এদিকে বাদশাহ বড় গোলযোগে পড়িলেন। তাঁহার সমস্ত সেনা রন্ধ্রপথে প্রবেশ করিবার অল্প পরেই দিবাবসান হইল। কিন্তু রন্ধ্রের অপর মুখে কেহই পৌঁছিল না। অপর মুখের কোন সংবাদ নাই। সন্ধ্যার পরেই সেই সঙ্কীর্ণ রন্ধ্রপথে অতিশয় গাঢ় অন্ধকার হইল। সমস্ত সেনার পথ আলোকযুক্ত হয়, এমন রোশনাইয়ের সরঞ্জাম সঙ্গে কিছুই নাই। বাদশাহের ও বেগমদিগের নিকট রোশনাই হইল–কিন্তু আর সমস্ত সেনাই গাঢ় তিমিরাচ্ছন্ন। তাহাতে আবার বন্ধুর পার্বত্য তলভূমি, বিকীর্ণ উপলখণ্ডে ভীষণ হইয়া আছে। ঘোড়া সকল টক্কর খাইতে লাগিল। কত ঘোড়া আরোহীসমেত পড়িয়া গেল; উপর অশ্বের পাদদলনে পিষ্ট হইয়া অশ্ব ও আরোহী উভয়ে আহত বা নিহত হইল। কত হাতীর পায়ে বড় বড় শিলাখণ্ড ফুটিতে লাগিল–হস্তিগণ দুর্দমনীয় হইয়া ইতস্তত: ফিরিতে লাগিল। অশ্বারোহিণী স্ত্রীগণ, ভূপতিতা হইয়া অশ্বপদে, হস্তিপদে দলিত হইয়া, আর্তনাদ করিতে লাগিল। দোলার বাহকদিগের চরণ সকল ক্ষতবিক্ষত হইয়া রুধিরে পরিপ্লুত হইতে লাগিল। পদাতিক সেনা আর চলিতে পারে না–পদস্খলনে এবং উপলাঘাতে অত্যন্ত পীড়িত হইল। তখন ঔরঙ্গজেব রাত্রিতে সেনার গতি বন্ধ করিয়া শিবির সংস্থাপন করিতে অনুমতি করিলেন।
কিন্তু তাম্বু ফেলিবার স্থান নাই। অতি কষ্টে বাদশাহ ও বেগমদিগের তাম্বুর স্থান হইল। আর কাহারও হইল না। যে যেখানে ছিল, সে সেইখানে রহিল। অশ্বারোহী অশ্বপৃষ্ঠে–গজারোহী গজপৃষ্ঠে–পদাতিক চরণে ভর করিয়া রহিল। কেহ বা কষ্টে পর্বতসানুদেশে একটু স্থান করিয়া, তাহাতে পা ঝুলাইয়া বসিয়া রহিল। কিন্তু সানুদেশ দুরারোহণীয়,-এমন খাড়া যে, উঠা যায় না। অধিকাংশ লোকই এরূপ বিশ্রামের স্থান পাইল না।
তার পর বিপদের পর বিপদ–খাদ্যের অত্যন্ত অভাব। সঙ্গে যাহা ছিল, তাহা ত রাজপুতেরা লুঠিয়া লইয়াছে। যে রন্ধ্রপথে সেনা উপস্থিত–সেখানে অন্য খাদ্যের কথা দূরে থাক, ঘোড়ার ঘাস পর্যন্ত পাওয়া যায় না। সমস্ত দিনের পরিশ্রমের পর কেহ কিছু খাইতে পাইল না; বাদশাহ, কি বেগমেরাও নয়। ক্ষুধায়, নিদ্রার অভাবে সকলে মৃতপ্রায় হইল। মোগল সেনা বড় গোলযোগে পড়িল।
