রঙমহালের সকল সংবাদই আসে–সকল সংবাদই জেব-উন্নিসা নিয়া থাকেন–তিনি নায়েবে বাদশাহ। মবারকের বধসংবাদও আসিয়া পৌঁছিল।
জেব-উন্নিসা প্রত্যাশা করিয়াছিলেন যে, তিনি এই সংবাদে অত্যন্ত সুখী হইবেন। সহসা দেখিলেন যে, ঠিক বিপরীত ঘটিল। সংবাদ আসিবামাত্র সহসা তাঁহার চক্ষু জলে ভরিয়া বাহিয়া ধারায় ধারায় সে জল গড়াইতে লাগিল। শেষ দেখিলেন, চীৎকার করিয়া কাঁদিতে ইচ্ছা করিতেছে। জেব-উন্নিসা দ্বার রুদ্ধ করিয়া হস্তিদন্তনির্মিত রত্নখচিত পালঙ্কে শয়ন করিয়া কাঁদিতে লাগিলেন।
কৈ শাহজাদী? হস্তিদন্তনির্মিত রত্নদণ্ডভূষিত পালঙ্কে শুইলেও ত চক্ষুর জল থামে না! তুমি যদি বাহিরে গিয়া দিল্লীর সহরতলীর ভগ্ন কুটীরমধ্যে প্রবেশ করিতে, তাহা হইলে দেখিতে পাইতে, কত লোক ছেঁড়া কাঁথায় শুইয়া কত হাসিতেছে। তোমার মত কান্না কেহই কাঁদিতেছে না।
জেব-উন্নিসার প্রথমে কিছু বোধ হইল যে, তাঁহার আপনার সুখের হানি তিনি আপনিই করিয়াছেন। ক্রমশ: বোধ হইল যে, সব সমান নহে–বাদশাহজাদীরাও ভালবাসে; জানিয়া হউক, না জানিয়া হউক, নারীদেহ ধারণ করিলেই ঐ পাপকে হৃদয়ে আশ্রয় দিতে হয়। জেব-উন্নিসা আপনা আপনি জিজ্ঞাসা করিল, “আমি তাকে এত ভালবাসিতাম, সে কথা এত দিন জানিতে পার নাই কেন?” কেহ তাহাকে বলিয়া দিল না যে, ঐশ্বর্যমদে তুমি অন্ধ হইয়াছিলে, রূপের গর্বে তুমি অন্ধ হইয়াছিলে, ইন্দ্রিয়ের দাসী হইয়া তুমি ভালবাসাকে চিনিতে পার নাই। তোমার উপযুক্ত দণ্ড হইয়াছে–কেহ যেন তোমাকে দয়া না করে।
কেহ বলিয়া বলিয়া না দিক –তার নিজের মনে এ সকল কথা কিছু কিছু আপনা আপনি উদয় হইতে লাগিল। সঙ্গে সঙ্গে এমনও মনে হইল, ধর্মাধর্ম বুঝি আছে। যদি থাকে, তবে বড় অধর্মের কাজ হইয়াছে। শেষ ভয় হইল, ধর্মাধর্মের পুরস্কার দণ্ড যদি থাকে? তাহার পাপের যদি দণ্ডদাতা কেউ থাকেন? তিনি বাদশাহজাদী বলিয়া জেব-উন্নিসাকে মার্জনা করিবেন কি? সম্ভব নয়। জেব-উন্নিসার মনে ভয়ও হইল।
দু:খে, শোকে, ভয়ে জেব-উন্নিসা দ্বার খুলিয়া তাহার বিশ্বাসী খোজা আসিরদ্দীনকে ডাকাইল। সে আসিলে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “সাপের বিষে মানুষ মরিলে তার কি চিকিৎসা আছে?”
আসিরদ্দীন বলিল, “মরিলে আবার চিকিৎসা কি?”
জেব। কখনও শুন নাই?
আসি। হাতেম মাল এমনই একটা চিকিৎসা করিয়াছিল, কাণে শুনিয়াচি চক্ষে দেখি নাই।
জেব-উন্নিসা একটু হাঁপ ছাড়িল। বলিল, “হাতেম মালকে চেন?”
আ। চিনি।
জে। সে কোথায় থাকে?
আ। দিল্লীতে থাকে।
জে। বাড়ী চেন?
আ। চিনি।
জে। এখন সেখানে যাইতে পারিবে?
আ। হুকুম দিলেই যাইতে পারি।
জে। আজ মবারক আলি (একটু গলা কাঁপিল) সর্পাঘাতে মরিয়াছে জান?
