সম্মুখ হইতে পলায়ন করিলেন।
রাজসিংহ – ৮.১১
একাদশ পরিচ্ছেদ : অগ্নিকাণ্ডে তৃষিতা চাতকী