এ দিকে বাদশাহ উদিপুরী ও জেব-উন্নিসার হরণ-সংবাদ প্রাপ্ত হইলেন। ক্রোধে অগ্নিতুল্য জ্বলিয়া উঠিলেন। একা সমস্ত সৈন্যদিগকে নিহত করা যায় না, নহিলে ঔরঙ্গজেব তাহা করিতেন। বিবরে নিরুদ্ধ সিংহ, সিংহীকে পিঞ্জরাবদ্ধ দেখিলে যেরূপ গর্জন করে, ঔরঙ্গজেব সেইরূপ গর্জন করিতে লাগিলেন।
গভীর রাত্রে সেনার কোলাহল কিছু নিবৃত্ত হইলে, অনেকে শুনিল, অতি দূরে অনেক পাহাড়ের উপর যেন বহুসংখ্যক বৃক্ষ উন্মূলিত হইতেছে। কিছু বুঝিতে না পারিয়া অথবা ভৌতিক শব্দ মনে করিয়া, সকলে চুপ করিয়া রহিল।
রাজসিংহ – ৮.০২
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : দাহনে বাদশাহের বড় জ্বালা
রাত্রি প্রভাতে ঔরঙ্গজেব সৈন্যচালনার আদেশ করিলেন। সেই বৃহতী সেনা,-তোপ লইয়া চতুরঙ্গিণী–অতি দ্রুতপদে রন্ধ্রমুখের উদ্দেশে চলিল। ক্ষুৎপিপাসায় সকলেই অত্যন্ত ক্লিষ্ট–বাহির হইলে তবে পানাহারের ভরসা–সকলে শ্রেণীভঙ্গ করিয়া ছুটিল। ঔরঙ্গজেব নিজে উদিপুরী ও জেব-উন্নিসাকে মুক্ত করিয়া উদয়পুর নি:শেষে ভস্ম করিবার জন্য আপনার ক্রোধাগ্নিতে আপনি দগ্ধ হইতেছেন–তিনি আর কিছুমাত্র ধৈর্য্যাবলম্বন করিতে পারিলেন না। বড় ছুটাছুটি করিয়া মোগল সেনা রন্ধ্রমুখে উপস্থিত হইল। উপস্থিত হইয়া দেখিল, মোগলের সর্বনাশ ঘটিবার উপক্রম হইয়া আছে। রন্ধ্রমুখ বন্ধ। রাত্রিতে রাজপুতেরা সংখ্যাতীত মহামহীরুহ ছেদন করিয়া পর্বতশিখর হইতে রন্ধ্রমুখে ফেলিয়া দিয়াছে–পর্ব্বতাকার সপল্লব ছিন্ন বৃক্ষরাশি রন্ধ্রমুখ একেবারে বন্ধ করিয়াছে; হস্তী অশ্ব পদাতিক দূরে থাক, শৃগাল-কুক্কুরেরও যাতায়াতের পথ নাই।
মোগল সেনামধ্যে ঘোরতর আর্তনাদ উঠিল–স্ত্রীগণের রোদনধ্বনি শুনিয়া, ঔরঙ্গজবেবের পাষাণনির্মিত হৃদয়ও কম্পিত হইল।
সৈন্যের পথপরিষ্কারক সম্প্রদায় অগ্রে থাকে, কিন্তু এই সৈন্যকে বিপরীত গতিতে রন্ধ্রে প্রবেশ করিতে হইয়াছিল বলিয়া তাহারা পশ্চাতে ছিল। ঔরঙ্গজেব প্রথমত: তাহাদিগকে সম্মুখে আনিবার জন্য আজ্ঞা প্রচার করিলেন। কিন্তু তাহাদের আসা কালবিলম্বের কথা। তাহাদের অপেক্ষা করিতে গেলে, হয় ত সে দিনও উপবাসে কাটিবে। অতএব ঔরঙ্গজেব হুকুম দিলেন যে, পদাতিক সৈন্য, এবং অন্য যে পারে, বহুলোক