আ। জানি।
জে। কোথায় তাহাকে গোর দিয়াছে, জান?
আ। দেখি নাই, কিন্তু যে গোরস্থানে গোর দিবে, তাহা আমি জানি। নূতন গোর, ঠিকানা করিয়া লইতে পারিব।
জে। আমি তোমাকে দুই শত আশরফি দিতেছি। একশ হাতেম মালকে দিবে, একশ আপনি লইবে। মবারক আলির গোর খুঁড়িয়া মোরদা বাহির করিয়া, চিকিৎসা করিয়া তাহাকে বাঁচাইবে। যদি বাঁচে, তাহাকে আমার কাছে লইয়া আসিবে। এখনই যাও।
আশরফি লইয়া খোজা আসিরদ্দীন তখনই বিদায় লইল।
রাজসিংহ – ৬.৯
নবম পরিচ্ছেদ : সমিধ-সংগ্রহ–দরিয়া
আর একবার রঙমহালে পাথরের দ্রব্য বেচিয়া, মাণিকলাল নির্মলকুমারীর খবর লইল। এবারও সেই পাথরের কৌটা চাবি-বন্ধ হইয়া আসিয়াছিল। চাবি খুলিয়া, নির্মল পাইল–সেই দৌত্য পারাবত। নির্মল সেটিকে রাখিল। পত্রের দ্বারা, পূর্বমত সংবাদ পাঠাইল। লিখিল “সব মঙ্গল । তুমি এখন যাও আমি পূর্বেই বলিয়াছি, আমি বাদশাহয়ের সঙ্গে যাইব ।”
মাণিকলাল তখন দোকান-পাট উঠাইয়া উদয়পুর যাত্রা করিল। রাত্রি প্রভাত হইবার তখন অল্প বিলম্ব আছে। দিল্লীর অনেক “দরওয়াজা |” পাছে কেহ কিছু সন্দেহ করে, এজন্য মাণিকলাল আজমীর দরওয়াজায় না গিয়া, অন্য দর্ওয়াজায় চলিল। পথিপার্শ্বে একটা সামান্য গোরস্থান আছে। একটা গোরের নিকট দুইটা লোক দাঁড়াইয়া আছে। মাণিকলালকে এবং তাহার সমভিব্যাহারীদিগকে দেখিয়া, সেই দুইটা মানুষ দৌড়াইয়া পলাইল। মাণিকলাল তখন ঘোড়া হইতে নামিয়া নিকটে গিয়া দেখিল। দেখিল যে, গোরের মাটি উঠাইয়া, উহারা মৃতদেহ বাহির করিয়াছে। মাণিলকলাল, সেই মৃতদেহ খুব যত্নের সহিত, উদয়োন্মুখ ঊষার আলোকে পর্যবেক্ষণ করিল। তার পর কি বুঝিয়া ঐ দেহ আপনার অশ্বের উপর তুলিয়া বাঁধিয়া কাপড় ঢাকা দিয়া আপনি পদব্রজে চলিল।
মাণিকলাল দিল্লীর দর্ওয়াজার বাহিরে গেল। কিছু পরে সূর্যোদয় হইল, তখন মাণিকলাল ঐ মৃতদেহ ঘোড়া হইতে নামাইয়া, জঙ্গলের ছায়ায় লইয়া গিয়া রাখিল। এবং আপনার পেঁটরা হইতে একটি ঔষধের বড়ি বাহির করিয়া, তাহা কোন অনুপান দিয়া মাড়িল। তার পর ছুরি দিয়া মৃতদেহ স্থানে স্থানে একটু একটু চিরিয়া, ছিদ্রমধ্যে সেই ঔষধ প্রবেশ করাইয়া দিল। এবং জিবে ও চক্ষুতে কিছু কিছু মাখাইয়া দিল। দুই দণ্ড পরে আবার ঐরূপ করিল। এইরূপ তিন বার ঔষধ প্রয়োগ করিলে মৃত ব্যক্তি নি:শ্বাস ফেলিল। চারি বারে সে চক্ষু চাহিল ও তাহার চৈতন্য হইল। পাঁচ বারে সে উঠিয়া বসিয়া কথা কহিল।
মাণিকলাল একটু দুগ্ধ সংগ্রহ করিয়াছিল। তাহা মবারককে পান করাইল। মবারক ক্রমশ: দুগ্ধ পান করিয়া সবল হইলে, সকল কথা তাঁহার স্মরণ হইল। তিনি মাণিকলালকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে আমাকে বাঁচাইল? আপনি?”