একত্র হইয়া, গাছের প্রাচীরের উপর চড়িয়া, গাছ সকল ঠেলিয়া পাশে ফেলিয়া দেয়, এবং এই পরিশ্রমের সাহায্য জন্য হস্তীসকলকে নিযুক্ত করিলেন। অতএব সহস্র সহস্র পদাতিক এবং শত শত হস্তী বৃক্ষপ্রাকার ভগ্ন করিতে ছুটিল। কিন্তু যখন এ সকল বৃক্ষপ্রাকারমূলে সমবেত হইল, তখন অমনই গিরিশিখর হইতে, যেমন ফাল্গুনের বাত্যায় শিলাবৃষ্টি হয়, তেমনই বৃহৎ প্রস্তরখণ্ডের অবিশ্রান্ত ধারা পড়িতে লাগিল। পদাতিক সকলের মধ্যে কাহারও হস্ত, কাহারও পদ, কাহারও মস্তক, কাহারও কক্ষ, কাহারও বক্ষ চূর্ণীকৃত হইল–কাহারও বা সমস্ত শরীর কর্দ্দমপিণ্ডবৎ হইয়া গেল। হস্তীসকলের মধ্যে কাহারও কুম্ভ, কাহারও দন্ত, কাহারও মেরুদণ্ড, কাহারও পঞ্জর ভগ্ন হইয়া গেল; হস্তী সকল বিকট চীৎকার করিতে করিতে, পদাতিক সৈন্য পদতলে বিদলিত করিতে করিতে পলায়ন করিল, তদ্দ্বারা ঔরঙ্গজেবের সমস্ত সেনা বিত্রস্ত ও বিধ্বস্ত হইয়া উঠিল। সকলে ঊর্ধ্বদৃষ্টি করিয়া সভয়ে দেখিল, পর্বতের শিরোদেশে সহস্র সহস্র রাজপুত পদাতিক পিপীলিকার মত শ্রেণীবদ্ধ হইয়া আছে। যাহারা প্রস্তরখণ্ডের আঘাতে আহত বা নিহত না হইল, রাজপুতগণের বন্দুকের গুলিতে তাহারা মরিল। ঔরঙ্গজেবের সৈনিকেরা বৃক্ষপ্রাকারমূলে ক্ষণমাত্র তিষ্ঠিতে পারিল না।
শুনিয়া ঔরঙ্গজেব সৈন্যাধ্যক্ষগণকে তিরস্কৃত করিয়া পুনর্বার বৃক্ষপ্রাচীরভঙ্গের উদ্যম করিতে আদেশ করিলেন। তখন “দীন্ দীন্” শব্দ করিয়া মোগল সেনা আবার ছুটিল–আবার রাজপুতসেনাকৃত গুলির বৃষ্টি এবং শিলাবৃষ্টিতে বাত্যা সমীপে ইক্ষুক্ষেত্রের ইক্ষুর মত ভূমিশায়ী হইল। এইরূপ পুন: পুন: উদ্যম করিয়া মোগল সেনা দুর্গপ্রাকার ভগ্ন করিতে পারিল না।
তখন ঔরঙ্গজেব হতাশ হইয়া, সেই বৃহতী সেনাকে রন্ধ্রপথে ফিরিতে আদেশ করিলেন। রন্ধ্রের যে মুখে সেনা প্রবেশ করিয়াছিল, সেই মুখে বাহির হইতে হইবে। সমস্ত সেনা ক্ষুৎপিপাসায় ও পরিশ্রমে অবসন্ন, ঔরঙ্গজেবও তাঁহার জন্মে এই প্রথম ক্ষুৎপিপাসায় অধীর; বেগমরাও তাই। কিন্তু আর উপায়ান্তর নাই–পর্বতের সানুদেশ আরোহণ করা যায় না; কেন না, পাহাড় সোজা উঠিয়াছে। কাজেই ফিরিতে হইল।
ফিরিয়া আসিয়া অপরাহ্নে, যে মুখে ঔরঙ্গজেব সসৈন্য রন্ধ্রমধ্যে প্রবেশ করিয়াছিলেন, পুনশ্চ রন্ধ্রের সেই মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন, সেখানেও প্রত্যক্ষমূর্তি মৃত্যু, তাঁহাকে সসৈন্যে গ্রাস করিবার জন্য দাঁড়াইয়া আছে। রন্ধ্রের সে মুখও, সেইরূপ অলঙ্ঘ্য পর্বতপ্রমাণ বৃক্ষপ্রাকারে বন্ধ; নির্গমের উপায় নাই। পর্বতোপরি রাজপুতসেনা পূর্ববৎ শ্রেণীবদ্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া আছে।
কিন্তু নির্গত না হইলে ত নিশ্চিত সসৈন্য মৃত্যু। অতএব সমস্ত মোগল সেনাপতিকে ডাকিয়া ঔরঙ্গজেব স্তুতি মিনতি, উৎসাহবাক্য এবং ভয়প্রদর্শনের দ্বারা পথ মুক্ত করিবার জন্য প্রাণ পর্যন্ত পতন করিতে স্বীকৃত করাইলেন। সেনাপতিগণ সেনা লইয়া পুনশ্চ বৃক্ষপ্রাকার আক্রমণ করিলেন। এবার একটু সুবিধাও ছিল–পথপরিষ্কারক সেনাও উপস্থিত ছিল। মোগলেরা মরণ তৃণজ্ঞান করিয়া বৃক্ষরাজি ছিন্ন ও আকৃষ্ট করিতে লাগিল। কিন্তু সে ক্ষণমাত্র। পর্বতশিখর হইতে যে লৌহ ও পাষাণবৃষ্টি হইতেছিল–ভাদ্রের বর্ষায় যেমন ধান্যক্ষেত্র ডুবিয়া যায়, মোগল সেনা তাহাতে তেমনই ডুবিয়া গেল।
তারপর বিপদের উপর বিপদ, সম্মুখস্থ পর্বতসানুদেশে রাজসিংহের শিবির। তিনি দূর হইতে মোগল সেনার প্রত্যাবর্তন জানিতে পারিয়া, তোপ সাজাইয়া সম্মুখে প্রেরণ করিলেন।
রাজসিংহের কামান ডাকিল। বৃক্ষপ্রাকার লঙ্ঘিত করিয়া রাজসিংহের গোলা ছুটিল–হস্তী, অশ্ব, পত্তি, সেনাপতি সব চূর্ণ হইয়া গেল। মোগল সেনা রন্ধ্রমধ্যে হটিয়া গিয়া, ক্রুর সর্প যেমন অগ্নিভয়ে কুণ্ডলী করিয়া বিবরে লুকায়, মোগল সেনা রন্ধ্রবিবরে সেইরূপ লুকাইল। শাহানশাহ বাদশাহ, হীরকমণ্ডিত শ্বেত উষ্ণীষ মস্তক হইতে খুলিয়া দূরে নিক্ষিপ্ত করিয়া, জানু পাতিয়া, পর্বতের কাঁকর তুলিয়া আপনার মাথায় দিলেন। দিল্লীর বাদশাহ রাজপুত ভুঁইঞার নিকট সসৈন্যে পিঞ্জরাবদ্ধ মূষিক। একটা মূষিকের আহার পাইলেও আপাতত: তাঁর প্রাণরক্ষা হইতে পারে।
তখন ভারতপতি ক্ষুদ্রা রাজপুতকুলবালাকে উদ্ধারকারিণী মনে করিয়া তাহার পারাবত উড়াইয়া দিলেন।
রাজসিংহ – ৮.০৩
তৃতীয় পরিচ্ছেদ : উদিপুরীর দাহনারম্ভ