মাণিকলাল বলিল, “হাঁ |”
মবারক বলিল, “কেন বাঁচাইলেন? আপনাকে আমি চিনিয়াছি। আপনার সঙ্গে রূপনগরের পাহাড়ে যুদ্ধ করিয়াছি। আপনি আমায় পরাভব করিয়াছিলেন |”
মাণিক। আমিও আপনাকে চিনিয়াছি। আপনিই মহারাণাকে পরাজয় করেন। আপনার এ অবস্থা কেন ঘটিল?
মবারক। এখন বলিবার কথা নহে। সময়ান্তরে বলিব। আপনি কোথায় যাইতেছেন– উদয়পুরে?
মাণিক। হাঁ।
মবা। আমাকে সঙ্গে লইবেন? দিল্লীতে আমার ফিরিবার যো নাই, তা বুঝিতেছেন বোধ হয়। আমি রাজদণ্ডে দণ্ডিত।
মাণিক। সঙ্গে লইয়া যাইতে পারি। কিন্তু আপনি এখন বড় দুর্বল।
মবা। সন্ধ্যা লাগায়েৎ শক্তি পাইতে পারি। ততক্ষণ বিলম্ব করিতে পারিবেন কি?
মাণিক। করিব।
মবারককে আরও কিছু দুগ্ধাদি খাওয়াইল। গ্রাম হইতে মাণিকলাল একটা টাটু কিনিয়া আনিল। তাহার উপর মবারককে চড়াইয়া উদয়পুর যাত্রা করিল।
পথে যাইতে যাইতে ঘোড়া পাশাপাশি করিয়া, নির্জ্জনে মবারক জেব-উন্নিসার সকল কথা মাণিকলালকে বলিল। মাণিকলাল বুঝিল যে, জেব-উন্নিসার কোপানলে মবারক ভস্মীভূত হইয়াছে।
এদিকে আসিরদ্দীন ফিরিয়া আসিয়া জেব-উন্নিসাকে জানাইল যে, কিছুতেই বাঁচান গেল না। জেব-উন্নিসা আতরমাখা রুমালখানি চক্ষুতে দিয়াছিল, এখন পাথরে লুটাইয়া পড়িয়া, চাষার মেয়ের মত মাথা কুটিতে লাগিল।
যে দু:খ কাহারও কাছে প্রকাশ করিবার নয়, তাহা সহ্য করা বড়ই কষ্ট। বাদশাহজাদীর সেই দু:খ হইল। জেব-উন্নিসা ভাবিল, “যদি চাষার মেয়ের হইতাম!”
এই সময়ে কক্ষদ্বারে বড় গণ্ডগোল উপস্থিত হইল। কেহ কক্ষপ্রবেশ করিবার জন্য জিদ্ করিতেছে –প্রতিহারী তাহাকে আসিতে দিতেছে না। জেব-উন্নিসা যেন দরিয়ার গলা শুনিলেন। প্রতিহারী তাহাকে আটক করিয়া রাখিতে পারিল না। দরিয়া প্রতিহারীকে ঠেলিয়া ফেলিয়া দিয়া কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিল। তাহার হাতে তবরাবি ছিল। সে জেব-উন্নিসাকে কাটিবার জন্য তরবারি উঠাইল। কিন্তু সহসা তরবারি ফেলিয়া দিয়া জেব-উন্নিসার সম্মুখে নৃত্য আরম্ভ করিল। বলিল, “বহুৎ আচ্ছা,-চোখের জল!” এই বলিয়া উচ্চস্বরে হাসিতে লাগিল। জেব-উন্নিসা প্রতিহারীকে ডাকিয়া তাহাকে ধৃত করিতে আজ্ঞা দিলেন। প্রতিহারী তাহাকে ধরিতে পারিল না। সে ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করিল। প্রতিহারী তাহার পশ্চাদ্ধাবিত হইয়া তাহার বস্ত্র ধরিল। দরিয়া বস্ত্র খুলিয়া ফেলিয়া দিয়া নগ্নাবস্থায় পলায়ন করিল। সে তখন ঘোর উন্মাদগ্রস্ত। মবারকের মৃত্যুসংবাদ সে শুনিয়াছিল।
রাজসিংহ – ৭.১
সপ্তম খণ্ড
অগ্নি জ্বলিল
প্রথম পরিচ্ছেদ : দ্বিতীয় Xerxes–দ্বিতীয় Plataes